জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে তরুণ নাট্যকার তুষারের একটি নাটক প্রথমবারের মত মঞ্চায়িত হচ্ছে। গল্পের বিষয়বস্তু আধুনিক শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারকে কেন্দ্র করে। যেখানে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হলেন মধ্যবয়সী বাবা।
সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে নাটকটা দেখছে। নাটকের কয়েকটি চরিত্র সবার হৃদয় স্পর্শ করে। নাটকের শেষ পর্যায়ে বাবা চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করা নাজির সাহেব রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। পরিবারের সদস্যদের আর্তচিৎকারে কয়েকজন দর্শকের চোখে অশ্রু জমা হয়।
নাটক শেষে সব চরিত্রের অভিনেতারা একে একে এসে হাসিমুখে মঞ্চে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। সবার করতালিতে হলরুম মুখরিত হয়। নাটকের পরিচালক তুষার সবাইকে ধন্যবাদ জানায়।
এবার যে যার বাড়ি ফিরছে একে একে। রাত প্রায় দশটা বাজে। শহরে গাড়ির চাপ কিছুটা কমে এসেছে। সোডিয়াম বাতির হলদে আলোয় লালখান বাজার থেকে টাইগারপাস যাবার রাস্তা কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। দু’পাশের পাহাড়ের গাছগুলো গভীর অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে।
সিএনজি টেক্সি করে যথারীতি আগ্রাবাদে নিজের বাড়িতে ফিরছেন নাজির সাহেব। বাসা থেকে ইতোমধ্যে কয়েকবার ফোন করেছে তার মেয়ে রাহেলা। হঠাৎ পেছন থেকে দ্রুতগতির এক লরি এসে ধাক্কা দিয়ে টেক্সিকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে। ঘড়িতে সময় দশটা কুঁড়ি মিনিট। নিথর দেহ নিয়ে নাজির সাহেব শুন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন।
ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় নাজির সাহেব। চালক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।
পুলিশি তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু লরির কোন খোঁজ মেলে না। চালকের ভাষ্যমতে সে রিয়ার-ভিউ মিররে বড় এক লরি এগিয়ে আসতে দেখে কিন্তু লালখান বাজার ও টাইগারপাসের সিসিটিভি ক্যামেরা চেক করে ঐ সময়ে কোন লরির দেখা মেলে না। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক ঠেকে সবার কাছে।
পরবর্তীতে সবাই আড়ালে নাট্যকার তুষারের সেই নাটকের সমালোচনা করা শুরু করে। তুষার সাহেব এক প্রকার বাইরে বেরোনোই বন্ধ করে দিয়েছেন। নাটকের মৃত্যুই যেন নাজির সাহেবকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে-সবার এই এক ধারণা।
ঘটনার প্রায় তিন মাস পর রাত ঠিক দশটা বেজে কুঁড়ি মিনিটে নাজির সাহেবের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে মেয়ে রাহেলা দরজা খোলে। দরজায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং নাজির সাহেব। সেই কাঁচাপাকা চুল, থুতনির নিচে অল্প দাড়ি। খুব তাড়াহুড়ায় আছেন যেন। মেয়েকে বললেন, মা, বিশ টাকা ভাংতি দে তো। টেক্সি বিদেয় করতে হবে।
মেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। দৌড়ে ভেতর থেকে মা, ভাই বেরিয়ে আসে। তারাও দেখে হতবাক! নাজির সাহেবের স্ত্রী স্বামীকে দেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। এদিকে নাজির সাহেব বিরক্তিতে নিজেই বাসায় ঢুকে বিশ টাকা ভাংতি নিয়ে টেক্সি বিদেয় করে আসে।
পরদিন লোকজন আশপাশ থেকে ছুটে আসে নাজির সাহেবকে দেখতে। তিনি ইতোমধ্যে পুরো ব্যাপারটা জেনেছেন ছেলের কাছ থেকে। খুব গম্ভীর হয়ে আছেন। বাসায় তেমন কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পুলিশের সহায়তা নেওয়া হয়েছে।
নাজির সাহেবের কাছে ব্যাপারটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। তিনি স্রেফ নাটক শেষে বাসায় ফিরলেন। ফিরেই শোনেন এই কাণ্ড। এ কি করে সম্ভব! তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
এদিকে পুলিশ বসে নেই। তারা কবর খোঁড়ার অনুমতি নিয়েই ছুটেছে কবরস্থানে। কারণ নাজির সাহেব যেহেতু ফিরে এসেছেন তবে তিন মাস আগে যাকে দাফন করা হয়েছে সে কে!
যথারীতি কবরস্থানে কবর খুঁড়ে দেখা গেল কিছুই নেই। আশেপাশে খোঁজ নেওয়া হল যে কবর চুরি হয়েছে কিনা। এমনকি মাটি পরীক্ষা করেও নাজির সাহেবের ডিএনএ মিলল না। বিশেষজ্ঞরা কিছুই কূলকিনারা খুঁজে পেলেন না।
সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলেও নাজির সাহেব শান্তি পাচ্ছেন না। এদিকে নাট্যকার তুষার আবারো নাটক নির্মাণে ফিরলেন। নাজির সাহেব আবারো সিদ্ধান্ত নিলেন একই নাটকে বাবার চরিত্রে অভিনয় করবেন। যেহেতু নাটকটিতে অভিনয় করবার পর এমনটা ঘটল তাই তিনি দেখতে চান ব্যাপারটার পুনরাবৃত্তি ঘটে কিনা।
পরিবার, আত্মীয়স্বজনেরা বারবার নিষেধ করল। তিনি কারো কথার পাত্তাই দিলেন না। তিনি এক প্রকার জেদ করেই নাটকটিতে পুনরায় অভিনয় করলেন। একইভাবে রাত দশটার দিকে তিনি সিএনজি নিলেন। তবে এবার ব্যতিক্রম ঘটল। তিনি আজ একা নন, তার টেক্সির সামনে পেছনে পুলিশের গাড়ি, সাংবাদিকের ক্যামেরা তাক করা গাড়ি, আরো কয়েকটা গাড়ির বহর নিয়ে এগিয়ে চললেন। এবার সিএনজিতে তার সাথে রয়েছে নাট্যকার তুষার সহ আরেকজন ব্যক্তি। গাড়ি ধীরগতিতে চলতে লাগল। যদিও দুর্ঘটনা ঘটার কোন সম্ভাবনাই নেই আজ।
দুর্ঘটনাস্থলে আসার একটু আগে চারপাশে প্রবলভাবে বাতাস শুরু হয়ে গেল। এপ্রিল মাস তাই সন্দেহ নেই এটা কালবৈশাখী ঝড়। আচমকা বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় ল্যাম্পোস্টগুলো নিভে গেল আর সাথে গাড়িগুলোর হেডলাইটও নিভে গেল। মুহূর্তেই চারপাশে ঘোর অন্ধকার নেমে এল। ঝড়ো হাওয়া যেন সব উড়িয়ে নেবে! অনেকে ভয়ে চিৎকার করতে লাগলো। গাড়ি যেন আর এগোয় না। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে কেউ কারো কথা বুঝতে পারছে না। চারপাশে ধুলোর ঝড়।
নাজির সাহেব লাফ দিয়ে ঘুম ভেঙে উঠলেন। সারা দেহ ঘেমে যেন নেয়ে গেছেন।
পানির তৃষ্ণায় তার বুক শুকিয়ে কাঠ। হাত বাড়িয়ে পাশে রাখা ছোট টেবিল থেকে গ্লাসে রাখা পানি খেলেন। স্ত্রী পাশে ঘুমোচ্ছে। তার বুক ধরফর করতে লাগল। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না এটা স্রেফ দুঃস্বপ্ন ছিল। একবার ভাবলেন স্ত্রীকে ডেকে তুলবেন কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তাটা বাতিল করলেন।
রাতে তার আর ঘুম হয় নি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাউকে কিছু না বলে চুপিচুপি তিনি এক্সিডেন্টের জায়গাটায় গেলেন। সেখানে ভাঙা কাচের টুকরো আর জমাট বাঁধা রক্ত দেখতে পেলেন। তা দেখে মনে মনে ভীষণ অস্থিরতাবোধ করলেন। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে সরাসরি কবরস্থানে গেলেন। পৌছে একটা সদ্য কবর দেখতে পেলেন। বারবার ঘাম মুছতে লাগলেন। এরপর ঠিক করলেন কবরটা খুঁড়ে দেখবেন।
বাসায় ফিরে সবার চক্ষুর আড়ালে কোদাল নিয়ে কবরস্থানে ফিরে এলেন। যেহেতু কবরটা রাস্তা থেকে দূরে তাই এখানটায় কবর খুঁড়লেও কেউ দেখতে পাবে না।
তিনি কবর খুঁড়তে লাগলেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেল। কিছুক্ষণ পর তিনি ক্লান্তি অনুভব করলেন। খানিকটা জিরিয়ে ফের খুঁড়তে খুঁড়তে এক সময় তিনি দেখতে পান সাদা কাফনে মোড়ানো একটা লাশ! যেন সদ্য দাফন করা। সাদা কাফনের বিভিন্ন জায়গায় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ।
সে সময়টায় ভয় আর কাজ করছিল না। একটা ভোতা অনুভূতি নিইয়ে তিনি বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলেন।
মনে সায় দিচ্ছে না কাফনের মাথার দিক খুলে মুখটা দেখতে। এভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সাহস করে কাফনের মাথা খুলে ফেললেন। কাপড় সরিয়ে যা দেখতে পেলেন তাতে তার গায়ের সমস্ত লোম খাঁড়া হয়ে গেছে! নিজের চোখকে বিশ্বাস করাটা কঠিন হয়ে পড়েছে!
তিনি নিজ চোখে দেখতে পেলেন স্বয়ং তিনিই লাশ হয়ে শুয়ে আছেন কবরে।