“স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল, দু-হাজার বছরেও সব মনে রাখে
ব্যাধের মতন জানে অরণ্যের আদ্যোপান্ত মূর্তি ও মর্মর
অথচ কাল বা পরশু কে ডেকে গোলাপ দিল, কিছুতেই বলবে না!”
বৃষ্টির নাচনটুকু টের পাচ্ছি অবলীলায় অথচ সেই সন্ধ্যা থেকেই আমি বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে আছি। দক্ষিণের দরজাটা হাট করে খোলা। তার সামনে যে সামান্য খোলা জায়গা, যেটা আসলে বারান্দার বর্ধিত অংশ, যেখানে আমরা প্রায়ই শর্টপিচ খেলি অথবা কোন কোন সন্ধ্যায় জমিয়ে আড্ডা দিই সদলবলে তাতে বৃষ্টি ফোটার ছন্দময় নাচের শব্দ আমার কানে ভেসে আসে। মনের আয়নাতে দেখে যাই বৃষ্টি নাচন। এই রকম কোন কোন বৃষ্টিমুখর বিষণ্ণ সন্ধ্যায় যখন আসলে কিছুই করার থাকে না অথবা থাকলেও তাতে মন বসে না আর, তখন হুটহাট করে খুলে যায় স্মৃতির দুয়ার...
'হলুদ সন্ধ্যায় আমি হায় কার অভিশাপে…
এত নির্জনতা, বিমর্ষ সঙ্গতা.. করছি কেবল পান!’
অন্তর্জালে ঘুরে বেড়ানোর নেশাটা অনেকদিনের। ঘুমানোর সময়টুকু বাদে প্রায়ই সমস্ত দিনই কাটে পিসির সামনে বসে। কত রকম কাজ, কাজের-অকাজের। তার উপর যোগ হয়েছে ব্লগ,খোমাখাতার টান। এরকমই একদিন ঘুরতে গিয়ে কে যেন পেছন থেকে ডাক দিল, কে রে এটা? থমকে দাড়াই। কোন রকম ঘুরিয়ে-পেছিয়ে এড়িয়ে যেতে চাই্। কিন্তু তার সাথে কি আর পারি? কবির সাথে পরিচয়ের শুরুটা এভাবেই। তারপর দিন চলে যায়। টুকটাক কথা হয়, গল্প শুনি। মাঝে মাঝেই কবি উধাও হয়ে যান। ফিরে এসে আবারও শুরু হয় আলাপন। হারিয়ে যাওয়া সময়ের কিংবা যাপিত জীবনের গল্প। জমে থাকা যত অভিমান কখনো ডালা উপচে পড়ে, কখনো বা ভেসে যায় হাসির তোড়ে। কিন্তু কবির দেখা মেলে না কখনোই। বলি, কবি দেখা দাও। বলে, আমায় কখনো তুমি দেখবে না। তখন আমার ভেতরকার একগুয়ে মানুষটা জেগে থাকে কবির প্রতীক্ষায়।
তারপর, তারপর অকস্মাৎ একদিন আমার মাথায় জুয়ার খেলার ভূত চেপে বসে। আমি বেড়িয়ে পড়ি, হাঁটতে শুরু করি শহরের প্রধান বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। সামান্য পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের সাথে সমস্ত শহর তখন প্রখর রোদে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হাফিয়ে উঠা পথিকের মতোন ঝিরিয়ে নিচ্ছিল। আমি যখন বাসস্ট্যান্ডে পৌছালাম তখন নানাবিধ রঙিন পোষাক পড়া কিছু তরুণ-তরুনী সেখানে বাসের অপেক্ষায় ছিল। কিছু প্রৌঢ়ও ছিলেন তবে তাদের হাতে গোনা যাচ্ছিল। তাদের মাঝে গিয়ে আমি কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়লাম। এতো লোকের ভীড়ে আমি কিভাবে কবি কে খুঁজবো? আমার মনে পড়লো, আমি আসলে কখনোই জুয়া খেলাটা পারতাম না, কেবল দর্শকই ছিলাম। আজ ঝোকের বসে খেলতে নেমে দেখি কিছুই আমার পক্ষে নেই। তবুও আমার সর্বস্ব বাজি ধরে আমি শহর ছেড়ে প্রাচীন নগরের দিকে ধাবমান বাসটাতে উঠে পড়লাম। কবি বলেছিলেন প্রাচীন এক নগরীতে তার বসত। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভেঙে গেলে দেখি আমার পরিচিত নগরের কোন চিহ্ন এখানে নেই। বাসের যাত্রীর সংখ্যাও কমেছে অনেক। একটা সরু, মৃত প্রায় নদীর পাশ দিয়ে অবহেলায় পড়ে থাকা অজস্র খানা-খন্দকে ভর্তি একটা রাস্তা দিয়ে বাস এগিয়ে চলেছে। বাস যখন এককালের ঐশ্বর্যময় পরিত্যক্ত নগরের সর্বশেষ স্টপেজে থামলো তখন বাসে মাত্র দুজন যাত্রী। আমরা দুজন যখন বাসের দুই পাশের দরজা দিয়ে নেমে ফুটপাতের দিকে এগুলাম, দেখলাম কবি আমার সামনে। আমি জুয়ার দানটাতে জিতে গেলাম। তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কবি না? কবি অবাক দৃষ্টি মেলে তাকালেন। চোখের তারায় হাজারো প্রশ্নের ভীড়। তারপর কবি সাথে নানান কথার ফাঁকে প্রাচীন নগরীর বিবর্ণ সব দালান-কোটাকে পাশ কাটিয়ে নানান গলি-ঘুপচি ঘুরে অবশেষে কবির ঘরের দরজায় উপস্থিত হলাম। কবি দরজাটা খুলতেই আমার হঠাৎ পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হলো। কবিকে বললাম, আজ তবে আসি। ফিরতে পথে আসতে আসতে আমার মনে পড়লো আমারতো আসল কাজটাই করা হয়নি। আমি তো আসলে সত্যের মুখোমুখি হতে এসেছিলাম। কিন্তু পারলাম কই? অতঃপর পুনর্বার কবির, আসলে সত্যের মুখোমুখি হতে আমি সেই প্রাচীন নগরে ফিরে গেলাম। কিন্তু আবারও ব্যর্থ হলাম। আমি যা বলতে চেয়েছিলাম তা কখনোই হাটতে হাটতে বলার মতো কথা ছিল না। তাই আমি কোন জরাজীর্ণ ক্যাফেতে কবির মুখোমুখি বসতে চেয়েছিলাম। আমাদের সামনে থাকবে ঝলসানো তিতিরের রোষ্ট, সাথে শতাব্দী পেরুনো সৌরভময় কোন পানীয়। কিন্তু কবি কোথাও বসতে রাজি হলেন না। আমি ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসলাম। কবির সাথে আমার আর কোন দিন দেখা হয়নি।
"হে নক্ষত্রের হাট–
আমি শুধু নিঃস্ব হাটুরিয়া..
মুদ্রাহীন আমার নিয়তি তবে কি কিছুই কিনতে পারবে না! "
মুঠোফোনের মেসেজ টোন বাস্তবে টেনে আনে। ক্ষুদে বার্তা বয়ে আনে বিষাদের সুর। সেলফোন থেকে সমস্ত বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে মনের উঠোন জুড়ে। ক্রন্দনরত আকাশের মতো আমার দুচোখ ভিজিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু চোখের পানি শুকিয়ে গেছে সেই কবে। কাঁথাটা সরিয়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়াই। দেখি এককোণে বেশ খানিকটা পানি জমে আছে। শৈশবটাকে বড় বেশী মনে পড়ে যায়। এরকম বৃষ্টির দিনে নানা রঙের কাগজ দিয়ে নৌকা বানিয়ে স্রোতে ছেড়ে ভাসিয়ে দিয়েছি কতবার। আজ যদি আমার সমস্ত বিষণ্ণতাকে একটা কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ছেড়ে দিতে পারতাম! কত কাল হলো বিষাদ নগরে বসবাসের? বিষণ্ণতার সাথে ঘর করার? হাসতে ভূলে গেছি কতকাল হলো? অথচ আমি হাসি মুখেই বাচতেঁ চেয়েছিলাম। বুকের ভেতর নিরন্তর এক সবুজ পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডেকে যায়। আমি প্রতীক্ষার প্রহর গুনি। আচমকা একদিন সবকিছু পিছু ফেলে, সব ছেড়ে ছুড়ে আমি তার বুকে গিয়ে ঠাঁই নিবো। অপেক্ষায় থেকো সবুজ পাহাড়!
"এখন আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই।
সেই পাহাড়ের পায়ের কাছে থাকবে গহন অরণ্য,
একেবারে চূড়ায়, মাথার খুব কাছে আকাশ… নিচে বিপুলা পৃথিবী, চরাচরে তীব্র নির্জনতা!
আমার কণ্ঠস্বর সেখানে কেউ শুনতে পাবে না।"
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১২ রাত ১১:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




