দেশী-বিদেশী জাল মুদ্রা পাচারের নেপথ্যে পাকিস্তানি চক্র
আলাউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ : ১১ আগস্ট, ২০১৫
ভারতসহ বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রা তৈরি ও পাচারের বিষয়ে তদন্তে ভারতের ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সির (এনআইএ) একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল আজ বাংলাদেশে আসছে। এ দলে এনআইএর প্রধান শারদ কুমারও রয়েছেন। তারা চার দিন বাংলাদেশে অবস্থান করে জাল মুদ্রাবিষয়ক মামলা তদন্তসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে বৈঠক ও পুলিশ সদর দফতরে আইজিপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে। প্রতিনিধি দলের সফরকালে জাল মুদ্রা বিষয়ে যৌথভাবে কাজ করার জন্য একটি এমওইউ (মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং) স্বাক্ষর হওয়ার কথা রয়েছে। পুলিশ সদর দফতর, এসবি ও সিআইডি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মূলত পাকিস্তানি একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক জাল রুপি তৈরি করে তা পাচারের জন্য রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে। এনআইএর সফরে এ বিষয়টির তদন্তই প্রাধান্য পাবে। ইতিপূর্বে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), শুল্ক গোয়েন্দা ও বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার অভিযানে বিশাল অংকের জাল টাকা ও রুপিসহ দেশী-বিদেশী মুদ্রা উদ্ধার হয়েছিল। জাল রুপি পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয় পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন নাগরিককে। সফরে এনআইএ সদস্যরা জাল মুদ্রা উৎপাদনকারী, পাচারকারী ও এসব মুদ্রা ব্যবহারকারী মাদক ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেবেন বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও তাদের কাছে থাকা তথ্য এনআইএকে সরবরাহ করবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর, সিআইডি, এসবিসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা বৈঠক করে এনআইএর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার এজেন্ডা চূড়ান্ত করেছেন।
সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, পাকিস্তানি একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ভারতীয় রুপিসহ বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রা তৈরিতে জড়িত। এসব মুদ্রা পাচারের রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে চক্রটি। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে এসব মুদ্রা পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশ থেকে এসব মুদ্রা ভারত, নেপাল ও ভুটাসহ বিভিন্ন দেশে যায়। বাংলাদেশের রাজশাহী, যশোর, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, লালমনিরহাট, পঞ্চগড়সহ সীমান্তবর্তী এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে এসব মুদ্রা ভারতে পাচার হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইতিপূর্বে ভারতীয় জাল রুপি পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি গ্রেফতার হন। জাল মুদ্রা কারবারের সঙ্গে পাকিস্তান হাইকমিশনের এক কর্মকর্তার জড়িত থাকারও অভিযোগ আসে। পাকিস্তান এয়ারলাইনসের এক কর্মকর্তার গাড়িচালক গত মার্চে জাল মুদ্রাসহ আটক হয়েছিল। এ ছাড়া পাকিস্তান হাইকমিশন ও এয়ারলাইনসের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জাল মুদ্রা চোরাচালানে জড়িত। মুদ্রা চোরাচালানে আটক পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাদের অধিকাংশই ভুয়া ভিসা ব্যবহার করেন। শুধু তাই নয়, ভিসা কেনার রসিদও তারা নকল করেন।
সূত্র আরও জানায়, গত দুবছরে দেশে ৩০ কোটির বেশি ভারতীয় জাল রুপি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চালানটি পাওয়া যায় গত বছরের ২৭ এপ্রিল। ওই দিন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ছয় কোটি ভারতীয় জাল রুপি উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। প্রতিটি ৪০ কেজি ওজনের ৪টি কার্টনে করে এসব মুদ্রা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আনা হয়। বিমানবন্দরের এয়ার ফ্রেইট ইউনিট থেকে ওই সব মুদ্রা জব্দ করেছিল শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ।
পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান যুগান্তরকে জানান, এনআইএ প্রধানের নেতৃত্বে যে প্রতিনিধি দলটি আসছে তারা মূলত জাল মুদ্রাবিরোধী টাস্কফোর্সের সদস্য। এ টাস্কফোর্সের সদস্যরা এর আগেও বাংলাদেশে এসেছিলেন।
শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ ও পুলিশের তথ্যমতে, ৪ ফেব্রুয়ারি ৭০ লাখ ভারতীয় জাল রুপিসহ আকরাম নামে এক পাকিস্তানি নাগরিক, গত ৩ ফেব্রুয়ারি এক কোটি ভারতীয় রুপিসহ পাকিস্তানি নাগরিক মোহাম্মদ আলী, গত ২০ নভেম্বর এক কোটি ১৭ লাখ ভারতীয় রুপিসহ পাকিস্তান প্রবাসী বাংলাদেশী মোহাম্মদ সেলিম, গত ১৫ জানুয়ারি ৮০ লাখ ভারতীয় রুপিসহ এমরান মোহাম্মদ নামে এক পাকিস্তানি, গত বছরের ১ আগস্ট দুই কোটি ৬ লাখ ভারতীয় রুপিসহ শরীয়তপুরের খলিল বেপারী, এ ছাড়া কয়েক দিন আগে ৬০ লাখ এক হাজার ভারতীয় রুপিসহ পাকিস্তানের নাগরিক আইয়ুব আলী ও এক কোটি ভারতীয় জাল রুপিসহ পাকিস্তানের নাগরিক রেহান আলীকে গ্রেফতার করা হয়। তারা দুবাই, করাচি, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসব মুদ্রা নিয়ে আসেন। এ ছাড়া যশোরে ডিবি পুলিশের অভিযানে ওবায়দুর রহমান নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা জাল রুপিসহ আটক হন।
পুলিশ আরও জানায়, জাল মুদ্রা কারবারে জড়িত সন্দেহে বাংলাদেশের পাকিস্তান দূতাবাস থেকে সহকারী ভিসা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাযহার খানকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে জাল মুদ্রা ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীকে দেয়া এবং বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কাজে ব্যবহারের অভিযোগ ছিল। মাযহার খান ১৭টি চ্যানেলের মাধ্যমে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মঈনুল খান সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বিদেশে আসা-যাওয়ার পথে বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা বহন করা আইনত দণ্ডনীয়। জাল মুদ্রা রাখা ও বহন করা ফৌজদারি অপরাধ। দেশে সবচাইতে বেশি জাল রুপি ও বৈদিশিক মুদ্রা আটক করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। তিনি আরও জানান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রা তৈরির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটককৃতদের অধিকাংশই পাকিস্তানের নাগরিক। এগুলো নিখুঁতভাবে পাকিস্তানে তৈরি করে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে ভারতে পাঠানো হয়। অনেক সময় এসব অর্থ জঙ্গি অর্থায়ন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়। এনআইএ প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত হয়েছেন। তবে এনআইএর সঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দার আনুষ্ঠানিক কোনো বৈঠক নেই।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) আবদুল্লাহেল বাকী যুগান্তরকে জানান, পাকিস্তানি একটি সিন্ডিকেটের জাল মুদ্রা তৈরি ও পাচারে জড়িত থাকার তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। চক্রটি যাতে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে মুদ্রা পাচার করতে না পারে সে লক্ষ্যে সিআইডি কাজ করছে। এনআইএর কাছ থেকে আরও তথ্য পেলে পাচারে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
- See more at: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৮:০৬