আজকের পত্রিকা»প্রথম পাতা»কোটি কোটি টাকা লেনদেন
কোটি কোটি টাকা লেনদেন
সৈয়দ আতিক
প্রকাশ : ২২ আগস্ট, ২০১৫
মদ্রাসা শিক্ষক আবুল বাশার ব্যাংক এবং ব্যাংকের বাইরের চ্যানেলে জঙ্গিদের কোটি কোটি টাকা জোগান দিয়েছেন। দুই বেসরকারি ব্যাংকের বরিশাল অঞ্চলের শাখা সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা লেনদেন করেন। ব্যাংকে স্থায়ী আমানত রাখা হয় মোটা অংকের অর্থ। এর ওপর ঋণ নেয়া হয়েছে। ঋনের টাকা লেনদেনের তথ্যও পাওয়া গেছে। মাদ্রাসা শিক্ষকের আয়ের উৎসের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের কোনো সঙ্গতিও পাওয়া যায়নি। বাশার ঢাকা ও সিলেটে ব্লগার হত্যার সঙ্গে জড়িত। একই সঙ্গে তিনি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতাও। এ ধরনের লেনদেনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট আবুল বাশারের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান শেষে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এ প্রতিবেদনের কপি পুলিশ সদর দফতর, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দফতর, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) রয়েছে। প্রতিবেদনের একটি কপি যুগান্তরের হাতেও এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘জঙ্গিদের লেনদেন বা সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে সবগুলো ব্যাংক সতর্ক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ নির্দেশনার পর এসব ব্যাংক কোনো ধরনের সন্দেহজনক লেনদেন হলেই তাৎক্ষণিক রিপোর্ট করে থাকে। আমরা তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করি।’ বিষয়গুলো আমরা আইনশৃংখলা বাহিনীকেও অবহিত করি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- আবুল বাশার একটি বেসরকারি ব্যাংকের বরিশাল শাখার গ্রাহক (এসওডি হিসাব নম্বর- ১১১৭৭৫০০০০০৪১)। তিনি তার ব্যাংক হিসাব থেকে আপন ভাই মুফতি জসিম উদ্দিনকে ১১ লাখ ২৬ হাজার টাকা ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে অপর একটি বেসরকারি ব্যাংকের বরিশাল শাখার হিসাবে জমা করেন। তাছাড়া এফবিআইয়ের তালিকাভুক্ত জঙ্গি নেতা জসিম তার ব্যাংক হিসাবগুলোতে এ আবুল বাশারকে নমিনি হিসেবে মনোনীত করেছেন। হিসাব খোলার ফর্মের নমিনি ডিক্লারেশন অংশে জসিম এবং বাশার আপন ভাই বলে উল্লেখ আছে। আর উভয়ের পিতা নূর মোহাম্মদ এবং মাতার নাম ফজিলাতুন্নেসা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবুল বাশার ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ১২ লাখ টাকা এবং একই সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ১১ লাখ ২৬ হাজার টাকা তার ভাই জসিম উদ্দিনের ব্যাংক হিসাবে জমা করেন। এ ব্যাংক হিসাবে বাশারের এসওডি হিসাবের ঋণসীমা তিন লাখ টাকা। কিন্তু একই শাখায় বাশারের আরও একটি সঞ্চয়ী হিসাব পরিচালিত হলেও সঞ্চয়ী হিসাবে অর্থ জমা না করে এসওডি হিসাবে ঋণসীমার ৪ গুণ অর্থ জমা করার বিষয়টি অস্বাভাবিক প্রতীয়মান হয়েছে। এসওডি হিসাবে ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আরও অর্থ জমার প্রমাণ রয়েছে।
জানা গেছে, জসিম উদ্দিন ১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই বেসরকারি ব্যাংকের বরিশাল শাখায় ৮০ হাজার টাকা জমা দিয়ে একটি হিসাব খোলেন। (সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর-০১০১১২০৯১৮৭)। এ হিসাবে টাকা লেনদেন করেন বাশার। আর জসিমের এ হিসাব খোলার ফর্মে পেশা দেখানো হয় চাকরি। ঠিকানা ব্যবহার করা হয় কাউনিয়া আকন ভিলা জামে মসজিদ। তবে জসিম ওই সময় কি ধরনের চাকরি করতেন তা উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি জামে মসজিদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানাও ছিল না।
গোয়েন্দা অনুসন্ধান সূত্রে গেছে, আবুল বাশারের হাত দিয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে উল্লেখযোগ্য অর্থ প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ট্রাভেল এজেন্ট এরোনেট ইন্টান্যাশনালকে ২৫ লাখ ৫৩ হাজার টাকা, এয়ার ট্রিপ ইন্টারন্যাশনালকে ২৯ লাখ ১৬ হাজার টাকা এবং তানভীর ট্রাভেলসকে ১৬ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। এছাড়া এম সিকিউরিটিজ লিমিটেডে বাশারের ভাই জসিম উদ্দিনের নামে একটি বিও হিসাব ২০০৯ সালের ৭ জুন তারিখে খোলা হয়। যার কোড নম্বর ৫০৬০৮। বিও হিসাবটি খোলার সময় জসিম উদ্দিন বেসরকারি ব্যাংকের বরিশাল শাখার ব্যবস্থাপক কর্তৃক ইস্যুকৃত একটি প্রত্যয়নপত্র জমা দেন। বিও খুলতে তিনি এ শাখার হিসাব নম্বর ০১০১১২০৯১৮৭ ব্যবহার করেন। তদন্তে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের ৭ জুন থেকে ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ ব্যাংকের শাখা থেকে ৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা জমা এবং পরে তা উত্তোলন করা হয়। হিসাবটির লেনদেন বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শেয়ার কেনার জন্য এম সিকিউরিটিজ লিমিটেডের অনুকূলে ২০০৯ সালের ১০ জুন ৪ লাখ টাকা, পরদিন ১১ জুন ১ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। এই বিও হিসাবে ২০০৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরের পর আর কোনো লেনদেন করা হয়নি। আর এসব লেনদেন বাশারের হাতেই হয়েছে।
একইভাবে আইডিএলসিতে মো. জসিম উদ্দিন রাহমানী শিরোনামে হিসাবটি ২০০৭ সালের ২৭ মে তারিখে খোলা হয়। প্রথম শেয়ার কেনার জন্য ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা জমা দেয়া হয়। বেসরকারি ব্যাংকের ধানমণ্ডি শাখা থেকে দুটি চেকের মাধ্যমে শেয়ার ক্রয়ের জন্য আরও ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জমা করা হয়। বিও হিসাবটি জসিম উদ্দিন রাহমানীর হলেও মনোয়ারুল খালেদ নামের জনৈক ব্যক্তিকে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য মনোনীত করা হয়। বাশারের বিশ্বস্ত লোক হলেন খালেদ। এ হিসাব খোলার সময় জসিমের পরিচিতির সমর্থনে বরগুনার ৮ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের ইস্যু করা প্রত্যয়নপত্র ও ব্যাংক হিসেবের সমর্থনে ধানমণ্ডি শাখার প্রত্যয়নপত্র জমা দেয়া ছিল। সর্বশেষ হিসাবটিতে ৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকার শেয়ার ছিল। পরে বাশার এ শেয়ারের অর্থ মনোয়ারের মাধ্যমে উত্তোলন করেন।
তদন্তের সঙ্গে জড়িত সূত্রগুলো জানিয়েছে, আবুল বাশার বিভিন্ন সময় তার ভাই জসিম উদ্দিন রাহমানী পরিচালিত হিসাব থেকে আইডিএলসি সিকিউরিটিজ লিমিটেডের (কোড নং ০৮২২) অনুকূলে ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, এম সিকিউরিটিজ লিমিটেডের অনুকূলে (কোড নং ৫০৬০৮) ২৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা, তাদের পরিচিত হুমায়ুন কবীরকে ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা প্রদান করেন।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ১২ আগস্ট বরগুনায় মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানী সহযোগীসহ গ্রেফতার হন। এদিন তার ভাই আবুল বাশারও গ্রেফতার হন। পরে জামিন লাভের পর বাশার সব ধরনের আর্থিক বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বাশার কারাগারে বন্দি তার ভাই জসিমের সঙ্গে দফায় দফায় সাক্ষাৎ করে ব্লগার হত্যার একটি ছক নিয়ে আসেন। আর ওই ছক অনুযায়ী ব্লগারদের খুন করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিম উদ্দিন কারাগার থেকেও কলকাঠি নাড়ছে। তার নির্দেশনা অনুযায়ী ব্লগার হত্যাসহ অন্যান্য ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, জসিমের ভাই আবুল বাশারও এবিটির নেতা।
আবুল বাশারের পরিবারের দাবি, মে মাসে ঢাকা যাওয়ার পর থেকে বাশারকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে কেউ ধরে নিয়ে গেছে বলে তাদের ধারণা। আর আইনশৃংখলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ‘তাকে খোঁজা হচ্ছে। নজরদারিতে আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে।’
আইনশৃংখলা বাহিনীর দৃষ্টিতে বাশার বর্তমানে পলাতক। তাকে নজরদারির আওতায় আনার চেষ্টা করছে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সদস্যরা। কারাগারে বন্দি তার আপন ভাই নিষিদ্ধ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসিমের সঙ্গে পরামর্শের পর ব্লগার হত্যাকাণ্ডে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। ব্লগার অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় দাশ ছাড়াও ব্লগার নিলয় হত্যার পেছনেও তার জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা।
বাশারের পরিবার, সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আত্মীয়স্বজন সূত্রে জানা গেছে, ২৬ মে আবুল বাশার মাদ্রাসা থেকে ছুটি নেন। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ঢাকায় আসেন। ২৭ মে তাকে রাজধানীর সদরঘাটে একটি কালো গাড়িতে তুলে নেয় সাদা পোশাকের লোকজন। এর কিছুক্ষণ পর তার স্ত্রী মুন্নী ও সন্তানকে সাদা পোশাকের লোকেরা গুলিস্তানে নামিয়ে দেয়। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আতোয়ার রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘বাশার আত্মগোপনও করতে পারেন। কারণ তার বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে। আবুল বাশারের স্ত্রী মুন্নী জানান, ‘তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তিনি আইনশৃংখলা বাহিনীকে বিষয়টি অবগত করেছেন।’
2 0 0 0
- See more at: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৭:৪১