
মুক্তিযুদ্ধ—এই একটি শব্দই যেন আমাদের জাতির রক্ত, কান্না, আর গৌরবের প্রতীক। সেই মুক্তিযুদ্ধের নির্মম দিনগুলো, শহীদদের আত্মবলিদান, আর এক মায়ের হৃদয়ের গভীর আর্তনাদ আমি প্রথম অনুভব করেছিলাম একটি বইয়ের মাধ্যমে— জাহানারা ইমামের “৭১-এর দিনগুলো।”
এটি শুধু একটি বই নয়, এটি এক মায়ের বেদনাভরা আত্মজার্নাল, এক জাতির মুক্তির সংগ্রামের অগ্নিগাথা।
গ্রামীণ শীতের এক সকালে, আমার এক প্রিয় সিনিয়র বন্ধু বইটি হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পাতার পর পাতা উল্টে যেতে যেতে মনে হয়েছিল, আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সেই রক্তাক্ত দিনগুলো— পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আগুনে পুড়ে যাওয়া গ্রাম, রক্তে ভেজা নদীর জল, নির্যাতিত মায়েদের হাহাকার, আর স্বপ্নময় তরুণদের শহীদ হয়ে যাওয়া। প্রতিটি শব্দ যেন দগ্ধ ইতিহাস, প্রতিটি বাক্য যেন গুলির শব্দ, বোমার বিস্ফোরণ, এবং মা-বোনের নিঃশেষ কান্না।
জাহানারা ইমামের লেখনীতে আমি বুঝতে পেরেছিলাম— কেন মুক্তিযুদ্ধ ছিল অনিবার্য।
এই জাতি বঞ্চিত ছিল, নিপীড়িত ছিল, অথচ কখনো হার মানেনি।
যে বাঙালী যুগে যুগে শোষণের বিরুদ্ধে লড়েছে, সেই বাঙালী ১৯৭১ সালে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ করেছে। আর সেই মুক্তির যুদ্ধের পেছনে এক অজেয় প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন জাহানারা ইমাম— এক মা, এক যোদ্ধা, এক সাহসী নারী।
তার সন্তান রুমি— তরুণ, উদ্দীপ্ত, মেধাবী। যখন মাতৃভূমির টান অনুভব করলেন, তখন তিনি নিজের জীবনের সবটুকু উৎসর্গ করলেন দেশের জন্য।
জাহানারা ইমাম, একজন মা হয়েও, দেশমাতৃকার মুক্তির তাগিদে সেই প্রাণপ্রিয় সন্তানকে উৎসর্গ করেছিলেন।
তার কণ্ঠে সেই মর্মস্পর্শী বাক্য—
“যা তোকে দেশের জন্য কোরবানি দিলাম”—
আমার হৃদয়ে যেন আগুনের মতো দগ্ধ করে।
এই একটি বাক্যই বলে দেয় মাতৃত্ব কতোটা মহিমান্বিত হতে পারে, যখন তা দেশের প্রতি ভালোবাসার সঙ্গে মিশে যায়।
রুমি শহীদ হলেন, জাহানারা ইমামের স্বামীও অল্পদিনের মধ্যে চলে গেলেন— তবু তিনি ভেঙে পড়লেন না। বরং তিনি তার শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করলেন। সেই শক্তির সূত্র ধরেই জন্ম নিল ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি শুরু করলেন নতুন এক আন্দোলন— যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে।
জনতার আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচার করে তিনি দেখিয়ে দিলেন— ন্যায়বিচার বন্ধ করা যায় না, চেতনা মুছে ফেলা যায় না।
আমি যখন বইটি শেষ করি, তখন মনে হয়েছিল— আমি যেন ইতিহাসের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে গেছি। “৭১-এর দিনগুলো” শুধু আমার জানা নয়, আমার অনুভব হয়ে গেছে। আমি যেন রুমির চোখ দিয়ে যুদ্ধ দেখেছি, জাহানারা ইমামের বুকের ব্যথা অনুভব করেছি, আর একাত্তরের বাংলার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে শুনেছি স্বাধীনতার শ্লোগান—
“জয় বাংলা।”
এই বইটি আমাকে শিখিয়েছে— দেশপ্রেম কেবল মুখের বুলি নয়, এটি ত্যাগের নাম।
আমার ভিতর এক নতুন আলোর সঞ্চার হয়েছিল। আমি উপলব্ধি করেছি, মুক্তিযুদ্ধ কোনো অতীত নয়— এটি এক চলমান চেতনা, এক অমর দায়বদ্ধতা।
“৭১-এর দিনগুলো” আমার হৃদয়ে চিরদিনের জন্য এক বাতিঘর হয়ে থাকবে— যে বাতিঘর আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, এই স্বাধীনতা রক্তের বিনিময়ে পাওয়া, তাই এর মর্যাদা রক্ষা করাই আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




