আমরা সাদাকে সাদা দেখি, কালোকে দেখি কালো। তারপরেও আমরা সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে পারি না। এখানে রয়েছে আমাদের মেরুদণ্ডের সমস্যা। কোনো জাতির নৈতিক মেরুদণ্ড শক্ত না হলে শুধু বচন-প্রবচন কিংবা কথামালায় কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধি ও প্রগতি সম্পন্ন হতে পারে না। আজকাল যেন আমাদের বিবেচনা শক্তিও রহিত হয়ে গেছে। কোনো জিনিসের পুরোটা দেখার মত ধৈর্য্য আমাদের নেই। অর্ধসত্য নিয়েই আমাদের যত উল্লম্ফন। অল্প জ্ঞানের ভয়ঙ্কর সব চিত্র আমরা লক্ষ্য করছি। এ বিষয়গুলো এখন আমাদের সমাজের জন্য মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, আইন-কানুন, প্রশাসন, ধর্ম-দর্শন কোনো কিছুই এখন ওই সমস্যার বাইরে নয়। অথচ এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। তবে এজন্য প্রয়োজন সুস্থ ও উদার মনোভাব। বৈশাখ উদযাপনের কথাই ধরা যাক। এখানেও আমরা দু’টা পক্ষ লক্ষ্য করছি। খণ্ডিত চেতনা ও বিভাজনের দৃষ্টিভঙ্গি এখানেও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেয় নি।
পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে আমরা যদি সত্যনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করি, তাহলে ঐকমত্যে পৌঁছা কোনো কঠিন বিষয় নয়। আর যদি নিজেদের খণ্ডিত কিংবা স্বার্থান্ধ চেতনাকে ‘সবার চেতনা’ হিসেবে প্রোপাগাণ্ডা চালিয়ে তা জাতির উপর চাপিয়ে দিতে চাই, তাহলে আমাদের সংকটের মাত্রাই শুধু বাড়বে। এমন পরিবেশে পরস্পরকে নির্মূলের চেতনা ও নির্মূল কমিটির সংখ্যাই শুধু বাড়তে থাকবে। এমন চেতনা নিয়ে আর যাই হোক জাতির উন্নতি ও প্রগতির স্বপ্ন পূরণ হতে পারে না। বর্তমান সময়ের একটা সংকট হলো, আমরা সবাই নিজের বা নিজ ঘরানার চিন্তা-চেতনাকে জাতির-চিন্তা চেতনা বলে প্রোপাগাণ্ডা করে বেড়াই। কিন্তু আসলেই জাতির চিন্তা-চেতনা ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার খবর আমরা কতটুকু রাখি? স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, বাংলাদেশের জনগণ সম্প্রীতির সমাজেই বসবাস করতে চায়। এই জনপদের মানুষের ভাষা ও খাদ্যভ্যাসে যেমন মিল রয়েছে, তেমনি ধর্ম-ভাবনায় রয়েছে আবার পার্থক্য বা বৈচিত্র্য। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ধর্ম ও সংস্কৃতি ভাবনায় স্বাতন্ত্র্যের কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়।
এরপরেও উল্লেখ করতে হয় যে, মিল ও অমিলের নানা বিষয় নিয়েও আমাদের সমাজ হতে পারে শান্তি ও সম্প্রীতির সমাজ। এই জনপদের হাজার বছরের ইতিহাস তেমন সাক্ষ্যই বহন করে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ধর্ম ও সংস্কৃতির মর্মবাণী উপলব্ধি করা। স্বার্থান্ধ ব্যক্তিরা ধর্ম ও সংস্কৃতির মর্মবাণী উপলব্ধির বদলে বরং এর স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্যকে হিংসা-বিদ্বেষ ও বিভক্তি বাড়াতে কাজে লাগায়। প্রসঙ্গত এখানে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছিলেন, “এখন জগৎ জুড়িয়া সমস্যা এই নহে যে, কি করিয়া ভেদ ঘুচাইয়া মিলন হইবে, কিন্তু কি করিয়া ভেদ রক্ষা করিয়া মিলন হইবে সেইটাই বড় কথা। কারণ সেইখানে কোনো ফাঁকি চলে না, বরং প্রত্যেকের জন্য প্রত্যেকের জায়গা ছাড়িয়া দিতে হয়।” আসলে যারা ফাঁকির রাজনীতি করেন, ফাঁকির সংস্কৃতি চর্চা করেন তাদের দ্বারা কোনো জনপদে ঐক্য কিংবা মিলনের সেতুবন্ধন রচনা সম্ভব নয়। কারণ তারা ভেদ-বিভেদ, অনৈক্য ও নির্মূলের গান গাইতেই আনন্দ পান।
তবে বৈশাখ উদযাপন নিয়ে কিছু কথা অবশ্যই বলতে হয়। বৈশাখ আসলে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয় বরং একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। পবিত্র ধর্ম ইসলাম যে কোনো জনপদের সামাজিক অনুষ্ঠানও (উরফ) প্রথা তথা স্থানীয় সংস্কৃতির বিষয়গুলোকে অনুমোদন দেয়, যদি সেখানে মানুষের জন্য ক্ষতিকর কিংবা হারাম কোনো বিষয় না থাকে। বৈশাখের মত অনুষ্ঠানকে ইসলাম ‘উরফ’ হিসেবে বিবেচনা করে। শুধু বৈশাখ কেন, নামাযের মত পবিত্র ইবাদতেও যদি কারো মন্দ মতলব থাকে তাহলে তা ইসলামে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। তাই বলতে হয়, বৈশাখ উদযাপন ইসলামে কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নয়।
বৈশাখের কোনো অনুষ্ঠান তখনই নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হতে পারে; যদি সেখানে শিরক, কুসংস্কার, টোটেম বিশ্বাস কিংবা কোনো মন্দ বা নিষিদ্ধ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইসলাম যা বলেনি তাকে ইসলামের বিষয় বলে যারা প্রচার করেন তারা আসলে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা হারান। আর যারা ভুল বক্তব্যকে গ্রহণ করে ইসলামের ইমেজ বিনষ্ট করার তৎপরতায় যুক্ত হন তাদের মন্দ মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করতে হয়। এদের প্রোপাগান্ডায় যারা বিভ্রান্ত হবেন তাদের দ্বারা দেশ ও জাতির কল্যাণ সম্ভব নয়। যারা ইলাম ধর্মের দর্শন ও শরিয়া সম্পর্কে অবগত আছেন, তারা এ কথা স্পষ্টভাবেই জানেন যে, বৈশাখের স্বাভাবিক ও অনাবিল উৎসবে জড়িত থাকার পরেও ভাল মুসলমান থাকা যায়। আমরা যদি বাংলাদেশকে সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে একই সাথে আমাদের এই জনপদের মানুষের ধর্মভাব ও সংস্কৃতিভাবকে সুসমঞ্জসভাবে বিকশিত করতে হবে। এই সত্য উপলব্ধিতে ভুল হলে আমাদের অভিযাত্রা হয়তো কাঙ্ক্ষিত পথ খুঁজে পাবে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৫:৩৩