somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পুরুষের ভিড়ে আমি, আমরা

০৮ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোটবেলায় বাসার পাশে শিক্ষা অফিস। সেই অফিসে এক অফিসার থাকতেন। হোমড়াচোমড়া বিশালদেহী লোকটি খুব ভালোবাসতেন আমাকে। লোকটির বাড়ি অন্য জেলায়, অফিসেই বাস গেঁড়েছেন। আমি বাড়ির উঠোনে খেলতাম। ভদ্রলোক জানালা দিয়ে খেলা দেখতেন, এটা ওটা খাবার জন্য অনুরোধ করতেন। আমি জানালার শিকের কাছে গিয়ে ইতস্তত করে ফিরে আসতাম। একদিন মা-ই বলল, ‘এত ভালোবেসে কাকু যখন দিচ্ছে, নাও না। নিশ্চয়ই বাড়িতে রেখে আসা নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ছে।’ একদিন কাকু একটা বড় চকলেটের প্যাকেট দিলেন আর বললেন, যখন কেউ থাকবে না, অফিসের ভেতরটায় তুমি এসো খুকি। মাকে গিয়ে বললাম, মা কাকু তো আজ আমায় ভেতরে দাওয়াত দিয়েছে, আমি কি যাব? মায়ের দেখি সেদিন মন বদলেছে। বললেন, অত দাওয়াত খেতে যেতে হবে না। আর ওই লোক ডাকলে কখনো কাছে যাবে না তুমি, ওই জানালার কাছেও খেলবে না।

অন্তর্বাস পরা তখনো শিখিনি। বান্ধবীরা পরে। একদিন রিদিতা বলল, এই রফিক স্যার আমার ‘ইয়ে’ ধরে টান দিয়েছেন। তখন লিপি, রিমা এরাও দেখি বলছে রফিক স্যার ওদেরও ইয়ে ধরে টান দিয়েছে। আমি সেদিন প্রথম ‘ইয়ে’ পরেছি, রফিক স্যারের ক্লাস। আমার ভীষণ কৌতূহল, স্যার কখন আমার ‘ইয়ে’ ধরে টানবে। তবে একটা দুশ্চিন্তাও মনে এলো। আজ যে আমি ইয়ে পরেছি সে কথা স্যার জানবেনই বা কি করে! রফিক স্যারের জহুরি চোখ বলতে হবে। স্যার প্রথমে এসে আমার পিঠে হাত বুলালেন। কিছুটা সময় নিলেন, ইয়ের ফিতাটা ধরে টান দিলেন, তারপর ছেড়ে দিলেন। রাবারের ফিতাটা হাল্কা পটাস শব্দ করে পিঠে আছড়ে পড়ল। স্যার কিন্তু আর কিছুই করলেন না। কি সুখে স্যার এই ইয়ে টানাটানি করতেন, স্যারের এই মনস্তত্ত্ব আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। বড় হচ্ছিলাম ধীরে ধীরে আর নারী-পুরুষের এই সম্পর্কগুলো নিয়ে ভীষণ ভাবছিলাম।

হুমায়ুন আজাদের নারী কিনলাম কলেজে থাকতে। কিন্তু কয়েক পাতা পরে আর পড়তে পারলাম না। যে কোনো পুরুষ দেখলেই মনে হতো ও বুঝি শিশ্ন উঁচিয়ে তেড়ে আসছে। হুমায়ুন আজাদের ওপর তখন খুব রাগ হলো আমার। কলেজে উঠেছি, কোথায় প্রেম করব বলে পুরুষ খুঁজছি আর উনি এসব লিখে ভয় ধরিয়ে দিলেন। সাহায্য করলেন আমার গৃহশিক্ষক। প্রেমের পদ্য লিখলেন কয়েকটি, তুমিই আমার সুচিত্রা। তখন মনে হলো, প্রেম-টেম যখন এত মনে আছে পুরুষের জাতটি হয়তো একেবারে খারাপ নয়। বয়স তখন আমার পনেরো-ষোল, পুরুষকে তুচ্ছজ্ঞান করবার সেটি উপযুক্ত বয়সই বটে।

ক্যাম্পাসে থাকতে উঠোনে পাটি পেতে আমরা মেয়েরা বসেছি। পাশেই রাস্তা, ক্যাফেটেরিয়া, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেরা। ওদের বসার জায়গা নেই, আজ নারী দিবস বলে যেন ওদের শাস্তি। খুব জ্বালাময়ী বক্তৃতা চলছে, পুরুষরা কীভাবে আমাদের পেষণ করেছে, রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা পাটিতে বসে রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরনা নিচ্ছি। বেশ কটি কবিতা আবৃত্তি হলো। কবিতা শুনতে গিয়ে নারী দিবসে আমি এক পুরুষের প্রেমে পড়ে গেলাম। পুরুষটির নাম এডিপাস। আসল নাম জানি না। থিয়েটার করত। কুয়েট থিয়েটারে এডিপাস করে সে আমাদের মন কেড়েছিল। তবে থিয়েটারের সেদিন সবাই এডিপাসকে ছি ছি করেছিল, মায়ের সঙ্গে বিয়ে! বোন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। তার বই ধারটার করে কিছু পড়েছি। তখনই ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে বিন্দু পরিচয়। লর্ড বায়রনের ‘ডন জুয়ান’, সোফিকলিসের ‘এডিপাস রেক্স’; অবৈধ প্রেমের যতসব আজগুবি গল্প। আর বাংলা সাহিত্যেই এত বস্তা বস্তা সুখপাঠ্য বই, ইংরেজিও যে দুই পাতা পড়ে ভাবটাব নেব, তার আর সময় কই। এডিপাসকে ক্যাম্পাসে পরে অনেক দেখেছি। এবং জেনেছি অনেক মেয়েরই আমার মতো দশা। সেদিনের আবৃত্তিতে এডিপাস যখন ঠোঁট কাঁপিয়ে বলল, বন সঙ্গমে কেটে উঠল পাতা। এডিপাসের ওই কণ্ঠে যেন বনের পাতা নয় আমিই কেঁপে উঠলাম। এরপর সিভিলের রুশো যে ক্যাম্পাসের বিখ্যাত নেতা ছিল, সে দিল একটি সুন্দর মুখস্থ বক্তৃতা। ‘এমন একটি দিন আসবে যেন নারী দিবস করার কোনো প্রয়োজন না পড়ে’। রুশো বরাবর ভালো বক্তা। তার সেদিনের মুখস্থ বক্তৃতাটাও খুব ভালো হয়েছিলো। রুশোর ছবি মাঝে মাঝে দেখি ফেসবুকে। ও আমার বন্ধু নয়। এক জুনিয়রকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছে। নারীবাদী রুশোর বউটিও প্রকৌশলী, তবে এখন হয়তো ঘরের কাজ করে। এরপর আর নারী দিবসের প্রোগ্রামে যাইনি। পাস করে ফেললাম, জীবনের নৌকো ভিড়ল আরেক ঘাটে। এতদিন যে ছেলেরা ফুল-চিঠি দিয়ে জ্বালিয়ে মারছিল, তারা দেখি সব কোথায় হারিয়ে গেল। বুঝলাম, বয়স হচ্ছে, ছেলেদের আগ্রহ তাহলে সত্যিই ফুরোচ্ছে।

ক্যাম্পাসের বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হতো। যে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে ক্যাম্পাসে একরাশ জড়তা ঘিরে ধরতো। আজ দেখি, তাদের দেখলেই আপ্লুত হয়ে প্রায় জড়িয়ে ধরছি। একটু দেখা, দুদণ্ড কথা হলেই যেন সবাই খুশি। কে পর্নো দেখত, কে মেয়েদের টিজ করত সেসবও আর মাথায় নেই। ছেলেগুলোর আচরণও সাবলীল। ওরাও অনেক বদলেছে। আমার মনে হলো, পাস করার পর নিজেদের নারী-পুরুষ না ভেবে এই প্রথম আমরা বন্ধু ভাবা শুরু করলাম।

চাকরি করতাম বাংলামোটরের এক অফিসে। যাওয়ার সময় কারওয়ান বাজার নেমে বাকি পথ বাংলাভিশনের সামনে দিয়ে হাঁটা। দুলাভাইয়ের সঙ্গে আসতাম, অসুবিধে হতো না। যাওয়ার সময় বিরাট হ্যাপা। বাংলামোটর থেকে বাসে সুবিধা করতে পারতাম না, হেঁটে ফার্মগেট আসা। তারপর ভলভো বাসে মিরপুর ফেরা। কিন্তু সে ফেরা নিয়েও এক ফেরোসিয়াস কাণ্ড। আমার নিতম্বটি এমন সুডৌল কিছু নয়। কিন্তু সেই নিয়ে দেখি বাসের লোকদের কাড়াকাড়ি। এত সাবধানে উঠছি, তবুও কোত্থেকে একটা হাত এসে ঠিক ঢুকে যেত নিতম্বের ফোঁকরে অথবা বগলের ভাঁজে। ঘুরে চোখ মেলে এত মানুষ, ঠিক কাকে শাসাব আমি! আর লোকগুলো উল্টো আমার ওপরই রাগত। আরে উঠুন তো ম্যাডাম, লোকে বাড়ি ফেরা নিয়ে মরছে আর আপনি আছেন গায়ে হাত দেওয়া নিয়ে।

নিতম্বখানা আর তার ফোঁকরটা বাঁচাতে শেয়ারের রিকশা নিতে হলো কিছুদিন। কিন্তু বাড়ির লোকে খুব বকত। দরকার হলে বাড়ি ফিরো না কিন্তু এই শেয়ারের কাজ করো না, এ এক বিরাট ফাঁদ। অগত্যা সামর্থে কুলালে একক রিকশা আর নয়তো পুরো পথ হাঁটা। সংসদ ভবনের ওই লম্বা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে আত্মা শুকিয়ে যেত। নির্জন রাস্তা, মাঝে মাঝে অদ্ভুত অদ্ভুত লোকে পেছন পেছন আসত। তখন মনে হতো এ কোথায় পড়লাম বাপু! বাস তো তোমাদের দিয়ে দিয়েছিই, এখন এই হাঁটাপথটাও দখলে নেবে! শেষে সত্যি একটা ফোবিয়া হয়ে গেল আমার এবং চাকরিটা আমি ছেড়েই দিলাম। কারণ আমি বুঝেছিলাম আমার সহযাত্রীরা খাঁটি পুরুষ হলে হতে পারে কিন্তু মানুষ অন্তত নয়। অনেক প্রতিবাদী মেয়ে ছিল, তারা আবার গলাটলা তুলত। কিন্তু সেও এক বিরাট সার্কাস। গলা তুলতে গিয়ে মাথা নিচু হওয়ার দশা। বোনের বাড়িতে থাকি, গলগ্রহ কিছুটা ছিলাম বটে। মাঝে মাঝেই মনে হতো, দূরে কোথাও যাই না চলে, আর কোনো দিন না ফিরি। কিন্তু সে আর করতে পারিনি। পৃথিবীটাকে তখন একটা উঁচু পাচিল ঘেরা জেলখানা মনে হতো। তোমরা আমায় আশ্রয় দিতে চাইছ না। আবার আশ্রয় খুঁজতেও দিচ্ছো না। মান-সম্মান জলে যাবে বলে। আজব কাণ্ড! তারপর শেষমেশ জোর করে উঠলাম ক্যাম্পাসের মেয়েদের সঙ্গে, মোহাম্মদপুরের এক বাসায়। মোহাম্মদপুরের লোকগুলো ভালো। এরা মেয়েদের গায়ে হাত দিত কম, দিলেও নিতম্বের ফোঁকরে আগ্রহটা কম। তবে বাসাটা ছিল এক সাক্ষাৎ জেলখানা। বাড়িওয়ালার নানা বিধিনিষেধ। অন্য বাড়ি যে খুঁজব, সে চেষ্টাও হলো। এক আপু বুকের ছাতি ফুলিয়ে বললেন আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী আর একজন বললেন আমি এলজিইডির। আমার সই ছাড়া কত প্রোজেক্ট আটকে যায় জানেন? কিন্তু বাড়িওয়ালা এসব ছাতি ফুলানো কথায় ভুললেন না। এক কথা, সে তুমি যেই হও বাপু, আজকালকার মেয়েরা বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে শরীর ভাড়া দেয় সে আমরা ঢের জানি। অগত্যা এত অসম্মানিত হওয়ার চেয়ে আর না খোঁজার সিদ্ধান্ত হলো। আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলেটি ছিল দুই সন্তানের জনক, বেকার, অলস। তবে বেকার হলেও একটি কাজ তার ছিল। তা হলো স্ত্রীকে সকাল-বিকেল মারধর করা। মাঝে মাঝে বউটি পালিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে উঠে আসত। আর চুলের মুঠি ধরে ছেলেটি টানতে টানতে নিয়ে যেত তাকে। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি লেখাপড়া খুব বেশি শেখেনি, ছেলের ঢাকায় এত সম্পত্তি বলে বাবা-মা বিয়ে দিয়ে এখন আঙুল চুষছে। মাঝে মাঝে এদের দেখতাম রিকশায় করে ফিরছে। বউটির সেই মুঠি করা চুল হাওয়ায় উড়ছে, চোখে মুখে দিপ্তির আভা। বুঝতাম আজ তাহলে এদের খুব প্রেম চলছে।

বাড়িওয়ালার ছেলের একবার নায়ক আর আরেকবার ভিলেনোচিতো আচরণ, পৃথিবীতে নিজের একটা ঠাঁই খোঁজার প্রচেষ্টা এই নিয়ে আমাদের দিন চলছিল বেশ। এর মধ্যে বিদেশে যাওয়ার জোগাড়জন্তর করছিলাম। পাসপোর্ট করতে হবে। খুব ঘরকুনো আর জগতের ব্যাপারে একেবারে নিরেট মূর্খ আমি। আমার এই মূর্খতার কথা আমার বন্ধুমহলের অনেকেই জানত। এক দরদি বন্ধু এগিয়ে এলো। বলল, আমি তো অস্ট্রেলিয়া যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত, আমার ভাইকে বলে দিচ্ছি, সে মিনিটেই তোমার পাসপোর্ট করে দেবে। মিনিটে না পেলেও পাসপোর্ট হাতে পেতে আমার তিন মাস সময় লাগল। পাসপোর্ট করতে বন্ধুর ভাইটি দেখি পাসপোর্ট ছাড়াই, আজই আমায় নিয়ে পৃথিবী ঘুরতে চায়। সামনের সপ্তাহে মালয়েশিয়া যাবে সে। পাসপোর্ট যেহেতু এক মিনিটেই পাচ্ছি তাই আমিও যেন মালয়েশিয়া যাই তার সঙ্গে। একসঙ্গে ঘুরলাম, পৃথিবী দেখলাম, জীবনানন্দের কবিতা পড়লাম এর বেশি কিছু নয়। এই ভদ্রলোকেরও বউ আছে, সঙ্গে দুটি বাচ্চা। সেই বউ-বাচ্চা ফেলে জীবনানন্দের কবিতা উনি কেন আমার সঙ্গে পড়তে চাইলেন বুঝলাম না। ভদ্রলোক আমার ডকুমেন্টস আটকে রেখে অনেক ধরনের ব্ল্যাক মেইলের চেষ্টা করলেন। অগত্যা একটু ইতস্তত করে বন্ধুকে সবটা বললাম। কারণ ভদ্রলোক সেদিন তাঁর ওই পাজেরোতে আমাকে উঠিয়েই ছাড়বেন। সরাসরি যেহেতু খারাপ কথা বলেননি, আমিও খারাপ ব্যবহার করতে পারছিলাম না। পরে বন্ধুকে ফোন দিতে সে-ই আমাকে উদ্ধার ও বাকি ব্যাপারটা মীমাংসা করল।

বিবাহিত পুরুষদের আমার প্রতি এই গভীর প্রেমের কথা বলতে গিয়ে আর একটি ঘটনা মনে পড়ছে। বাবার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট তুলতে গিয়েছি আমি। লোকে যে পত্রিকায় লেখে বিরাট ভোগান্তি, লম্বা লাইন। এর এক বর্ণও মিথ্যে নয়। আমার অল্প বয়স আর মিহি কণ্ঠস্বর দেখে দারোয়ান লোকটি দেখি আমি এত শেষে এলেও গেট ছেড়ে দিল। ভেতরে গিয়েও দেখি সেই একই অবস্থা, যেন আমার জন্যই তারা টেবিল গুছিয়ে অপেক্ষা করছে। আমার তখন ষোল-সতেরো বয়স। অমুক তমুকের ফাইল নড়ছে না। আমার বাবার ফাইলটি লাফিয়ে লাফিয়ে এ টেবিল থেকে ও টেবিল হয়ে দুদিনেই কাজ শেষ হয়ে গেল। যে অফিসারটি কাজ করে দিলেন, ভীষণ মিশুক লোকটি। রোজ ফোন দিতেন আর বলতেন, আসেন না আপা চা খাই একদিন, শুধু আমি আর আপনি। শেষে না পেরে ভদ্রলোককে বললাম, জ্বালিয়েন না তো ভাই। আমি চা খাই না, কোষ্ঠকাঠিন্য আছে আমার।

এরপর বিদেশ টিদেশ চলে এসে খুব দেশপ্রেমিক হলাম। দেশের এই সেই বিষয় নারী অবমাননা নিয়ে দু-এক কথা লিখতাম। আমি তখন গাড়ি ড্রাইভ করছি, কাজ শেষে যখন খুশি বাড়ি ফিরছি আর বিয়ে না হয়ে, একলা কেন এ দেশে এলাম এই প্রশ্নের উত্তর জনে জনে বিলোচ্ছি। তবে এ দেশে এসে নিজেকে যেন ধীরে ধীরে চিনছিলাম আমি। আর এই চেনার কাজে আমার সঙ্গের বদ বান্ধবীটি বিরাট সাহায্য করল। বান্ধবী আবার খুব ডাকাবুকো ছেলে পেটানো মেয়ে। বান্ধবীটির আশকারায় আমেরিকা বসে আমি তখন পুরো পৃথিবীর অবাধ স্বাধীনতা উপভোগ করছিলাম। মায়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা হতো। মা নিজের গল্প না বলে অদরকারি গল্পই বেশি বলতেন। যেমন ওই যে তোমার মামাতো চাচাতো মামার মেয়ের খালাতো ভাইয়ের ছেলের বউ সে তো পাশের বাড়ির ছেলেটির সঙ্গে পালিয়েছে। গাঁয়ের লোক এখন তাকে একঘরে করেছে। অনেক কষ্টে সম্পর্কের হিসাব কষে আমাকে বের করতে হলো, কে এই রোমিও-জুলিয়েট। হিসাব কষে মনে হলো পালিয়ে বেশ করেছে মেয়েটি। অমন একটা উদ্ভট স্বামী থাকলে আমিও রোজ পালাতাম। কাজের লোকদের গল্পও মা বলতেন। মালেকার মা এসেছিল। তোমাদের কথা জিগ্যেস করছিল, তোমরা কত বড় হয়েছো, সে দেখতে চায়। আমার হয়তো সেদিন খুব মাথা ধরেছে, সে কথা জিজ্ঞেস না করে মালেকার মায়ের গল্পই মা চালিয়ে গেল। মালেকার মায়ের নাতনিটি যার সেদিন বিয়ে হলো, তার তো ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। কোলে জুমকা বাচ্চা মেয়েটির কী বিপদ বলো তো। স্বামী ছেড়ে যাওয়া হয়তো সত্যিই বিপদের কথা। স্বামী ছাড়া মেয়েদের আছেটাই বা কি! মালেকার মাকে তাঁর স্বামী ছেড়েছে, মালেকাকে তাঁর স্বামী, মালেকার মেয়েকে তাঁর স্বামী। তাহলে এ নিশ্চয়ই ওদের পারিবারিক ঐতিহ্য। তাই এ নিয়ে আমি আর খুব বিচলিত হতাম না। শুধু হুম বলে নিজের কাজ করতাম।

এর মাঝে আরেকদিন মায়ের ফোন। তোর ছোট চাচার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। কী বড়লোকরে বাবা। ওই মেয়ের যে ওখানে বিয়ে হলো এই তো বেশি। আমাকে আর তোর আব্বাকে কাপড়চোপড় দিয়েছে ওরা। তোর আব্বার প্যান্টের পিসটি ভীষণ দামি। আমার শাড়িটিও দামি তবে বেগুনি। আমি কালো মানুষ, আমাকে বেগুনি শাড়ি কী বুদ্ধিতে দিল বলত? আর গিয়েছিলাম মীমাংসা করতে। আর তোর বজ্জাত বোন বলছে সে নাকি এই সংসারই করবে না। বললাম তুমি এখানে সোনা খাও সোনা হাগো, এই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে তুমি কোথায় যাবে মা। মায়ের কথায় আমিও সায় দিলাম। সোনা হাগলে নিশ্চয়ই তার সেখানেই থেকে যাওয়া উচিত।

এর মাঝে একদিন একটা লেখা দিয়েছিলাম ফেসবুকে। ‘টি ২০-তে বাংলাদেশ জিতেছিল সে রাতে। আমাদের রাজিয়া সুলতানা রোডের সব ছেলেরা রাস্তায় নেমেছিল। ড্রাম বাজিয়ে ভীষণ হুল্লোড় করছিল ওরা। সে রাতে আমার খুব ইচ্ছে করছিল ছেলে হতে। ইচ্ছে করছিল ওদের ওই আনন্দ মিছিলে আমিও যাই। কিন্তু আমি যেতে পারিনি। শুধু বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশের আপুটিকে বলেছিলাম, আপু আজ আমার খুব ছেলে হতে ইচ্ছে করছে, আপনারও কি করছে? আপু আমার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর একটি দীর্ঘশ্বাস আমার কাঁধেও পড়েছিল। আর আপু বলেছিলেন, আজ আমারও খুব ইচ্ছে করছে রে।’

আমাদের সমাজে অনেক সময় মনে করা হয়, ‘সমাজে মেয়েদের বাধাটা কোথায়! মুখে রং চড়িয়ে পায়ে হাই হিল গড়িয়ে ওরাই তো রাজ্য করছে।’ আজ হাসির ছলে যে বিড়ম্বনাগুলো নিয়ে বলেছি, সেগুলোই একসময় জানালার গ্রিল ধরে গোপনে কত কাঁদিয়েছে। যে অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার জন্য মেয়েটি ভয়াবহ মানসিক ও শারীরিক বিপর্যস্ততার শিকার, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আবার সে বিষয়টির জন্য উল্টো তাকেই দায়ী করা হয়। তাই সমাজ পরিবর্তনের আশায় আর বসে থাকা নয়। এ পরিবর্তনের ভার, তোমার জীবন তোমারই হাতে নারী। তুমি উপেক্ষা করতে শেখো, ভাঙতে শেখো। যা করতে ইচ্ছে সেই ইচ্ছের ঘুড়ি ওড়াতে শেখো। তোমার ফুসফুসে ঠিক কতটা দম, আজ সে তুমি নিজেই আবিষ্কার করো। আর একবার সাহস করে মুক্ত আকাশের নিচে এসে দাঁড়াও। দেখবে, শুধু নারী নয়, অনেক পুরুষও তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শেষ কথা, নারী অধিকার মানেই একপেশে পুরুষ নিন্দা নয়, বরং আমি মনে করি নারী-পুরুষের সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানই পারে একটি সুস্থ, সুষম, সুন্দর সমাজ নিশ্চিত করতে।





এন টিভি বিডি নিউজ পোর্টালে নারী দিবসে আমার এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। লেখাটির লিংকঃ

লিংক
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ৮:১৩
১৭টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×