মা কি জিনিস, মা যাদের বেঁচে আছেন হয়ত তারা উপলদ্ধি করবেন না, যাদের মা বেঁচে নেই তারাই আঁচ করতে পারবেন মা আসলে কি। পৃথিবীতে একমাত্র প্রাণী মা, যে নিজ সন্তানদের জন্য জীবন উৎসর্গ করে।তাই বিশ্বের বিখ্যাত কবি লেখকরা মাকে নিয়ে অনেক কবিতা, গল্প কাহিনী লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং বলেছেন, “মাতৃত্বেই সকল মায়া মমতা ও ভালোবাসার শুরু এবং শেষ।” শুধু তাই নয় বিভিন্ন ধর্মেও মাকে আলাদা মূল্যায়ন করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, তোমার রব আদেশ করেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত কর না এবং মাতা-পিতার সংগে সদ্ব্যব্যহার কর তাদের মধ্যে কেউ বা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশাই বার্ধ্যকে উপনীত হন, তবে তাদের সাথে ভদ্র ব্যবহার কর এবং (বিরক্ত হয়ে) তাদের প্রতি উহ্ শব্দটি পর্যন্ত কর না। (আল-কোরান, সুরা বনী ঈসরাইল)। মায়ের পাদদেশে সন্তানের বেহেস্ত কথাটা অতীব মূল্যবান।
মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সৃষ্টি করেছেন এক অদ্ভুদ এবং বিস্ময়কর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ডাক্তাররা এই রহস্যজনক প্রক্রিয়ার উপর লেখাপড়া করতে করতে অনেক সময় বিহ্বল চিত্তে ভাবেন কি সাংঘাতিক ব্যাপার! প্রাণীর পেটের ভিতর আর এক প্রাণীর জন্ম। বিন্দু থেকে সৃস্টি, বিন্দুর আকৃতি গঠন, আকৃতির পরিবর্তন হাড্ডি মাংসের সংযোজন প্রাণের স্পন্দন, সাপ্তাহিক দৈহিক আবর্তন, ক্রমশ মানবিক আকার ধারণ ইত্যাদি ছোট্ট একটা জায়গার ভিতর-সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে! সৃষ্টিকর্তার অদৃশ্য হাতের স্পর্শে কি ঘটে যাচ্ছে মায়ের শরীরের ভেতর, স্বয়ং মাও টের পান না। তবে শেষের দিকে মা বুঝতে পারেন। সেই ছোট্ট প্রাণীটি যখন পৃথিবীতে আসার জন্য তড়িঘড়ি করে তখন মায়ের কি অবস্থা দাঁড়ায়, একমাত্র মা-ই উপলব্ধি করেন। মা তখন জন্ম ও মৃত্যুর মুখোমুখি হন। অনেক মা বাচ্চা ভূমিষ্ঠের সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। গ্রামগঞ্জে প্রায় মায়েরা মৃত্যুবরণ করেন। অনেক সময় দেখা যায়, দুজনের ভিতর একজনের মৃত্যু হয় আবার কখনোবা উভয়ই মৃত্যুবরণ করেন। তাই সন্তানের জন্ম মায়ের জন্য একটা কঠিন পরীক্ষা জীবন-মরণ সমস্যা।
আমি আজকে সেই মায়ের কথাই বলব। আমি মায়ের ৬ষ্ঠ সন্তান। মা আমাকে খুব আদার করতেন আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, আমি ভূমিষ্ঠ হই একটি দাঁত নিয়ে। সেই তুলতুলে নরম দাঁতটা দেখে বলেছিলেন আমার এই ছেলে একদিন অনেক বড় হবে। শোনা যায় আমাকে (শিশু) দেখার জন্য (দাঁত নিয়ে জন্ম) অনেক লোকের সমাগম হয়েছিল। ভূমিষ্ঠের পর বেশ কিছু দিন পর্যন্ত আমার সবচেয়ে বড় বোন আমাকে দেখা শোনা করেছিলেন, কারণ আমার ভূমিষ্ঠের পরেই আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমার বয়স যখন ৭/৮ বছর। আমি প্রায় সময় আম্মাকে জন্ম নিয়ে বিব্রতকর প্রশ্ন করতাম। একদিন আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম আম্মা আজকে তোমাকে বলতে হবে তুমি আমাকে কেমনে পেলে? আমি কোত্থেকে এসেছি? কি ভাবে আমি দুনিয়াতে আসলাম? ইত্যাদি। কিন' মা আমাকে প্রায় সময় এড়িয়ে যেতেন আমার প্রশ্নের ভয়ে। এটা ওটা নানা কথা বলতেন। আমি বিশ্বাস করতাম না। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলতেন তোকে পেয়েছি এক গভীর জঙ্গলে। সেকি-সাংঘাতিক-আমি বললাম। আর একদিন বললেন, আল্লাহকে বলতে বলতে একদিন তিনি টপ করে আকাশ থেকে তোকে আমার কোলে ফেলে দিয়েছিল। আমি আম্মাকে বললাম এত উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। অথচ আমি ব্যথা পেলাম না, এটা কি করে সম্ভব? আম্মা বলল, তুই বড় হলে বুঝতে পারবি। আমার মা অনেক কিছু জানেন যা আমি জানি না।
ছোটবেলা থেকে আম্মা আমাকে কোর-আন শরিফ পড়া, নামাজ পড়া শিখিয়েছেন। ফজরের নামাজ না পড়লে কোন দিন সকালে নাস্তা দিতেন না। মা আমার খুব কড়া ছিলেন। ছোটকালে আমি আম্মার সাথে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েছি। আম্মার খুব শখ ছিল আমি আরবি পড়ি, মাদ্রাসায় লেখাপড়া করি, বড় মওলানা হই, বিরাট বুজুর্গ হই। আম্মা প্রায় সময় বলতেন, আমি আল্লাহকে কি জবাব দেব যখন তিনি জিজ্ঞেস করবেন, তোমাকে এতগুলো সন্তান দিয়েছি আমার রাস্তায় একটি ছেলেকেও দেওনাই কেন? আমি আম্মাকে বলতাম, তুমি আব্বার দোষ দিও। উনি তার ছেলেদেরকে আরবি লাইনে পড়তে না দিলে তুমি কেমনে দেবে, আম্মা আমার কথায় খুশি হতে পারতেন না শুধু আফসোস করতেন।
আমরা নয় ভাই বোন, ছোটকালে প্রায় সময় আমরা একে অপরের সাথে ছোট-ছোট কারণে ঝগড়া করতাম। আম্মা আমাদের বিচার করতেন। অবশ্য আমি আম্মাকে সাহায্য সহযোগিতা করতাম। ভাই বোনদের মধ্যে ঝগড়া ঝাটি নিস্পন্ন করার কাজে আমি আম্মার বিশেষ সাহায্যকারী ছিলাম। যেমন-প্রহারের জন্য লাঠি বা বেত জোগাড় করা, ফুলের ঝাড় সংগ্রহ করা, নানা ভাবে সাক্ষী দেয়া। ভাই-বোনদের ছোটখাটো বিচারের সময় আম্মা আমাকে ডাকতেন, আমি মার পায়ের কাছে মাটিতে বসে যেতাম। তবে আম্মা যাতে ন্যায় বিচার করেন তার দিকে খেয়াল রাখতাম। আব্বা গ্রামে দীর্ঘদিন (প্রায় ৩৫ বছর) ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৬১ সনে ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ যখন চট্টগ্রাম এসেছিলেন তখন আমার জেঠা জনাব ও আর নিজাম চট্টগ্রাম পৌরসভা চেয়ারম্যান হিসাবে তাঁকে অভ্যার্থনা জানিয়েছিলেন। আমি তখন ৫ম শ্রেণীর ছাত্র হয়ে ঐ অনুষ্ঠানে অনেক পিছনে বসা ছিলাম।
মেট্রিক পরীক্ষার পর আমি ২/৩ দিনের জন্য (শুধু মাকে বলে) উদাও হয়ে গিয়েছিলাম। এদিকে আব্বা ও আমার ভাইয়েরা পাগলের মতো আমাকে খুঁজতে শুরু করে হাসপাতালে লঞ্চঘাটে, পুলিশ ফাঁড়িতে কিন' আম্মার নৃর্লিপ্ততা সবাইকে সন্দেহের মধ্যে ফেলে। আমি আম্মাকে খুশি করার জন্য আরবি পড়তে গিয়েছিলাম, কিন্তু তিন দিনের বেশি থাকতে পারিনি। চলে আসি এবং আব্বা ও বড় ভাইয়ের উত্তম-মধ্যম ও বকুনি খেয়ে বেশ কয়েকদিন চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। সেদিনের কথা মনে পড়লে এখন আমি খুব মজা পাই। ছোটকালে এত দুষ্টুমি করেছি, আম্মাকে কত যাতনা দিয়েছি কিন' তিনি উহ্ও করেননি।
১৯৭০ সাল ঘটনা চক্রে আমি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে অফিসার পদে মনোনীত হই এবং প্রথম ছ’ মাস মিলিটারি প্রশিক্ষণের জন্য কাবুল (উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেই। মা আমাকে কিছুতেই পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে দেবেন না। কারণ আম্মার ধারণা তারা আমাকে মেরে ফেলবে। তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) তখন তুমুল গণআন্দোলন শুরু হয়। মা আমাকে বললেন তুই যাসনে। দেশ ভাগ হয়ে যাবে। তুই এখানে থাক। তোকে তারা মেরে ফেলবে। আমি আম্মাকে বললাম, মা তুমি আমাকে দোয়া কর যেন আমাকে ওরা মেরে ফেলতে না পারে। মায়ের দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয়, তুমি আমাকে নিয়ে অযথা চিন্তা করবে না। আমাকে হাসি মুখে বিদায় দাও। মা আমাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিদায় দিলেন। আমি ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করার জন্য চলে গেলাম পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা খুব মনে পড়ত। ইচ্ছা হতো যদি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারতাম। প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশের জন্য দৈহিক যুদ্ধ করতে পারিনি তবে নামাজে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি যেন হানাদারদের কাছ থেকে দেশ ত্বরিত স্বাধীন হয়। আমি পাকিস্তানে বন্দি শিবিরে বাইশ মাস আটক ছিলাম। মায়ের ছেলে মায়ের কাছে ফিরে এলো মা আমাকে দেখে কেঁদে উঠল হায়রে আমার ছেলে শুকিয়ে দড়ির মতো হয়ে গেছে। ওরা ছেলেকে কিছুই খেতে দেইনি নিশ্চয়। আমি আম্মাকে বল্লাম মা তুমি দেখছো না তোমার ছেলে বেশ মোটা হয়েছে। মা আমার কথা কিছুই শুনলেন না।
বাংলাদেশ নেভীতে সত্তর দশকের প্রথম দিকে আমাকে এনলিস্ট করা হলো। আম্মার দোয়া নিয়ে কোচিনে (ভারত) গেলাম বাকী প্রশিক্ষণ শেষ করার জন্য। চাকরির বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নভাবে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে ও মায়ের আশীর্বাদে প্রায় সময় প্রতিকূল অবস্থান অনুকূলে চলে আসতো। একবার টেনিস ফাইনাল খেলায় (১৯৮৯ সনে) শুধুমাত্র দুই মিনিট দেরি হয়েছিল কর্তৃপক্ষ আমাকে অন্যায়ভাবে ডিমোশন দিতে চেয়েছিল। কিন্তু শুধুমাত্র আমার মায়ের দোয়াই সেই দিন চরম লজ্জা এবং অবমাননা থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। ১৯৯১ সনের ঘূর্ণিঝড়ে এবং ১৯৯৩ সনের বন্দর টিলা ঘটনায়ও বেশ কয়েকজন অফিসার চাকরি হারান। সর্বশেষ ২০০২ সনে আরোও কিছু সিনিয়র অফিসার বাধ্যতামূলক অবসরে যান। কিন্তু এসব ঘটনায় আমি পরম করুণাময় আল্লাহর রহমতে বেঁচে যাই শুধুমাত্র আমার মায়ের দোয়ার জন্য। মা বাবার দোয়া কতবড় জিনিস আমি হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছি।আমার আফসোস আজকে আমার আব্বা আম্মা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে তারা কতনা খুশি হতেন; তারা জানেন না তাদের সন্তান বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েও শেষ পর্যন্ত চাকরির শীর্ষ অবস্থানে পৌছাতে সক্ষম হন।
১৯৯৯ সালে আম্মা খুবই অসুস্থ। চট্টগ্রামে নেভীর হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। মাঝে মাঝে বেহুশ হয়ে যান। দীর্ঘ দিনে বহুমূত্র রোগে আম্মা কাহিল হয়ে গিয়েছিলেন। এক দুপুর বেলা আমি দেখার জন্য জাহাজ থেকে সরাসরি আম্মার কেবিনে যাই। আমি কেবিনে প্রবেশের সাথে সাথে আম্মা চোখ খুলে আমার দিকে তাকালেন। অন্যের সাহায্য ছাড়া শোয়া অবস্থায়ও আম্মা নড়াচড়া করতে পারেন না। আমি বুঝতে পারছিলাম আম্মার খুব কষ্ট হচ্ছে তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন তোর প্রমোশন কবে হবে। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, মা তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো, তুমি দোয়া করলে নিশ্চয় আমার প্রমোশন হবে ইনশাল্লাহ। আম্মা শোয়া অবস্থায় আমার জন্য দোয়া করলেন। দোয়া করার পনের দিন পর ১১ জুলাই ১৯৯৯ দুপুর সাড়ে তিনটায় আমাদের প্রিয় আম্মুজান পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চিরতরে চলে যান।
যে মা মৃত্যুর কাছাকাছি এসে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে মা-ই চিন্তা করছে ছেলের কথা। ছেলের ভবিষ্যতের কথা। পৃথিবীতে কে আছে মৃত্যুর বিছানায় শোয়া অবস্থায় সন্তানের কথা ভাবার। সে আর কেউ নয়, সে হচ্ছে মা, আমার মা সকলের মা। পৃথিবীর সব মা শুধু একটাই চিন্তা করে-তাঁর ছেলেমেয়েদের কথা। তাই যাদের মা এখনো বেঁচে আছে তাদের প্রতি আমার একটি মাত্র অনুরোধ-আপনারা মায়ের সেবা করুন, দোয়া নিন। তিনি একমাত্র নিশর্ত ব্যক্তি যে বিনিময়ে আপনার কাছ থেকে কিছুই চাইবে না। আজকে মা দিবসে আমার আম্মার কথা ভীষণভাবে মনে পড়ছে। আমি দোয়া করছি মহান আল্লাহ পাক আমার আম্মাকে জান্নাতবাসী করেন। সকল মাকে জান্নাতবাসী করেন। আমিন !