পয়লা বৈশাখ এলেই আমরা বাঙালীরা একদিনের জন্য যেন খাঁটি বাঙালী হয়ে যাই। বৈশাখী পোশাক, বৈশাখী মেলা, বৈশাখী গান, বৈশাখী হাওয়ায় এবং খাওয়ায় আমরা সবাই মাতোয়ারা হয়ে যাই। ঢাকার রমনা বটমূলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়া দেশের সর্বত্রই পয়লা বৈশাখের নানা আমেজ পরিলক্ষিত হয়। রমনার বটমূলের অনুষ্ঠান তো ঐতিহাসিক। এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়েও একসাথে সবাই সমবেত হয়। ছেলে-মেয়ে, আবাল-বৃদ্ধার বর্ণিল পোশাকে চারদিক উজ্জ¦ল হয়ে ওঠে। মনের আনন্দে সবাই যেন একদিনের জন্যে বাঙালী হয়ে যায়। কথাটা বলার উদ্দেশ্য হলো যে, শুধু একদিনের জন্য এই মহামিলনে বাঙালীর বৈশাখের ঐতিহ্য রক্ষা হয় না। আমাদেরকে মনে-প্রাণে বাঙালী হতে হবে এবং আমাদের কাজ-কর্মেও তা প্রতিফলিত হতে হবে। দুঃখের বিষয় সেটা আমাদের জীবনে অনুপস্থিত এবং কর্মজীবনে অবিকশিত।
এই নিবন্ধক প্রায় তিনশত তরুণ-তরুণীর উপর বাংলার এই ঐতিহ্যময় মাসটির উপর একটা সমীক্ষা চালিয়েছিলো গত বছরের প্রথমদিকে। এরা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি ধারী। পেশাজীবনে সবেমাত্র পা দিয়েছে। এদেরকে আকস্মিকভাবে বৈশাখ মাসের তারিখ জিজ্ঞেস করেছিলাম পয়লা বৈশাখ পালনের কয়েকদিন পরে। মাত্র দুজন প্রশিক্ষণার্থী সঠিক বাংলা মাসের তারিখটি বলতে পেরেছিলো। শতকরা হিসেবে ১%ও নয়। অথচ বৈশাখের প্রথমদিনে পায়জামা-পাঞ্জাবী পরে মাটির সানকিতে পান্তা-ইলিশ খেতে ভুলেনি। বাঙালী হয়ে আমরা বাংলা মাসের তারিখ বলতে পারি না। অথচ আড়াইশ বছর ইংরেজদের শাসনে থেকে ইংরেজী মাসের তারিখ একেবারে নখ-দর্পণে। এটা সত্যিই লজ্জাকর ব্যাপার। বাংলাদেশে বাঙালী বাংলা মাসের দিন-ক্ষণ বলতে পারবে না এটা কি কখনও ভাবা যায়? এমন কি কোন মাস কতদিনের তাও অনেকে বলতে পারে না। বাঙালীর এই দৈন্যতা সত্যি দুঃখজনক। ইংরেজী তারিখের সাথে সাথে বাংলা মাসের তারিখও জানা একান্ত প্রয়োজন। স্কুল-কলেজে বাঙালীর এই ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি বাধ্যতামূলকভাবে জানাবার ব্যবস্থা থাকা দরকার। এর চর্চা একান্ত আবশ্যক। বিষয়টি সরকার ভাবতে পারে।
বাংলাদেশে প্রয়াত ডক্টর মো: শহিদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত বাংলা পঞ্জিকা কমিটি যে বাংলার দিন-পঞ্জি তৈরি করেছেন এবং সরকার কর্তৃক গৃহিত হয়েছে তা খুবই বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবমুখী। যতদূর মনে পড়ে এই কমিটিতে ছিলেন পন্ডিত শতীশ চন্দ্র শিরোমনি এবং পণ্ডিত তারাপদ ভট্টাচার্য। পাকিস্তান আমলেই বাংলার এই দিনপঞ্জি তৈরি হয়। কিন্তু তৎকালীন শাসক এটার বাস্তবায়ন বন্ধ রাখে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই বিজ্ঞানভিত্তিক দিনপঞ্জির কার্যকারিতা শুরু হয়। দুঃখের বিষয়, বেশির ভাগ বাঙালীই এই দিন-পঞ্জির কথা বলতে পারবে না। অথচ পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, ৯ জৈষ্ঠ্য ঠিকই পালন করা হয়। পালনের এক সপ্তাহ পরে আকস্মিক- ভাবে যদি বাংলা মাসটির তারিখ জিজ্ঞেস করা হয় তা বলতে সরকারি আমলাদের তাদের দপ্তরে টানানো ক্যালেন্ডারের প্রতি নজর দিতে হবে। তাই বলছিলাম যে, হাজার বছর বাঙালী হয়েও বাংলা মাসের তারিখ বলতে পারি না। অথচ আড়াইশ বছর ইংরেজ শাসকদের অধীনে থেকে ইংরেজী মাস ও তারিখ ঠোঁটস্থ হয়ে গেছে।
দীর্ঘ সায়ত্রিশ বছর পার হয়ে গেল আমরা স্বাধীন হয়েছি। অথচ বাংলা মাসের তারিখ আমরা নিশ্চিত হয়েও বলতে পারি না। এই “না পারাটা” বন্ধের জন্য এখন থেকেই বাংলা চর্চা একান্ত আবশ্যক। ইংরেজীর সাথে সাথে বাংলা মাসের চর্চাও আবশ্যকীয় করা উচিত। অবশ্যি সরকারি দপ্তরে ইংরেজী ও বাংলা মাসের দুটো তারিখই লিখিত হয়। যাঁরা লিখেন তারা কিন্তু ইংরেজীর মতো মন থেকে লিখেন না, দপ্তরের রোজ-নামচা দেখে চিঠিতে তারিখটা বসান। এর পরিসমাপ্তি দরকার।
আশা করিসবাই সচেতন হবেন।