somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ নাৎসিদের উত্থান(৪র্থ পর্ব) "এই রিভলভারে ৪টা গুলি আছে, ৩টা আপনাদের জন্যে, আর একটা আমার নিজের জন্যে।"

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এটি একটি মেগা পোস্ট। নাৎসিদের উত্থান পর্বে, এরকম উত্তেজনাপুর্ণ ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। এক পোস্টেই পুরো ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

----------------------------------------------------------------------------------



৯ নভেম্বর, ১৯২৩ সাল।

বাভারিয়ান সরকার কর্তৃক প্রদত্ত নোটিশ।

"কয়েকজন উগ্রমানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তির ছলচাতুরি এবং বিশ্বাসঘাতকতার কারণে, বার্গার-ব্রকলার(Bürgerbräukeller) বীয়ার হলের সভা পুরোপুরি পন্ড হয়েছে। বন্দুকের নলের মুখে, কর্নেল সাইসার(Hans Ritter von Seisser), জেনারেল লসো(Otto von Lossow) এবং আমার কাছ থেকে, তারা যে সব দাবি-দাওয়া আদায় করে নিয়েছে, আমি আমার নিজ ক্ষমতাবলে তা বাতিল ঘোষণা করছি। সেই সাথে, রাষ্ট্রদ্রোহ এবং অন্যান্য বিশৃঙ্খলামূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকবার দায়ে, আজ থেকে, "ন্যাশনাল সোশিয়ালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স্‌ পার্টি"(National Socialist German Workers Party) সংক্ষেপে নাৎসি পার্টিকে, সম্পুর্ণরূপে অবৈধ ঘোষণা করা হল।
-গুস্তাভ রিটার ভন কাহ্‌র(Gustav Ritter von Kahr)
ডেপুটি কমিশনার অফ বাভারিয়া।


***

ল্যান্সবার্গ কারাগার।

১৯২৪ সালের কোন এক বিকালবেলা।

"হেই আইখহার্ট, বল না, বিশেষ বন্দীটি কে?", ভিনসেন্ট হালকা অনুনয়ের সুরে জানতে চাইল।

"অদ্ভুত গোফের লোকটার কথা বলছ?"

"হ্যা হ্যা, তুমি চেন নাকি তাকে?", ভিনসেন্ট বলল।

"না, ব্যক্তিগতভাবে চিনি না", বলল আইখহার্ট, "তবে নাম জানি, অ্যাডলফ হিটলার। রাজনৈতিক বন্দী।"

ভিনসেন্ট জিজ্ঞেস করল, "কি কারণে এখানে এসেছে, জানতে পেরেছ কিছু? আমি শুনেছি যে, যারা নতুন এসেছে, সকলেই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় হেরে গিয়েছে, ঘটনা সত্যি নাকি?"

"হ্যা, সত্যি।", ভিনসেন্টের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল আইখহার্ট। তার প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। ভিনসেন্টের সাথে কথা বলতে তার খুব একটা ইচ্ছা করছে না।

"একটা সিগারেট দাও তো ভিনসেন্ট। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। খিদেটা নষ্ট করা উচিত।", আইখহার্ট বলল।

নিজের পকেট থেকে দুটো সিগারেট বের করল ভিনসেন্ট। একটা আইখহার্টকে দিল। আরেকটা নিজে ধরালো।

"আর কিছু জানতে পেরেছ?" সিগারেটে টান দিতে দিতে আইখহার্টকে জিজ্ঞেস করে ভিনসেন্ট।

"হুম। ৮ মাসের জন্যে তিনি এই কারাগারে আছেন। এরপর মুক্তি।",আইখহার্ট বলল।

ভিনসেন্ট অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "৮ মাস!! কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহের শাস্তি তো যাবজ্জীবন হওয়ার কথা!!?"

"হ্যা, কিন্তু তার ক্ষেত্রে আলাদা। প্রথমে সাজা হয়েছিল ৫ বছরের। কিন্তু দন্ডপ্রাপ্তির পর তিনি জনগণের কাছে কিছু কথা বলার জন্যে আবেদন করেন। এরপরের ঘটনা পুরটাই ইতিহাস। চার চারটে ঘন্টা টানা কথা বলে যান তিনি। তার সাথে আরো যে সব বন্দী এসেছে তারা বলেছে যে, চার ঘণ্টার বক্তৃতায় বিচারক পর্যন্ত আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল।", সিগারেটে টান দিতে দিতে একটানা বলে যেতে লাগল আইখহার্ট, এই অংশটা মানুষের কাছে বলতে তার ভালই লাগে।

"বুঝলে ভিনসেন্ট", আইখহার্ট বিজ্ঞের মত বলল, "বিচারক পরে অনেক চিন্তাভাবনা আর সলাপরামর্শ করে, তার শাস্তি কমিয়ে আট মাসে নিয়ে আনল।"

****

১৯২০ সালের কোন এক সকাল।

পত্রিকা পড়ে অথবা রেডিও শুনে, জার্মান জনগণ একটি বিশেষ চুক্তি সম্পর্কে জানতে পেরেছে। চুক্তির নাম ভারসাই চুক্তি । চুক্তির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানার পরপরই, জনগণের পক্ষ থেকে নিন্দার ঝড় উঠেছে। সকলে তীব্র ভাষায় চুক্তির প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তাদের মনে ক্ষোভ, কারণ এতদিন তারা এই মানহানিকর এবং সর্বনাশা চুক্তি সম্পর্কে কিছুই জানত না।

জার্মান জনগণ ভেবেছিল, ১ম বিশ্বযুদ্ধে তারা সম্মানজনকভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু তাদেরকে এরূপ নিকৃষ্ট ও সর্বস্বহরণকারী চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছে, তারা তা জানত না। চুক্তিতে বলা হয়েছে, যুদ্ধের সমগ্র ক্ষতিপূরণ দিতে হবে জার্মানিকে। কত বড় অপমান! একজন জার্মান তা মেনে নিবেই বা কেন? তারপর, চুক্তি অনুযায়ী জার্মানির অনেক ভুখন্ড, মিত্রপক্ষ বগলদাবা করে নিয়ে গিয়েছে। সেখানে অবস্থানকারী জার্মান ভাইদের কি হবে? তারা আজ জার্মান হয়ে জার্মানির অংশ নয়।

চুক্তি সম্পর্কে জানার পরপরই, জার্মান জনগণ চিন্তায় পড়ে গেল। অতঃপর, চা এর কাপে ঝড় উঠল। চুক্তি সাক্ষরের জন্যে দায়ী শয়তানটা কে? প্রতিটি আলোচনার শেষে দেখা যায় যে, জনগণ চুক্তি সাক্ষরের জন্যে ততকালীন গণতান্ত্রিক সরকারকে, তথা WEIMAR REPUBLICকে দায়ী করছে। জার্মানদের প্রিয় কাইজারকে সরিয়ে, এই গণতান্ত্রিক দলটি ক্ষমতায় এসেছে। তার উপর এই ঘৃণিত চুক্তি তো তারাই সই করেছে। সব দোষ তো তাদেরই। জার্মানরা বলতে লাগল, এই চুক্তিতে সই করার চেয়ে, মৃত্যুই ঢের ভাল ছিল।

ভারসাই চুক্তিপত্র।

****

১৯২০ আর ১৯২১, এই দুটো বছর, গণতান্ত্রিক সরকার মোটামোটি ভালভাবে পার করে দেয়। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে ১৯২৩ সালে। ১৯২৩ সালে, জার্মানি ১ম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে ফ্রান্স, জোড়পুর্বক জার্মানির রুড়্‌(ruhr) অঞ্চল দখল করে নেয়। এখন, চট্রগ্রাম ছাড়া যেমন সমগ্র বাংলাদেশ অচল, ঠিক তেমনি ভাবে, রূড় অঞ্চল ছাড়া, ততকালীন জার্মানি প্রায় অচল ছিল। কেননা ততকালীন সময়ে, রুড় অঞ্চলে, জার্মানির অধিকাংশ শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছিল।

রুড় দখল হয়ে যাওয়ার কারণে, জার্মানি তার উৎপাদনশীলতা হারিয়ে ফেলে। ফলশ্রুতিতে, গোটা দেশ অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যায়।

এটা হল, জার্মান ১বিলিয়ন মার্কের নোট। ১৯২৩ সালের অক্টোবরে প্রথম এসেছিল। এটা দিয়ে ৩টা ডিম কিনতে পাওয়া যেত।

আর এটা হল জার্মান ১০০বিলিয়ন মার্ক এর নোট। প্রথম আসে ১৯২৩ সালের নভেম্বরের ১ তারিখ। ১ তারিখ এটি দিয়ে ৩ পাউন্ড মাংশ কিনতে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ১৫ তারিখে এসে, এটি দিয়ে কেবল মাত্র দুই বোতল
বিয়ার ছাড়া আর কিছুই কিনা সম্ভব হয়নি।

১ম বিশ্বযুদ্ধের আগে, এক জার্মান মার্ক ছিল চার মার্কিন ডলারের সমতুল্য।

কিন্তু যুদ্ধের পর ১৯২৩ সালের শুরুতে ১৮,০০০ জার্মান মার্কের বিনিময় মুল্য দাড়ায় এক মার্কিন ডলার।

১৯২৩ সালের জুলাইে তা হয় ৩,৫০,০০০ জার্মান মার্ক।

১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে তা হয় ১০লাখ জার্মান মার্ক।

পরবর্তীতে, অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এই সংখ্যা ট্রিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়।

এই তীব্র আর্থিক সংকটে পড়ে জাতি মূহ্যমান হয়ে উঠে। তারা সংকট উত্তরণের কোনো পথ খুজে পায় না। আর সংকট উত্তরণের কোন পথ খুজে না পেয়ে, তারা তাদের সমস্ত ক্ষোভ সরকারের উপর ঝেড়ে দেয়।

****

কিন্তু, এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। গণতান্ত্রিক WEIMAR REPUBLIC সরকার কি প্রকৃতই দোষী? নাকি তারা পরিস্থিতির শিকার? বলির পাঠা?

১ম বিশ্বযুদ্ধের পর, স্বার্থলোভী ফ্রান্স এবং ব্রিটেন, ভারসাই চুক্তি স্বাক্ষরের জন্যে জার্মানির টুঁটি চেপে ধরে। জার্মানিকে ভয় লাগানো হয় এই বলে যে, চুক্তি স্বাক্ষর না করলে সর্বাত্নক আক্রমণ করা হবে। সেই সময়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, জার্মান সেনাবাহিনীর অনেক ক্ষমতা ও প্রভাব ছিল। কিন্তু তারা চুক্তি স্বাক্ষর করতে অপারগতা জানায়। কারণ তারা জানত, চুক্তি স্বাক্ষরকারী সংঘটনটি, এক দিন না একদিন পুরো জাতির চক্ষুশূল হবে। ফলে তাদের পতন ঘটবে। এই কারণে, নিজের চামড়া বাঁচানোর চিন্তায় মশগুল সেনাবাহিনী, কোনভাবেই চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়নি।

ফলে স্বাভাবিকভাবে, চুক্তি স্বাক্ষরের দায়িত্ব এসে পড়ে ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকারের উপর।

কিন্তু সরকারও প্রথমে চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি ছিল না। ফ্রান্স, ব্রিটেন যদি সর্বাত্মক আক্রমণ করে, তবে তা রুখবার মত ক্ষমতা সেনাবাহিনীর কাছে আছে কিনা, এই সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর কাছে জানতে চাওয়া হয়। সেনাবাহিনীর উত্তর যে "না" হবে, তা সরকারের অনুমিতই ছিল। এসব কারণে গণতান্ত্রিক সরকার নিরুপায় হয়ে, ভারসাই চুক্তিতে সই করে। এবং এভাবেই, অগ্রযাত্রার শুরুতে তারা তাদের অপমৃত্যু নিশ্চিত করে।

****

WEIMAR REPUBLIC সরকারের আরেকটি ত্রুটি হল, তারা সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিল। জার্মান সেনাবাহিনীর ক্ষমতার মূল কাঠামো ছিল পুরোনো ধাঁচের। রাজতন্ত্রের সময়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ মেনে নেওয়া গেলেও, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে তা মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু WEIMAR REPUBLIC সরকার সেনাবাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে ব্যর্থ হয়। যার কারণে, পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ঠেকানো যায়নি।

****

১৯২৩ সাল।

এতদিনে নাৎসি পার্টি একটি সুগঠিত রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। সদস্যসংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। এছাড়া অর্থনৈতিকভাবেও তেমন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। এটি মুলত সম্ভব হয়েছে, পার্টির নেতা অ্যাডলফ হিটলারের বাগ্মিতার কারণে। তার বক্তৃতা শুনতে অনেকেই আসেন, এবং তারা যথাসাধ্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে যান।

এছাড়া, হিটলারের জীবনেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। ১৯১৯ সালের সেই একাকী জীবনকে তিনি পিছনে ফেলে এসেছেন। এখন তার অনেক বন্ধু, অনেক সহচর। নাৎসি পার্টিতেও অনেক করিৎকর্মা ব্যক্তি যোগ দিয়েছেন। যেমন হেরমান গোয়েরিং(Herrman Goering), রুডলফ হেস(rudolf hess). হিটলার তাদেরকে অন্ধের মত বিশ্বাস করেন।

হেরমান গোয়েরিং

রুডলফ হেস।

১৯২৩ সালের এই সংকটময় মুহুর্তে, হিটলার কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ভেবে দেখলেন যে, জার্মানিতে গণতন্ত্র অচ্ছুত হয়ে পড়েছে। ক্ষমতা দখল করার এখনই সময়। পার্শ্ববর্তী দেশ ইতালিতে, মুসোলিনি, ফ্যাসিস্ট সরকার কায়েম করেছে। মুসোলিনি তার বাহিনী নিয়ে, রাজধানীতে কুচকাওয়াজ করে প্রবেশ করেন, এবং অস্ত্রের মুখে ক্ষমতা দখল করেন। হিটলারেরও খায়েশ হল, এই পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখল করার।

কিন্তু জার্মানি এবং ইতালি সম্পুর্ন ভিন্ন দুটি দেশ। মুসোলিনি যা অনায়াসে করতে পেরেছিলেন, হিটলার তা নাও করতে পারেন। হিটলারের তা জানা ছিল।

অনেক চিন্তাভাবনা করে তিনি এক মহা পরিকল্পনা করেন

****

১৯২৩ সাল, ৯ নভেম্বর।

রাত।

বার্গার-ব্রকলার(Bürgerbräukeller) নামক বীয়ার হলে, ৩ হাজার মানুষের এক বিশাল সভার আয়োজন করা হয়েছে। সভায় উপস্থিত থাকবেন, বাভারিয়ার ডেপুটি কমিশনার, গুস্তাভ রিটার ভন কাহ্‌র(Gustav Ritter von Kahr), কর্নেল সাইসার(Hans Ritter von Seisser), জেনারেল লসো(Otto von Lossow)।

রাত ৯টার মধ্যে, সমগ্র বীয়ার হল লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। লোকজন, বিয়ারের গ্লাস হাতে নিয়ে, কেউ দাড়িয়ে, কেউবা বসে, অতিথিদের বক্তৃতা শুনবেন। মানুষ ভেবেছিল, এটা অন্য যে কোনদিনের সভার মত একটি সাধারণ সভা হতে যাচ্ছে। কিন্তু তারা জানত না তাদের জন্যে কি অপেক্ষা করছে।

****

সভা আরম্ভ হবার আধ ঘন্টা পড়ে, বীয়ার হলে হঠাৎ করে একদল খাকি পোশাক পরিহিত অস্ত্রধারী সৈন্যদল প্রবেশ করে। তারা সব দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়, এবং এমনভাবে অবস্থান নেয়, যাতে কেউ পালাতে না পারে। জনগণ বুঝতে পারে, এরা নাৎসি পার্টির সিকিউরিটি শাখা S.Aএর লোকজন। লোকজন আরও অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, বীয়ার হলের দ্বিতীয় তলায়, কয়েকজন S.A, মেশিন গান নিয়ে অবস্থান নিয়েছে।

কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেল। লোকজন দেখতে পেল, সেই অদ্ভুত গোফওয়ালা লোক, যিনি আবার ওই দলের প্রধান, রিভলভার হাতে প্রবেশ করছেন। লোকজন তার নাম জানে। তার আগমনে চারিদিকে শোরগোল পড়ে গেল।

হিটলার হট্টগোল থামাতে একটি ফাকা গুলি ছুড়লেন। হট্টগোল থেমে গেলে, তিনি বলে উঠলেন, "সব খেল খতম। জাতীয় বিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছে। আপনারা ধৈর্য ধরুন। কেউ চলে যাবেন না। রাইখ সরকারকে সড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং সমস্ত আর্মি ব্যারাক এবং পুলিশ ফাঁড়ি আমাদের দখলে। আজ সমগ্র সেনাবাহিনী এবং পুলিশ, এক নাৎসি স্বস্তিকার নিচে সমবেত হয়েছে।"

হিটলারের শেষ দুটি বাক্য ছিল ডাহা মিত্থ্যা। কিন্তু কারো পক্ষে সত্যতা যাচাই করা সম্ভব ছিল না। ফলে সবাই তা সত্য হিসেবেই ধরে নেয়।
এছাড়া হিটলারের এই কথা শুনে মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারা গণতান্ত্রিক Weimar Republic সরকারবিরোধী শ্লোগান দিতে থাকে। হিটলার মনে মনে খুশী হন, কারণ সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে।

এরপর হিটলার, ডেপুটি কমিশনার কাহ্‌র(Gustav Ritter von Kahr), কর্নেল সাইসার(Hans Ritter von Seisser), জেনারেল লসো(Otto von Lossow)কে, অস্ত্রের মুখে জোড় করে পাশের একটি রুমে নিয়ে যান।

সেখানে হিটলার তাদের বলেন যে, গণতন্ত্র শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন তার দল কুচকাওয়াজ করে ক্ষমতা দখল করবে। আর্মি এবং পুলিশ তার দখলে(মিথ্যা কথা)। তিনি এই তিনজনকে, তার দলে যোগ দেওয়ার আদেশ দেন। বিনিময়ে, নতুন সরকার গঠনের পর, তাদেরকে উচু পদ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়।

অতঃপর, হিটলার তাদেরকে চিন্তা করার সময় দিয়ে বের হয়ে আসেন এবং লোকজনকে তার দলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন।

তিনি চিৎকার করে বলে উঠেন, "ভিতরের রুমে ডেপুটি কমিশনার কাহ্‌র(Gustav Ritter von Kahr), কর্নেল সাইসার(Hans Ritter von Seisser), জেনারেল লসো(Otto von Lossow) আছেন। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। আপনারা তাদের সাহায্য করুন। হে লোকসকল, বলুন, আপনারা আমার পাশে আছেন কিনা??"

তখন চারদিক থেকে বিকট শব্দে ধ্বনিত হয়, "আছি আছি।"

হিটলার তখন বিজয়ীর বেশে বলে উঠেন, "আমাদের কোন আত্মস্বার্থ নেই। শুধু আছে একটাই রক্ত শপথ, তা হল, দুর্জোগের এই ঘনঘটায় প্রিয় পিতৃভূমির জন্যে কিছু একটা করা।"

হিটলার আরও বলেন, "শুনুন, হে লোকসকল। হয় আজকে আমাদের বিজয় হবে, নয়তূবা কাল সকালের মধ্যেই আমরা মারা পড়ব।"

কিন্তু অন্যদিকে, অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছিল। ওই তিন জন ব্যক্তি সহজে দমবার পাত্র নন। হিটলার কোনোভাবেই তাদের রাজি করাতে পারছিলেন না।

শেষ চেষ্টা হিসেবে, তিনি তার রিভলভার বের করেন, এবং বলেন উঠেন, "এই রিভলভারে চারটা গুলি আছে, ৩টা আপনাদের জন্যে, আর একটা আমার নিজের জন্যে। আজকেই সব কিছুর নিষ্পত্তি হবে। হয় আপনারা আমার কথায় রাজি হবেন নয়ত মৃত্যুর জন্যে তৈরি থাকুন।"

হিটলারের এই কথাই কাজ হল। কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর, তিনজনই তার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করলেন। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে জয়ী হয়ে,
হিটলার রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। তখনো জনগণ শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছিল।

কিন্তু বাহিরে তার জন্যে দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল। বাহিরে এসে তিনি এক অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদ পান। তিনি জানতে পারলেন যে অন্য আরেকটি স্থানে, তার S.A বাহিনীর একটি গ্রুপের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে। নেতা হিসেবে তার দায়িত্বই হল, এই সংকট নিরসন করা। আর এই চরম মূহুর্তে এই সংকট নিরসন করা একান্ত জরুরি। কেননা, হিটলার পুলিশের চক্ষুশূল হতে চাননি।এই কারণে, তিনি ডেপুটি কমিশনার কাহ্‌র(Gustav Ritter von Kahr), কর্নেল সাইসার(Hans Ritter von Seisser), জেনারেল লসো(Otto von Lossow)কে বীয়ার হলে রেখে ছুট লাগালেন।

কিন্তু এটা ছিল একটা মস্ত বড় ভুল। অনভিজ্ঞ হিটলার তখন তা বুঝতে পারেননি। কেননা, হিটলার চলে যাওয়ার সাথে সাথে ওই তিন জন বেঁকে বসেন। তারা ছল চাতুরি করে বীয়ার হল থেকে বের হয়ে এসে পালিয়ে যান।

হিটলার যখন বীয়ার হলে ফেরত আসেন, তিনি দেখেন যে, শিকার ৩টাই পালিয়ে গেছে। তিনি বুঝতে পারেন, কত বড় ভুলটাই না তিনি করেছেন।

****

পরদিন, বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, রেডিওতে এবং বিভিন্ন নোটিশবোর্ডে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।

"কয়েকজন উগ্রমানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তির ছলচাতুরি এবং বিশ্বাসঘাতকতার কারণে, বার্গার-ব্রকলার(Bürgerbräukeller) বীয়ার হলের সভা পুরোপুরি পন্ড হয়েছে। বন্দুকের নলের মুখে, কর্নেল সাইসার(Hans Ritter von Seisser), জেনারেল লসো(Otto von Lossow) এবং আমার কাছ থেকে, তারা যে সব দাবি-দাওয়া আদায় করে নিয়েছে, আমি আমার নিজ ক্ষমতাবলে তা বাতিল ঘোষণা করছি। সেই সাথে, রাষ্ট্রদ্রোহ এবং অন্যান্য বিশৃঙ্খলামূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকবার দায়ে, আজ থেকে, "ন্যাশনাল সোশিয়ালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স্‌ পার্টি"(National Socialist German Workers Party) সংক্ষেপে নাৎসি পার্টিকে, সম্পুর্ণরূপে অবৈধ ঘোষণা করা হল।

-গুস্তাভ রিটার ভন কাহ্‌র(Gustav Ritter von Kahr)
ডেপুটি কমিশনার অফ বাভারিয়া।


****

কিন্তু, ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। অনেকে নাৎসি পার্টির শেষ দেখে ফেললেও, হিটলারের কাছে প্লান B ছিল। তিনি এত সহজে দমবার পাত্র নন।

হিটলারের অনুরোধে, এবার দৃশ্যপটে হাজির হন জেনারেল লুডেনডর্ফ(ludendorf)। জেনারেল লুডেনডর্ফ ছিলেন ১ম বিশ্বযুদ্ধের একজন জার্মান নায়ক। আর্মির কাছে লুডেনডর্ফ নামটি টনিকের মত কাজ করবে, হিটলার তা জানতেন। লুডেনডর্ফকে দেখলে, আর্মি হিটলারের পাসে এসে দাঁড়াবে, এই আশায়, হিটলার লুডেনডর্ফকে নিজ দলে ভিড়িয়েছিলেন।

লুডেনডর্ফ

****

প্লান Bর পরিকল্পনা অনুসারে, হিটলার এবং জেনারেল লুডেনডর্ফ, নাৎসি পার্টির একটি বিশাল দল নিয়ে বাভারিয়ান ডিফেন্স মিনিস্ট্রি বিল্ডিং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে বিভিন্ন স্থানে তাদের চেকপোস্ট পার হতে হয়। কিন্তু নাৎসি পার্টির বিভিন্ন সদস্যের সাথে চেকপোস্টের সেন্ট্রিদের, কোনো না কোনো সূত্রে পরিচয় ছিল। এই কারণে, মিছিলটি সহজে চেকপোস্টগুলো পার হয়ে যায়। কিন্তু এরপরেই বিপত্তি বাঁধে।

কুচকাওয়াজ করে ক্ষমতা দখল করার ব্যর্থ চেষ্টা।

ঠিক যখন দলটি ওডিওন্স্‌-প্লাত্‌জ্‌(odeonsplatz) নামক একটি স্থানে এসে পৌছায়, তখন ১০০ অস্ত্রধারী পুলিশের একটি দল তাদের পথরোধ করে এবং চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। হিটলার পুলিশের ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে বলেন, "দেখুন আমাদের বিপ্লবে বাঁধা দিবেন না। মহান লুডেনডর্ফ আমাদের সাথে আছেন।"

পুলিশের ক্যাপ্টেন তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলে উঠেন, "লুডেনডর্ফ কে? তাকে তো আমরা চিনি না।"

এই বলে সবগুলো পুলিশ, নাৎসিদের দিকে অস্ত্র তাক করে ধরে।

হিটলার তখন বুঝতে পারলেন যে, লুডেনডর্ফের মাধ্যমে আর্মিকে টলানো গেলেও, পুলিশকে টলানো যাবে না।

কিন্তু তিনি সাহস হারালেন না। তিনি তার দলকেও অস্ত্র তাক করার আদেশ দিয়ে বসেন।

এরপর যে ঘটনাটি ঘটে, তা ইতিহাসে ব্লাড-ফ্ল্যাগ নামে পরিচিত। পুলিশ বাহিনী এবং নাৎসি বাহিনী উভয়েই একে অপরকে গুলি করার হুমকি ধামকি দিয়ে শাসাতে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও শাসানোর কাজ চলতে থাকে। কিন্তু কেউই আগে গুলি করার সাহস পাচ্ছিল না। হিটলার সামনে অনড় হয়ে দাড়িয়ে থাকেন।

হঠাৎ করে, কোন এক অজ্ঞাত স্থান থেকে গুলির শব্দ পাওয়া যায়।

বাস, আর পায় কে। গুলির শব্দ শুনা মাত্র, উভয় পক্ষ, পাগলের মত গুলি ছুড়তে থাকে।

গোলাগুলিতে নাৎসি পার্টির ১৬ জন মেম্বার নিহত হন। ৩জন পুলিশ নিহত হয়। উচ্চ পর্যায়ের নাৎসিদের মধ্যে, হেরমান গোয়েরিং(Herrman Goering), মারাত্মক আহত হন।

আর হিটলার? ১ম গুলির শব্দ শুনার সাথে সাথেই তিনি মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার কাঁধের একটি হাড় স্থানচ্যুত হয়। তিনি যদি ঝাপিয়ে না পড়তেন, তাহলে নির্ঘাত মারা যেতেন।

****

১৯২৩ সালে সংঘটিত, বীয়ার হলের এই বিদ্রোহ সম্পুর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। পরবর্তিতে নাৎসি পার্টির কয়েকজন নেতার বিচার হয় এবং তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করা হয়। হিটলারের কারাদণ্ডের সময়সীমা ছিল ৫ বছর। কিন্তু পরবর্তিতে বিশেষ বিবেচনায় তা কমিয়ে করা হয়, আট মাস।

(বীয়ার হল বিদ্রোহে সাজাপ্রাপ্ত নাৎসিগণ)

এই কারাভোগের সময়েই হিটলার তার বিখ্যাত আত্মজীবনী "মাইন কাম্ফ" রচনা করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আমার লেখার লিংক
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১২ সকাল ১১:০৮
৪০টি মন্তব্য ৪০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×