আজকের সকালটা কেমন ছিল বলি। গোসলের পর মেয়েদের চুল ভাল করে মুছে নিলে যেরকম হয় সেরকম। স্নিগ্ধ মায়াময় পরিছন্ন আদ্র তবে ঠিক ভেজা নয়। গত কদিনের সকাল ছিল ভীষণ বাজে। বৃষ্টি নেই, তবে সারাদিন পানির ফোঁটা আর স্যাঁতস্যাঁতে একটা গুমোট ভাব।
সকালে বাস ধরলাম। সিট পেলাম বাসে। তবে সে ভার্টিক্যাল বরাবর। বাস ছাড়লে মাথাটা দেখি ঘুরছে, গুলিয়ে যাচ্ছে সব। বেশিক্ষন সে অসুবিধা থাকেনি, এক সময় সয়ে গেল। বাস আমার বরাবর খুব ভাল লাগে। সকালের বাস মানেই এক দল লোকের গন্তব্যে ছোটা। সারাদিনের সব আয়োজন হয়ত বেধে নিয়েছে সাথে। কারো চোখে কিছুটা তন্দ্রা, চুল এলোমেলো, তাড়াহুড়ো করতে হয়েছে। আবার হয়ত অনেকের ছিল ধীর প্রস্তুতি, পরিপাটি চুল, ভাঁজহীন পোশাক, লিপিস্টিকের রঙ মেলাতেই ১৫ মিনিট লেগেছে। নিশ্চয়ই বিশেষ কেউ আছে ওর কাজের জায়গায়, অথবা ও ওরকমই। বিকেলের বাস মানে আবার ঘরে ফেরার দল। সবার যেন একটু গা এলানো, মুখে সারাদিনের ধকল। সাথের খাবারের বক্সটা খালি, আর সকালের ভাঁজহীন পোশাকে কিছুটা ভাঁজ।
আমেরিকা এসে এ শহরেই প্রথম বাসে চড়া আমার। প্রথম ক’মাস গাড়ি ছিল না। বাসে করে সবখানে যাওয়া হত। ২০ পাউন্ডের চালও আমরা বাসে করে এনেছি। ডাউন টাউনের বেশ কাছেই বাসা। একেবারে ঘরের কাছেই নামিয়ে দেয় বলা যায়। তবুও ২০ পাউন্ড চাল নিয়ে ২০ কদম হাঁটাও তো দায়। এ দেশের সবকিছুর বদনাম করলেও বাসগুলোর প্রশংসা করতেই হবে। এ দেশে লোক কম, বাসের সংখ্যাও তাই বেশি নয়। প্রতি ৩০ মিনিট আর কিছু রুটে ১ ঘণ্টা পর পর বাস ছাড়ে, তবে সে একেবারে ঠিক সময়েই। আবার স্ট্যান্ডে পৌঁছে যে প্ল্যাটফর্মে থামবার কথা ঠিক সেখানেই থামে। বাসগুলোর নম্বর থাকে। যেমন ১০ নম্বরটি প্ল্যাটফর্ম ১০ এই থামবে। ১০ এর পর হয়ত আমার ১ ধরতে হবে। তাই প্ল্যাটফর্ম ১ আসতেই আগে নেমে গেলে ভাল, হাঁটা কম লাগে, সুবিধে হয়। কিন্তু সে সুবিধের অনুরোধ এখানে করা যাবে না। একটু পর পর স্টপেজ। রেলের মত দড়ি টানলেই সামনের স্টপেজে থামে। বাসের স্ক্রিনে বড় করে লেখা আসে ‘স্টপ রিকুয়েস্টেড’। এই দড়ি টানার ব্যাপারটা ভাল। আমার মত সরু গলার লোকদের জন্য তো বটেই। ‘ভাই নামব’ বলতে হবে আর ড্রাইভারের কান পর্যন্ত সে পৌঁছাবে কিনা এই নিয়ে ভাবতে হয় না। প্রতি স্টপেজে আবার বাসের নম্বর দেয়া থাকে। যেখানে বাসের সিম্বল নেই, তার মানে এই রাস্তায় বাস চলে না। অথবা অমুক নম্বরটি নেই, মানে অমুক রুটের বাসটি এ রাস্তা দিয়ে যায় না। তবে বাসে একবার উঠলেই হল, কোথায় থামবে বলে খুব চিন্তারও কারন নেই। বাসের ভিতরে রুট ম্যাপ থাকে। ওঠাতে চোখ বুলিয়ে নিলেই হয়। আর আমার মত যারা অলস, উঠে গিয়ে সে না নিয়ে আসলেও অসুবিধা নেই, পড়ে না বুঝলেও অসুবিধা নেই। বাস যেখান থেকে ছাড়ে, ঘুরে এসে আবার ঠিক সেখানেই থামে। প্রথম প্রথম বাসের নম্বর গুলিয়ে আমাদের কয়েকবার এরকম হয়েছে। তবে লাভ ই হয়েছে তাতে। বিনে পয়সায় পুরা শহরটা ঘোরা হয়েছে। স্টুডেন্টদের জন্য এ শহরে বাস ফ্রি, শুধু আইডিটা একবার স্লাইড করলেই হল।
এ শহরের বাসগুলো মেয়েরাই চালায়। প্রথম প্রথম কিরকম জানি লাগত চোখে। আর স্বাস্থ্যবান বাসগুলো নিয়ে ডাউন টাউনের সরু ব্যস্ত রাস্তায় যখন টার্ন নিত, আমার তো প্রতিবারেই মনে হত, সামনের কার টাকে এই বুঝি থেবড়ো করে দেবে। ড্রাইভার অল্প বয়সী মেয়ে হলে সংশয় বাড়ত। না থেবড়ো হত না একদিনও। মেয়েগুলোর হাতের দখল ভাল। ঠিক টার্ন নিয়ে ফেলত। বাসের মহিলাগুলো একটু পুরুষালি মনে হয়েছে আমার কাছে। আমি দেখেছি এরা খুব একটা সাজে না। ইউনিফর্ম পরতে হয় এদের। মুখে একটা মিলিটারি ভাব, ভীষণ রুখো চুল। তবে এদের অনেকেই আবার খুব কথা বলে। বাসে উঠে মিলিটারি মুখ নিয়েই বলে কেমন আছো তোমরা? কেমন চলছে দিনকাল। এদের অনেককে আবার সামনের যাত্রীদের সাথে গল্প জুড়তেও দেখেছি। হয়ত সারাদিনে এদের একটা কথাও হয়নি কারো সাথে, যন্ত্র চালিয়ে এরা হাঁপিয়ে গেছে। গল্পে একটু জীবন খোঁজে, অথবা এরাও আমার মত, আগুন্তুকের সাথে পরিচয় উপভোগ করে। নামবার সময় অনেক যাত্রী ড্রাইভারকে থ্যাংক ইউ বলে দেখেছি। আমিও বলি। এ নর্মসগুলো আমাদের কলেজে খুব শেখাতো । বলত থ্যাংক ইউ তাকেই বেশি দেবে যাকে কেউ কখনও দেয় না। দেশে আমি অনেক রিকশা ওয়ালা সবজি ওয়ালাকে থ্যাংক ইউ বলেছি। এদের অনেকেই উত্তরে ওয়েলকাম বলেছে। অনেকেই কিছু বলেনি, শুধু ঘুরে তাকিয়েছে।
বাসের সবচেয়ে চমৎকার ও উপকারী ব্যাবহার হচ্ছে প্রতিবন্ধীদের জন্য। এ দেশে যে হুইল চেয়ার ছাড়া নড়তে পারে না। সেও সবখানে একা যায়। বাসগুলো প্লাটফর্মে যখন থামে। প্রতিবন্ধী দেখলে ড্রাইভার উঠে এসে একটা সুইচ টেপে। একটা বড় প্লেটের মত বেরিয়ে এসে প্লাটফর্মে লাগে। হুইল চেয়ারে বসা যাত্রী তার হুইল ঘুরিয়ে বাসে উঠে যায়। ড্রাইভার আবার সুইচ টিপলে প্লেটটা কোথায় জানি উধাও হয়ে যায়। ড্রাইভার সামনের সিট ফোল্ড করে যাত্রীকে জায়গা করে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দেয়। আবার নামবার সময়ও একই কায়দা। ড্রাইভারগুলো খুব ভাল। অবশ্য ভাল হওয়াটাই হয়ত এদের চাকরি। এ দেশে খুব বৃদ্ধরাও একা চলে। তবে বেশীরভাগ বাসে। বাসে চড়ে আমার মত গরীব আর যাদের শারীরিক সামর্থ্য নেই গাড়ি চালাবার।
এ শহরের সব গরীবদের দেখা যায় বাসে উঠলে। যাত্রী ছাউনিতে দেখেছি, এরা প্রায়ই টাকা চায়। নেশা করে এদের অনেকে, চোখমুখেই সে সুস্পষ্ট। অনেকে আবার সত্যি গরীবও। তবে পোশাক পরিচ্ছদে সে বোঝা দায়। এদেরকে টাকা দিতে নিষেধ করে সবাই। হয়ত মানিব্যাগ নিয়ে ছোঁ মেরে দৌড় দেবে। অথবা দেবার জন্য থেমেছি, গান দেখিয়ে বলল, যা আছে সব দাও। এ দেশে গান এলাউড। আর খুন তো অহরহই হয়। আমাদের দেশে লোকেরা কোন একটা কারনে খুন করে; অভাব প্রতিহিংসা ক্ষমতা। এ দেশের লোকেরা কারন ছাড়াই খুন করে। হয়ত কোন কাজ নেই, চলো একটা খুন করা যাক। জীবনের এক ঘেয়েমিতা তাতে একটু কাটল। এ শহর নিয়ে লিখলে আসলে দু তিনটে বই অন্তত লেখা যায়। কালোদের শহর ভীষণ বৈচিত্র্যময় মনে হয় আমার কাছে।
কালোদের শহরে এসে প্রথম যে কথাটা শুনেছি তা হল এ শহর নিরাপদ নয়। মাঝেই মাঝেই মোবাইলে সেক্সুয়াল এসল্ট, রোবারির এলার্ট আসে। তবে বুদ্ধি করে চললে ঠিক অতটা অনিরাপদও নয়। কালদের মধ্যে যারা ভাল, দেখেছি এরা ভীষণ ভাল আর সরল হয়। আর যারা উৎশৃঙ্খল, সেটা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এরা যখন গাড়ি ছোটায়, দ্রিম দ্রিম আওয়াজ ফেলে দেয় বুকে। এত বেশি ডেসিবেলের শব্দে গান বাজায়, আর বিট তো আছেই। এমনকি স্কুলের ভিতরের রাস্তাতেও এরা তাই করে। এদের চালচলন এমনই যে কাউকে পরোয়া করে না। বিটের শব্দ শুনেই বোঝা যায় শরীরে কতটা আগুন জ্বলছে। বয়ফ্রেন্ড হিসেবে কালো ছেলেদের ডিমান্ড ভাল। প্রচুর সাদা মেয়েরা কালো ছেলে নিয়ে ঘোরে। তবে এখনও পর্যন্ত সাদা ছেলের কালো গার্ল ফ্রেন্ড আমি দেখিনি। কালোদের সাজপোশাক ভারী উৎকট। এরা সাদাদের মত লুকিয়ে সাজতে জানে না। রংচংঙা পোশাক আর এক গাদা অদ্ভুত মালা টালা পরে। সাদারা অনেক মেকাপ করে। তবে খুব খেয়াল করে না দেখলে, চট করে ধরা যায় না সৌন্দর্যের রহস্য।
অনেক লম্বা হয়ে যাচ্ছে লেখা। অদ্ভুত এ শহর নিয়ে আর একদিন লিখব। মরগ্যানের লেখাটা লিখব আগামীদিন। এ শহরে বেশীরভাগ লোকের নকল চুল, তবে মরগ্যানের চুলটি আসল। মরগ্যান মেয়েটির গল্প লিখতেই হবে। মরগ্যানের হৃদয়টা আমি কাঁচ ভাঙা করে দিয়েছি। তবে মরগ্যান কাঁদেনি। কালোরা আমাদের মত এত ফ্যাস ফ্যাসিয়ে কাঁদে না। এদের চোখে আমি যা দেখেছি তা হল বারুদ।