(বিশেষ দ্রষ্টাব্দঃ কাহিনী আরও দীর্ঘ ও বিস্তৃত করার ইচ্ছে
ছিল। কিন্তু তার জন্যে দীর্ঘ সময় কই.... প্রথম প্রথম সাধারন
লেখার মত গল্পটা শুরু হলেও শেষ করেছি খুবই দরদ লাগিয়ে।)
.
কি-বোর্ডের উপর যে পোকাটা দীর্ঘ সময় ধরে বসে আছে
তার লেজ ধরেও একটা গল্প শুরু হতে পারে। গল্পের শুরু হতে
পারে আমার হাতের তর্জুনির কাটা দাগটা থেকেও। আমার
মোবাইলের ব্যাক কভারে যে সীমটা অব্যবহৃতভাবে অনেক
দিন ধরে পরে আছে তারও একটা জুতসই রোমাঞ্চকর গল্প
আছে। এটা দিয়ে বহুদিন একটা মেয়ের সাথে কথা বলে একটা
রোমান্টিক সময় পার করেছি। যে কি না ছিল আমার
প্রানপ্রিয় বন্ধুর তিন নাম্বার গার্লফ্রেন্ড।
.
অবাক হচ্ছেন? হবারই কথা।
আমার অতি প্রানপ্রিয় বন্ধু রাত দেড়টার সময় ফোন করে
প্রবল আকুতি নিয়ে বলল, “দোস্ত, প্লিজ একটা কাজ করে
দে”।
“এই শেষ রাতে কিসের কাজ?”
বন্ধু বিরক্ত হয়ে বলল, “উহু, এখন কিছুই করতে হবে না। শুধু বলে
রাখছি, ভাল দিন দেখে শুরু করলেই হবে।”
“আচ্ছা বল”।
তারপর শুরু করল ওর চরম দুঃখের কথা। কারো বন্ধু হিসেবে যখন
নিজেকে আবিস্কার করতে শুরু করলাম তখন থেকেই বুঝতে শুরু
করলাম, দুঃখের কথা শোনার জন্যেই বন্ধু। আমি মন দিয়ে ওর
কথা শুনছি।
.
সে আমাকে কেঁদে-টেঁদে, চোখ-নাকের জল এক করে যে
কথাগুলো বলল, তার সারসক্ষেপ শোনাচ্ছি। বিস্তারিত
বলতে গেলে রাত ফুরিয়ে ভোর হয়ে যাবে তবু কাহিনী শেষ
হবে না।
.
ওর একেকটা দুঃখের কাহিনী যেন একেকটা ট্রাজিডি ভরা
উপন্যাস। যার প্রতিটা অধ্যায়ে থাকবে, দেয়ালে বালিশ
চেপে মাথা ফাঁটানোর হাড়খাটুনে ব্যর্থ চেষ্টা করে অবিকৃত
মাথার মত। দুঃখে-কষ্টে যতই ভিতরে ভিতরে ফাটতে থাকুক
কোনভাবেই তার পিছু ছাড়ে না। বলতে পারেন অসীম দুঃখ।
ভালভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য একটু পিছনে ফিরে তাকাতে
হবে। উহু আমার পিছনে নয়। সময় পরিভ্রমন করে কল্পনার
দিগন্ত অতীতে নিয়ে যেতে হবে।
.
আমরা তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। রিফাত বলল, আজকে
বিকেলে সার্কিট হাউজের সামনে আসতে পারবি?
‘কেন?’ আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।
‘রিমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব’।
রিমা! অবাক হয়ে বললাম, রিমা কে?
“ঐ তো, বুঝিস না? আমার ইয়ে।”
.
রিমা ওর দুই নাম্বার প্রেমিকা। প্রথমজনের সাথে কিভাবে
ব্রেক আপ হয়েছিল আমার জানা নেই, তবে দুই নাম্বারের
সাথে সম্পর্ক ভাঙ্গার পর যা হয়েছিল তা বলতে গেলে
রীতিমত ইতিহাস। অল টাইম দৌড়ের উপর থাকতে হয়েছে।
মেয়ে ছিল এক্সট্রা ড্যান্জারাস। ড্যান্জারাসগীরির একটা
সাদাসিদে নমুনা দেই। একবার বিকেল বেলা কোথা থেকে
ঝাকানাকা টাইপ কিছু ছেলেপেলে এসে রিফাতকে সাচ্চা
গর্দভ বানিয়ে ফাঁকা কমনরুমে নিয়ে যে বিরল দৃশ্যের ভিডিও
করল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সিনিয়র ফ্রেন্ড সূত্রে
জানতে পেরেছিলাম, ছেলেগুলোর মধ্যে একজন ছিল ঐ
মেয়ের বর্তমান প্রেমিক। সে তার ফ্রেন্ডদের নিয়ে এই ঘৃন্য
কাজের জন্ম দিয়েছিল।
.
এই ঘটনার পর, রাগে ক্ষোভে দুঃখে রিফাত পুরাকালের
সিনেমার নায়কদের মত ভুলটা করেই বসছিল। তার মনের
চিৎকার আমার কান পর্যন্ত চলে আসে। ফোন করে প্রথম এবং
শেষবারের মত আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। ভাগ্যিস
ক্ষমা চাওয়ার জন্যে ফোন করেছিল। তা না হলে কখনো
জানতামই না সে আত্মহত্যা করার সব জোগার-যন্ত্র করে
ফেলেছে। ফ্যানের সাথে দড়ি বাঁধা হয়েছে। এখন শুধু
চেয়ারের উপর দাড়িয়ে দড়ি গলায় ঢুকিয়ে ঝুলুক্কা দিলেই
খেল খতম। কষ্ট যাতে দীর্ঘস্থায়ী না হয়, দ্রুত মরতে পারে
সে জন্য ফ্যানের সুইচ খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছে। সুইচ অন
করে দিলে ফ্যানও ঘুরতে থাকতে সেও ঘুরতে থাকবে।
তারাতারি মৃত্যু হবে। মৃত্যু যত তারাতারি কষ্ট তত কম হবে।
.
সেদিন যদি ও আমাকে ফোন না করত তাহলে এই তিন নাম্বার
গার্লফ্রেন্ডের মুখ আর তার দেখা হত না। আর বলতে পারত
না, “দোস্ত এই মাইয়ারে তো পিছই ছাড়াইতে পারতেছি না।
বিরক্তিকর। ওর মুখটাও আজকাল দেখতে ইচ্ছা করে না।
দেখতে অবিকল পেঁচা। স্বভাবেও চেহারায়ও। সারারাইত
জাইগা থাকবে, আর স্কাইপে ওর পেঁচা মুখ প্রদর্শন করবে”।
.
এই পর্যন্ত এসে গলা করুন করে বলল, “দোস্ত তুই কিছু একটা
কর। আমি আর এই মাইয়ারে নিয়া পারমু না। যতই ওকে ছাইড়া
দেয়ার কথা ভাবি পিছনের ইতিহাসগুলা মনে পড়ে”।
কাছে থাকলে নির্ঘাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলত।
“তার মানে তুই বলতেছিস, আমি ওর সাথে প্রেম করি।”
রিফাতের কন্ঠে উৎফুল্লতার ছাঁপ লক্ষ করলাম,
‘এক্স্যাক্টলি! তুই-ই প্রেম করবি এবং তোর দাড়াই সম্ভব। তুই-ই
পারবি আমাকে বাঁচাতে।”
“ধুর চিনি না, জানি না একটা মেয়ের সাথে কেমনে প্রেম
করব। আর আমার এইসবে কোন এক্সপেরিয়েন্স নাই, মাইয়ারে
হ্যান্ডেল করমু কেমনে?”।
“কেমনে করবি মানে? ফোনে করবি। আমি তোরে নাম্বার
দিতেছি। নে, খাতায় লেখ”। দুদিন আগেও ওর কাছে নাম্বার
চেয়ে চেয়ে হয়রান হয়ে গেছি। তখন দেয় নাই। আর এখন সেধে
সেধে দিচ্ছে। “শুধু একবার ওকে পিছু ছাড়া, আর কিছু করতে
বলব না।”
“দ্যাখ দোস্ত, তারপরও ব্যাপারটা কেমন কেমন না। না হয়
ফোনেই প্রেম করলাম, তবুও তো, চিনি না, জানি না, কখনো
দেখিও নাই...”
“ও.., তুই ওর চেহারার কথা বলতেছিস?” আমি এক কথা বলতে
চাইনি। “সে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। অতি সুন্দরী
মেয়ে। দেখলে তোর পছন্দ হয়ে যাবে।”
.
অবাক হয়ে গেলাম ওর কথা শুনে। কিছুক্ষন আগে যে ছিল
‘পেঁচা মুখো’ এখন সে মহা সুন্দরী। কিছুক্ষন পর হয়ত স্বর্গের
অস্পরির সাথে তুলনা করতে শুরু করবে।
“আচ্ছা দেখি।”
“দেখি দেখি করিস না ভাই। আমি এত পেইন নিতে পারমু
না।”... আরো অনেক সময় ধরে আমাদের মধ্যে এ নিয়ে
কথাবার্তা চলল, ফজরের আজান পর্যন্ত। ফোনটা কেটেও
দিতে পারলাম না। মানুষ মানুষের জন্যে, ফ্রেন্ড ফ্রেন্ডের
জন্যে।
.
২
মেয়েটার নাম ইয়েশিম। প্রেমিকার নাম হিসেবে
রোমান্টিক নয়। তারপরও এই নামটা আমার মধ্যে মধু বর্ষন
করতে শুরু করল। প্রথম প্রেমানুভূতি উপভোগ করা শুরু করলাম।
যদিও এটা মিথ্যে, সাজানো। তারপরও খুব দরদ দিয়ে ওর
সাথে মিশে যেতে হয়। নয়ত কোনভাবেই রিফাতের সঙ্গ
ছাড়ানো যাবে না।
.
প্রথম প্রথম আমাদের মধ্যে অল্প অল্প কথা হলেও একটা সময়
বিরতিহীন ভাবে কথা চলতে থাকে। তার সে কি কন্ঠ।
কিসের সাথে এর তুলনা করব। প্রতিটা শব্দ, বৃষ্টির জলকনার
টুপটাপ ধ্বনির মত মগজে লেগে যায়। গানের গলাও অতুলনীয়।
একজন রাবীন্দ্রিক প্রেমিকা। সে যখন সুর করে শোনায়,
‘আমারো পরানো যাহা চায়...’ তখন আমার পরানে কি যে চায়
তা ব্যাখ্যা করে বুঝানো যাবে না। একধরনের গভীর শূন্যতায়
বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে।
.
রিফাত যে ওকে এড়িয়ে চলছে সেটা ওর মুখ থেকেই শুনলাম।
প্রেম বলতে ওদের মধ্যে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। যা আছে, তা
আর যাই বলা যাক প্রেম বলে বড় করা যায় না। তার এই
নিঃসঙ্গ সময়ে সাপোর্ট হিসেবে আমাকে পেয়ে সে খুবই
কৃতজ্ঞ।
.
ব্রেক আপ করার ব্যাপারে রিফাত যে ভয়টা পাচ্ছিল,
ইয়েশিমের সাথে কথা বলে, ওকে বুঝে আমার মনে হয় না
ওদের সম্পর্কচ্ছেদ হলে মিস রিমার মত সেও রিফাতের উপর
প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠবে। চাইলেই ব্রেক আপ করে
ফেলতে পারত। এত কাহিনী করার প্রয়োজন ছিল না।
.
ইয়েশিম একজন অসাধারন মেয়ে। তাকে প্রকাশ করার জন্যে
এই মুহূর্তে যে কয়টা বিশেষন ব্যবহার করা যায় তা হল, অতি
ভাল মেয়ে, সুকন্ঠি ও একজন রাবীন্দ্রিক প্রেমিকা। রিফাত
কেন ওকে ছেড়ে দিতে চাইছে সে ব্যাপারে আমি বিশেষ
কোন কারন খুঁজে পাই না।
৩
তারপর অনেক দিন পর, আরো অনেকদিন পর..
আমাদের দেখা হল।
তাকে দেখে আমি মুগ্ধ।, আমি অবিভুত। আমার কাছে উপমার
ভান্ডার নেই বললেই চলে। নয়ত এতক্ষনে তার সৌন্দর্যের
একটা রাজকীয় উপস্থাপনা করে ফেলতাম।
তার চাহনী দেখে মনে হল, আমার হনুমুখ দেখে সেও মুগ্ধ।
.
আমরা পাশাপাশি হাটছি, একই পথ বৃত্তাকারে বারবার
ঘুরছি। তবু আমাদের কথা শেষ হয় না, পথ শেষ হয় না।
.
আমি ইয়েশীমের মুখের দিকে তাকিয়ে যে গানের চরণগুলো
মনের মধ্যে আওড়ে যাচ্ছি তা আপনাদের এতক্ষনে বুঝে
ফেলার কথা। রাস্তায় হেটে চলা অসংখ্য মানুষ হয়ত জানেই
না আমি এই শ্বেতকায় শুভ্র মানবীর হাস্সোজ্জ্বল মুখের
দিকে তাকিয়ে গেয়ে যাচ্ছি, “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে
কেমন হত, তুমি বলত?”
............
পরিশেষেঃ
ইয়েশীমের একটা নতুন নাম দিয়েছি। ওর নামটা আমার পছন্দ
না সেটা ওকে বলেছি। ও স্বানন্দে আমার দেয়া নাম গ্রহন
করেছে। আমি ওকে আদর করে ডাকি, নায়ীরা। এই নামের
কোন অর্থ নেই। ওর সাথে পরিচয় হওয়ার আগ থেকেই আমার
মন মগজ জুড়ে এক কাল্পনিক রমনী ঘুরে বেড়াত। তার নাম
দিয়েছিলাম, নায়ীরা। নায়ীরা কল্পনা থেকে বাস্তব জগতে
নেমে এসেছে। এখন ওকে এ নামটা দেয়াই যায়।
.
নায়ীরা ঘুমাচ্ছে। পাশেই টেবিলে বসে কি-বোর্ডে ঠকঠক
শব্দ করে লিখে যাচ্ছি। ও কোন রকম ডিস্টার্ব অনুভব করছে
না। মাঝে মাঝে হয়ত শব্দে জেগে ওঠে,তখন পাশ চেন্জ করে
আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এইমাত্র সে আবার জেগে উঠেছে। বা
পাশে মাথা দিয়ে আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। আমার
এখান থেকে ওর মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি লেখা বন্ধ
করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। কি মায়াবী মুখ। এর
সাথে কোন কিছুর তুলনা হয়। তুষারশুভ্র পাহাড়ের উপর যেন
মসৃন কেশগুচ্ছ মেঘ হয়ে বারবার বাতাসের ঝাপ্টায় মুখের উপর
আছড়ে পড়ছে। কি অপূর্ব। সত্যিই কি অপূর্ব।
.
আমি বরাবরের মতই ওর মুখের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে
আছি। এই ঘুম আর কোন ভাবেই ভাঙ্গানো যাবে না....