somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি লিখতে পেরেছি বিশ্বসেরা মুক্তির ইতিহাস -২

২৯ শে মার্চ, ২০১১ দুপুর ১:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আমাদের টাংগাইল শহর তখন বাঘা সিদ্দিকীর গেরিলা হামলায় পর্যুদস্ত।প্রায় প্রতিদিনই শুনি মুক্তিবাহিনীরা কেউ ফেরিওয়ালা,কেউ রিক্সাওয়ালা আবার কেউবা ভিক্ষুক সেজে নানান গুরুত্বপূর্ন স্থানে গ্রেনেড হামলা করে তাদের গোপন আস্তানায় চলে যাচ্ছে।আবার অনেক মুক্তিসেনাই ছদ্মবেশে রাজাকার বা আল-বদর সেজে মিলিটারিদের সঙ্গে কাজ করতো।তারা মুক্তিদের জানিয়ে দিত শহরে ঢুকার কোন পয়েন্টে তারা আছে সেই মোতাবেক গেরিলারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ সেই দিকদিয়ে নিয়ে এসে গেরিলা হামলা চালাতো।আমরা এসব কাহিনী শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠতাম।
ডিসেম্বর মাসে ইন্ডিয়া বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়ার পরই পাকিস্তানের রেডিওতে বেশ ফলাও করে বলা হচ্ছিল আমেরিকা ও চীনসহ মুসলিম দেশগুলো তাদের অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আছে।আমাদের দেশীয় দালালেরাও বলতে লাগলো পুর্ব পাকিস্তানে ভারত হামলা করলে আমেরিকা তার সপ্তম নৌবহর পাঠাবে।এই যুদ্ধ জাহাজটি তখন বঙ্গোপসাগরের আসপাশেই নাকি ঘুড়ে বেড়াচ্ছিল।এছাড়া পাকিস্তানের সঙ্গে রয়েছে চীনের সরাসরি স্থলপথ , চীনের সৈন্য ঢুকে পাকিস্তানকে সহায়তাও নাকি দেবে।

এইভাবে এসে গেল ১১ই ডিসেম্বর। আমরা বাচ্চারা প্রতিদিনকার মতো ক্রিকেট খেলছিলাম।হঠাৎ বিকেলের আকাশে দেখা গেল বেশ কিছু যুদ্ধবিমান চারিদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে।আমরা ভাবলাম পাকিস্তানীদের বিমান হবে হয়তো।কারন তার আগেরদিন শুলেছিলাম জামালপুর জেলা মুক্তিসেনারা দখল করে নিয়েছে। আমরা আবারো খেলায় মনযোগ দিলাম। কিন্তু কিছুক্ষন পর দেখা গেল সারি সারি ভারি বিমান আমাদের মাথার উপড় দিয়ে ধীর গতিতে উড়ে যাচ্ছে, আর সেই ফাইটার বিমানগুলো ঘুড়ে ঘুড়ে পাহাড়া দিচ্ছে।আমরা খেলা ছেড়ে অবাক হয়ে এই শত শত সারিবদ্ধ প্লেনের দিকে হা করে তাকিয়ে ভাবছিলাম এর গন্তব্য কোথায় ? একটু পরেই দেখলাম প্রতিটা বিমান থেকে বেঙের ছাতার মতো হাজার হাজার সৈন্য প্যারাস্যুট (নামটা আমরা পরে জেনেছিলাম)নিয়ে লাফিয়ে পড়ছে ! আমরা দৌড়ে গিয়ে জীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারীদের জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপার কি? তারা বললো “ডরো মাত উনলগ চীন ছে আয়া, হামলোগকো হেল্প করনে কে লিয়ে”। আমরা বিশ্বাস করলাম এই কারনে যে তারা ঐ পাকিস্তানী মিলিটারী ক্যাম্পের দিকেই নেমে যাচ্ছিল বলে মনে হলো।

টাঙ্গাইলের পুংলীতে ভারতীয় বাহিনীর অবতরন
আমরাতো ভো দৌড় সেই চাইনিজ আর্মী দেখবো বলে ,কারন এই এক বয়স ছিল যখন ভয় ডরের বালাই ছিলনা।যাক আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে যখন কুমুদিনী মহিলা কলেজের নিকট পৌছলাম তখন দেখতে পেলাম মিলিটারি ও রাজাকাররা পজিশন নিতে ব্যস্ত! আমি কিছু বুজতে না পেরে এক রাজাকারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঐ বেঙের ছাতাগুলো কোথায় নামছে ?সে আমাকে ধমক দিয়ে বললো “ভাগ জলদি ওগুলি ইন্ডিয়ান আর্মী”।আমরা তখন ভয় পেয়ে গেলাম এবং যে যার বাড়ীর দিকে উল্টো দৌড়াতে লাগালাম।কিছুক্ষন পরেই রাস্তায় যেতে যেতে দেখলাম মিলিটারিরা ট্রাকে/জীপে করে ঢাকা অভিমুখে ভাগা শুরু করেছে।
পরে জেনেছিলাম যৌথ বাহিনী নাকি দুই ঘন্টার সময় দিয়েছিল তাদের ভেগে যাওয়ার জন্য।আমি যখন বাসায় পৌছলাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে,দেখি ছোটরা সবাই মাটির বাংকারে আশ্রয় নিয়ে আছে আর আম্মা-আব্বা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। এতক্ষনে সবাই জেনে গিয়েছে টাংগাইল শহর এখন মুক্তিসেনা ও ভারতীয় সেনাদের দখলে।কিন্তু মিলিটারিরা যেতে যেতে আমাদের আক্রমনও করতে পারে এই ভেবে কেউ বাড়ীর বাইরে যায়নি বা সেই রাতে আনন্দ মিছিলও বের হয়নি।তবে মুক্তিসেনারা স্টেনগানের গুলি আকাশে মেরে প্রায় সারা রাতই আনন্দ উল্লাস করেছে।আমি ঘুম থেকে খুব সকালে উঠেই রাস্তায় নেমে এলাম। সারা রাস্তা তখন মুক্তিসেনা আর সাধারন জনতার মিছিলে মিছিলে ভরপুর। অনেক ট্রাক মিছিলও বের হয়েছিল,আমি অনেক চেস্টায় একটা ট্রাক মিছিলে উঠে পড়লাম।শ্লোগান ধরলাম জয় বাংলা,তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব,জেলের তালা ভাংবো শেখ মুজিবকে আনবো,মুক্তিযোদ্ধা লও ছালাম,মুক্তি যুদ্ধের মহানায়ক লতিফ সিদ্দিক।এই পর্যায়ে আমাদের ট্রাক হাত উচিয়ে একমুক্তি যোদ্ধা শুধরে দিলেন,বলো কাদের সিদ্দিক।প্রকৃতপক্ষে আমরা জানতাম লতিফ সিদ্দিক টাংগাইল মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার কিন্তু যুদ্ধের পরে জানলাম তিনি কলকাতার গিয়ে বসে ছিলেন।আর তার ছোটভাই কাদের সিদ্দিক এই মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত করে মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে বাঘা সিদ্দিকী খেতাব পেয়েছেন। আমরা লতিফ সিদ্দিকীকে চাক্ষুষ দেখলেও কেউ কাদের সিদ্দিকীকে দেখিনি আর যুদ্ধের আগে তার নামও শুনিনি।তাই তাকে দেখার আশায় এদিক সেদিক দৌড়াতে লাগলাম।
বিকেলে আমাদের সেই ক্রিকেট খেলার মাঠে দেখলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর জোয়ানরা অস্থায়ী ক্যাম্প বানিয়েছে।সেখানে এই প্রথম শিখ ধর্মের লোক দেখলাম।তারা আমাদের দেখে নাম জিজ্ঞেস করে চানার ডাল ও রুটি খেতে ডাকলো,আমরা ঘুড়ে ফিরে তাদেরকে দেখতে লাগলাম।সেখানেই শুনলাম কাদের সিদ্দিক পরদিন বিন্দুবাসিনী স্কুলের মাঠে বিজয় উৎসব করবেন।আমরা খুশী হয়ে বাড়ীতে গিয়ে খবরটা জানালাম।

বংগবীর বাঘা সিদ্দিক
পরদিন সেখানে গিয়ে দেখি হাজার হাজার মানুষের ঢল।স্কুলের ছাদে স্টেজ বানিয়েছে।মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত করিম, সবুরখান(তিনি রাজমিস্ত্রি ছিলেন) , ব্রিগেডিয়ার ফজলুসহ নাম মনে নেই আরো অনেকেই ছাদের উপড় দাঁড়িয়ে আছেন।আমি ও আমার আসপাশের সকলের চোখই তখন খুজে ফিরছিল সেই কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান কাদের সিদ্দিক ওরফে বাঘা সিদ্দিককে দেখার জন্য। জনসভার প্রায় সবাই এসেছে একনজর কাদের সিদ্দিককে দেখবে বলে! অবশেষে তিনি এলেন একদল দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে।দেখলাম ২০/২২ বছরের তরুন লম্বা-পাতলা দেহের মাথায় কুকড়ানো চুল আর তাতে ছিল হেট,হাতে একটা বেত ও পড়নে ছিল খাকি রঙ্গের আর্মী ড্রেস আর তাতে অনেক প্রকার ব্যাজ লাগানো।তিনি স্টেজে ঊঠার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার জনতা তার নেমে জিন্দাবাদ দেয়া শুরু করলো।তিনি খুব সুন্দরভাবে গুছিয়ে ভাষন দিলেন।তিনি বলেছেলেন যুদ্ধ শেষ হয়নি,ঢাকাসহ সারা বাংলা মুক্ত করতে হবে, শেখ মুজিবকে করাচি থেকে মুক্ত করে তবেই যুদ্ধ শেষ হবে।রাজাকারদের অত্যাচারের কথা বলে তাদের ক্ষমা না করার কথা দেন।টাঙ্গাইলের বড় রাজাকার খালেক প্রফেসরকে ৭০হাত মাটির নিচ থেকে হলেও ধরে এনে শাস্তি দেয়ার ঘোষনা দেন।তারপর সেখানে উপস্থিত করেন নাগড়পুরের রাজাকার কমান্ডার নজরুল ও টাঙ্গাইল শহরের কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার পাগলা খোকাকে।জনতাকে তিনি প্রশ্ন করেন এদের শাস্তি কি হতে পারে? সবাই সমস্বরে রায় দেন প্রকাশ্য মৃত্যুদন্ডের। তিনি প্রথমে নজরুলকে তার পাশের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের হাতে তুলে দিলেন তারা কালক্ষেপন না করে তাকে বেনয়েট দ্বারা বুকে চার্জ করে নিচে ফেলে দিলেন।উত্তেজিত জনতা বাকী কাজ পায়ে দলিত করে শেষ করলেন।
তারপর নিয়ে আসা হলো টাংগাইল শহরের কুখ্যাত রাজাকার পাগলা খোকাকে।ব্রিগেডিয়ার ফজলু তার লম্বাচুলে ধরে টান দিতেই রাজাকারের ঘাড়টা মট করে ভেঙ্গে হেলে পড়লো, তারপর বুকটা পেছন থেকে টান দিয়ে শিরদাঁড়া ভেঙ্গে লাথি দিয়ে নিচে ফেলে দিলেন,।উপস্থিত জনতা তাকেও পদ দলিত করলেন।যারা কম জোরের লোক ছিল তারা দিকবিদিগ ছুটোছুটি করে পালিয়ে গেল।এভাবেই শেষ হলো সেদিনকার জনসভা।

পরদিন মুক্তিসেনারা ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মিলে ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা দিলেন যুদ্ধের জন্য।এবং দুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানী বাহিনী যৌথ বাহিনীর নিকট সারেন্ডার করার পর আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম।
ছবিগুলো নেট থেকে সংগৃহীত
আগের পর্ব এখানে দেখুন Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১১ দুপুর ১:৫৮
১২টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×