সকালটা কেমন যেন এলোমেলো ঠেকছে।ভোররাতে ঘুম ভাঙ্গার পরে সাধারণত পানি খেতে ইচ্ছা করে গলাটা শুকিয়ে থাকে বলে, বরাবরের মত ফজরের আযান শুনতে পাওয়ার কথা। অথচ আজ কিছুই হচ্ছেনা। গ্রামের গভীর রাতের নিরবতা বিরাজ করেছে। দ্বিধান্বিত হয়ে চোখ খুললেন মোহাব্বত আলী, আর তখনই দেয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং করে জানান দিল রাত তিনটা বাজে। দেয়ালে ঝুলন্ত বিজলি বাতি, দেয়াল ঘড়ি ও দেয়াল দেখে মোহাব্বত আলী অত্যান্ত আচার্য হলেন। কারণ, উনার বাড়ীতে এর কোনটাই নাই। তাহলে আমি কোথাই শুয়ে আছি ভাবতে ভাবতে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। মাথাটা কেমন যেন শুন্য শুন্য লাগছে।এই চার দেয়ালের মাঝে তিনি কিভাবে এলেন তা কিছুতেই মনে করতে পারলেন না।
বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাব্বত আলির একমাত্র ছেলে সজল পরছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছেলে ও তার মায়ের অনেক অনুরোধে তিনি এই প্রথম ঢাকা এলেন। মোহাব্বত আলির খুবই খারাপ ধরনের একটা মাথা ব্যাথা আছে। জেলা শহরের ডাক্তাররা ব্যর্থ হয়েছেন উনার এই তীব্র যন্ত্রণা দূর করতে, এবং পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকায় গিয়ে বড় কোনও ডাক্তার দেখাতে। একজন স্কুল শিক্ষক হিসাবে যে সম্মানি পান তা দিয়ে সংসার চালানই কঠিন, তার উপর ছেলের পড়ালেখার খরচ বহন করতে পারেন না। অবশ্য মেধাবী ছেলে ঢাকাতে ২ টি প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচ চালাই বলে কিছুটা শান্তি। এমতাবস্থাই ঢাকার ডাক্তারের কাছে যাওয়া বিলাসিতার শামিল মনে করে তিনি এতদিন রাজি হননি। স্ত্রীকে বারবার বলেছেন আর মাত্র এক বছর পরে ছেলের পড়ালেখা শেষ হলে চাকরি পাবে, তখন তিনি ঢাকা যাবেন। কিন্তু তিব্র ব্যাথার কাছে হারমেনে ঢাকা এলেন।
দুই দিন আগে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে বাপ আর ছেলে গিয়েছেলেন জাদুঘর ঘুরতে। ফেরার পথে হোটেলে দুপরের খাবার খেলেন। খাবারটা ছিল অত্যান্ত সুস্বাদু, এই ব্যাতিক্রম ধর্মী খাবার টা এর আগে তিনি খাননি। আস্ত মুরগিটাকে যন্ত্রের মধ্যে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরাইয়া তৈরি করে নাম দিছে গ্রিল। প্রথমে খেতে একটু সন্দেহ থাকলেও পরে বুজতে পারলেন সুস্বাদু বটে। মুরগীর গ্রিল খবার সময় তিনি মনে মনে ভাবলেন, ছেলে চাকুরি পাওয়ার পরে স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে এসে এই খাবার খাওয়াবেন।
আজ test report দেয়ার কথা। মোহাব্বত আলী চিন্তিত মুখে বসে আছেন ছাত্রাবাসের ঝুল বারান্দাই। ছেলে ক্লাশ শেষ করে test report আনার জন্য সরাসরি চলে যাবে ক্লিনিকে। গতকাল থেকে বিরোধী দল সরকার পতনের আন্দলেন ডাক দিয়েছে। এর মাঝে কয়েকটা যাত্রীবাহী চলন্ত বাসে আগুন দিয়েছে। সরকার পতনের আন্দলন বলে কথা, যেনতেন ভাবে আন্দলন করলে চলবে না। ভাবমূর্তি যাই হোক না কেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সাথে জনসাধারণের জীবন যাত্রা অচল করে দিতে হবে। তা হলেই সরকার পতন ঘটবে। রাজনৈতিক নেতাদের এইধরনের অসুস্থ ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে যোহরের নামায আদায় করতে গেলেন। সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করতেই সজলের দুই বন্ধু বলছে, চাচা চলেন একটু বাহিরে যেতে হবে।
মোহাব্বত আলী বললেন কোথায়? কেন?
কাজ আছে চাচা তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
কিন্তু আমিতো ছেলেকে ছাড়া যেতে পারবোনা।
আপনার ছেলেই বলেছে আপনাকে নিয়ে যেতে।
ঠিক আছে চল।
অনিশ্চতার মাঝে ছেলে দুইটির সাথে চলেছেন তিনি। কেও কোনও কথা বলছে না। রিকসা এসে থামল ঢাকা মেডিক্যালের সামনে। ও বাবারা তোমারা আমারে এইখানে নিয়া আইছ কেন? আমিতো ডাক্তার দেখালাম প্রাইভেট ক্লিনিকে, অন্য কথাও। সমস্যা নাই চাচা আপনি সাথে আসেন। দেখতে দেখতে মোহাব্বত আলিরা একটা ওয়ার্ড এর সামনে এসে দাঁড়ালেন। চামড়াপুড়া উৎকট গন্ধে পেটের নাড়ি ভুঁড়ি উলটে আসার মত অবস্থা। মোহাব্বত আলী লক্ষ্য করলেন এইটা বার্ন ইউনিট। মানুষের কান্নায় চারপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। ডাক্তার ও সেবিকারা ছোটাছুটি করছেন রোগীর সেবা করার জন্য। কিন্তু মানুষের ভীরে তাদের অবস্থা খারাপ। এর মাঝে একটা ছেলে মোহাব্বত আলিকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মোহাব্বত আলিকে দাড়াতে হল সাদা কাপর দিয়ে ঢাকা একটা বেড এর সামনে।
সাজলের দুই বন্ধুর সাথে লাশবাহী গাড়ীতে যাত্রাশুরু করলেন মোহাব্বত আলী।নিজ গ্রামের উদ্দেশ্যা। মহাখালী ফ্লাইওভারের উপর গাড়ী, নীরবতা ভাঙলেন মোহাব্বত আলী। সুদৃঢ় কণ্ঠে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন গাড়ীটাকে গুলশান নিয়ে যেতে। একটা সুপার সপ থেকে ৫ লিটার তেল, ৫ কেজি লবণ, এক ডজন করে কাটা চামুচ ও ছুরি কিনলেন। গাড়ী নিয়ে দাঁড়ালেন প্রধান বিরোধীদলীয়ও নেত্রীর বাসার সামনে। আপসহীন নেত্রি, এই বাংলার আপামর জনতার নেত্রি,, যিনি বর্তমান স্বৈরাচার সরকারের হাত থেকে গনতন্ত্র উদ্ধারের দায়িত্ব নিজ কাধে তুলে নিয়েছে, তিনি ঘর থেকে বেরহয়ে এলেন এক সন্তানহারা বাবাকে সান্ত্বনা দিতে। চারদিকে সাংবাদিকরা ক্যামেরা তাক করে আছে, এর মাঝেই মোহাব্বত আলী বলতে শুরু করলেন। মাননীয় নেত্রি আমি আপনার সাথে একমত, জনগনের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচিত সরকার কখনও ক্ষমতায় থাকা উচিত না, এবং ফুলবাগান তৈরি করতে গেলে দুই একটা কেঁচো মারা পরতেই পারে। কিন্তু, মাননীয় নেত্রি- আগুনে পুড়া এই বিকৃত মনুষ্য গ্রিল লইয়া আমি কি করিব? তাই আমার আর্জি, এই মনুষ্য গ্রিলটাকে আপনি ও আপনার দলের নেতারা যদি ভাগ করে খেতেন, তাহলে আমি আনন্দিত হইতাম। এই মনুষ্য গ্রিলটা হয়ত আপনাদের প্রাণশক্তি বৃদ্দি করবে। মাননীয় নেত্রি অত্যান্ত বিরক্ত হইয়া বললেন, এই কে আছিস পাগলটাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দে।
টেলেভিশনে মোহাব্বত আলির এই কর্ম দেখে প্রধানমন্ত্রী অত্তান্ত আনন্দ অনুভুব করতে না করতেই মোহাব্বত আলী হাজির হলেন। জননেত্রি, গনতন্ত্রের মানসকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছুটে এলেন সন্তান হারা বাবাকে সান্ত্বনা দিতে। মহাব্বত আলী বলতে শুরু করলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সাজানো নির্বাচনে সংবিধান রক্ষার নামে আপনি যেভাবে ক্ষমতা দখল করে আছেন তাতে আমার কিছু যাই-আসেনা। কিন্তু, মাননীয় নেত্রি- আগুনে পুড়া এই বিকৃত মনুষ্য গ্রিল লইয়া আমি কি করিব? তাই আমার আর্জি, এই মনুষ্য গ্রিলটাকে আপনি ও আপনার দলের নেতারা যদি ভাগ করে খেতেন, তাহলে আমি আনন্দিত হইতাম। এই মনুষ্য গ্রিলটা হয়ত আপনাদের প্রাণশক্তি বৃদ্দি করবে। প্রধানমন্ত্রী অত্যান্ত বরিক্ত হয়ে মোহাব্বত আলিকে গলা ধাক্কা পূর্বক তার নির্বাচিত এলাকার এমপি’র খোজ করতে লাগলেন।
মোহাব্বত আলী আর একবার ব্যার্থচেষ্টা করলেন উঠে বসতে। শাররিক ভাবে নড়াচড়া করতে ব্যার্থ মোহাব্বত আলী অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন দুই ঘর পরে ঘুমন্ত একজন মানুষকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন। আর একটু যাওয়ার পরে প্রধান সড়কের পাশেই বর্তমান এমপি’ সুন্দর বাড়ী। বাড়ির ভিতর থেকে টেলেভিশনের শব্দ ভেসে আসছে। সকাল সাতটার সংবাদ শুরু হল। মোহাব্বত আলী সংবাদ দেখার জন্য ঘরে প্রবেশ করলেন। বর্তমান এমপি সহ আরও চারজন লোক বসে আছে, মনে হল তারা উনাকে খেয়াল করেননি। প্রধান সংবাদ “ ঢাকা থেকে ছেলের লাশ নিয়ে ফেরার পথে ট্রাক দুর্ঘটনাই মোহাব্বত আলী মারা গেছেন।” এমপি সাহেব মোবাইলে কথা বলছেন। মেডাম কি ঘুম থেকে উঠছে?......ঠিক আছে, ঘুম থেকে উঠলে আমার কথা বইলেন যে, মোহাব্বত আলী কেও তার ছেলের কাছে পাঠাইয়া দিছি। মোহাব্বত আলী এইবার বুঝতে পারলেন যে তিনি একটা মৃত মানুষ।
একজন বাবার কাছে পৃথিবীর সবচে ভারী বোঝা সন্থানের লাশ। সেই লাশ নিয়া এক একা ফিরছেলেন। ফাঁকা রাস্তা, দ্রুত গতিতে চলছে গাড়ী। পথে পথে পুলিশের চেকপোস্ট। নিজ জেলার প্রবেশ পথে রয়েছে নারদ নদী। নারদ নদীর সেতু পার হওয়ার সময় একটা ট্রাকের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




