somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি লিখতে পেরেছি বিশ্বসেরা মুক্তির ইতিহাস

২৬ শে মার্চ, ২০১১ রাত ১:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
একাত্তুর সালে আমি ছিলাম টাংগাইল শহরে।তখন আমার বয়স কতইবা হবে মাত্র ক্লাস থ্রীতে পড়ি।তবে তখনকার বাবা মারা ঐ বয়সেই আমাদের খেলাধুলার জন্য বাইরে ছেরে দিতো। সেই সুবাদে কোন মিছিল মিটিং দেখলে আমরা ছোটরাও দলবেধে ঐ বড়দের মিছিলে বা মিটিংয়ে যোগ দিতাম।তখনও প্রায়ই হরতাল হতো আর পিকেটাররা সাইকেল-রিক্সা আটকালে পেছন থেকে আমরা চাকার হাওয়া ছাড়ার কাজটা করে আনন্দ করতাম।
রাজনৈতিকভাবে টাংগাইলের অবস্থান তখন খুবই শক্ত ছিল।শুনতাম প্রায় রাতেই নাকি শেখ মুজিব টাংগাইলের সন্তোষে আসতেন মাওলানা ভাসানির সঙ্গে পরামর্শ করতে।আমরা খেলা বাদ দিয়ে প্রতিদিনই বিকেলে শহরের নিরালার মোড়ে যেতাম পথ সভা শুনতে,কারন সেখানে বাংগালী জাতির মুক্তি আন্দোলনের সর্বশেষ খবর থাকতো।তখন জ্বালাময়ী ভাষনগুলো কে দিতেন তাদের নাম সঠিক মনে নেই।তবে এইটুকু মনে আছে তারা মুজিবের কথা,ইয়াহিয়া,ভুট্টো,মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনরা কে কি বলেছেন ইত্যাদি শুনাতেন।আর শ্লোগান দিতেন জয় বাংলা, পিন্ডি না ঢাকা...ঢাকা ঢাকা,তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা ইত্যাদি।

মার্চ মাসের একদিন খবর এলো ঢাকাতে বাঙ্গালীদের মেরে ফেলা হচ্ছে।ট্রাক ও বাসে করে এমনকি পায়ে হেটেও ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা শত শত লোকজনেরা যে বর্ননা দিচ্ছিল তা সবাই শুনে ক্ষেপে যাচ্ছিল।সেই নিরালার মোড়ের পথ সভা বড় হয়ে বিন্দুবাসিনী হাই স্কুলের বিশাল মাঠে অনুষ্ঠিত হলো।আমার মনে আছে তখন একটা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী(পরে মুক্তি বাহিনী) গঠিত হলো। তারা শপথ নিলেন শেষ বিন্দু রক্ত দিয়ে হলেও টাংগাইল প্রতিরোধ করবে এবং তরুন লতিফ সিদ্দিকীকে (বর্তমানে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী) বাহিনী প্রধান করে সকল অফিস আদালত,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে আমাদের জয় বাংলার নুতন পতাকা ঊড়ানোর নির্দেশ দিলেন।পরদিন সবাই লাল সবুজ আর মানচিত্র আকা পতাকা উরিয়ে দিলেন।
আমাদের বাসায় ছিল প্রয়াত নেতা খান আতাউর রহমানের জাতীয় দলের লাল পতাকার উপরে ধান-কাস্তে আকা একটা বড় পতাকা।উক্ত দলের টাংগাইলের নেতা ছিলেন আল-মুজাহিদী ও শামীম আল-মামুন নামের দুই ভাই, তারা আমাদের পাড়াতেই থাকতেন।আমার ভাই ঐ পতাকাটা বেশ উচু করে কোয়ার্টারের ছাদে উড়িয়ে দিলেন।পরদিন আওয়ামীলিগের দুই-তিনজন কর্মী এসে বললেন কি ব্যাপার এটাতো ভুল পতাকা উড়িয়েছেন।আমার ভাই তাদের বুঝিয়ে দিলেন,সর্বদলীয় সিদ্বান্ত এখনো হয়নি যে বাংলাদেশের পতাকা কি হবে ?ভাইয়ের যুক্তি শুনে আর কথা না বাড়িয়ে তারা চলে গেলেন।

এইসময় পুরানো বাসস্ট্যান্ডের মোড়ে ট্রাফিক আইল্যান্ডটাতে একটা মোটা পাইপ কালো রং করে কামানের আকার করে হেলমেট পড়িয়ে এক লোককে বসিয়ে দিল।দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল আর্মী পজিশন নিয়ে বসে আছে। আমার মতো বাচ্চারা এসব দেখে মজা পেতাম আর সারাদিনই ঘুরে বেড়াতাম।একদিন সর্বদলীয় ব্যনারে ডিসি অফিস ঘেড়াও করতে সবাই রওয়ানা হলো। অনেকের হাতেই ছিল পাখি মারার এয়ারগান ও লাঠি সোঠা! আমরা মিছিলকারীদের জিজ্ঞেস করে জানলাম তারা বিহারী,পাকিস্তানী সেনা-পুলিশ ও উর্দুভাষী সরকারী অফিসারদের সারেন্ডার করানোর জন্য যাচ্ছে।কথা শুনে তাদের সঙ্গে আমরাও প্রায় সারাদিন ডিস্ট্রিক(জেলা অফিসপাড়া) লেকের পারে বসে কাটালাম, কারন বড়রা আমাদের ওদিকে যেতেই দেয়নি। বিকেলের দিকে দেখলাম তারা হাসি মুখে ফিরতে শুরু করলো। কারন বিনা বাধাতেই তারা বিহারীদের কব্জা করেছিল।তারা নাকি কথা দিয়েছিল বাংগালীর সঙ্গেই তারা থাকবে।

এদিকে দেশের অবস্থা দিন দিন আরও খারাপ হতে লাগলো।খবর এলো পাকিস্তানী মিলিটারীরা ঢাকা থেকে অন্যান্য জেলার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ওদিকে চট্টগ্রামের সমুদ্রে পাকিস্তানী একটি অস্ত্রের জাহাজ এসেছে ওটা থেকে বাংগালী সৈন্যরা অস্ত্র খালাস করতে দিচ্ছেনা ইত্যাদি নানা রকম কথা শুনা যাচ্ছিল। আরো জানা গেল মেজর জিয়া শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন।রেডিওতে আমরা ভাঙ্গা ভাঙ্গা আওয়াজে মেজর জিয়ার ঘোষনাটাও একসময় শুনে ফেলি। আমরা এই সব খবরগুলি রাতে বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠান ও আকাশবানী কলকাতা থেকেও শুনতে পেতাম। আমার আব্বা ছিলেন খুব সাদা সিধে সরকারী কর্মচারী,তিনি এইসব রাজনীতির ব্যাপারে খুব একটা খোজ খবর রাখতেননা।আমাদের ছিল তিন নবের একটা ফিলিপস রেডিও ।সন্ধ্যে বেলায় আমরা সব ভাইবোন গোল হয়ে বসে সেই রেডিও থেকে এই সব খবর শুনতাম। এছাড়া টাংগাইলের রাস্তা ঘাটে দাড়ালেই অনেক কথা শুনা যেত, বাসায় ফিরে এসে আমরা যে যা শুনেছি এগুলো আলোচনা করতাম।

নবগঠিত মুক্তিসেনারা পাকিস্তানী সৈন্যদের টাঙ্গাইল দখল ঠেকাতে ঢাকার দিকে এগিয়ে নাটিয়াপাড়া নামক স্থানে সমবেত হলো। এর আগে জেলা অস্ত্রাগার দখল করে নিয়ে সব অস্ত্রই তারা দখল করে নিলো আর অবাঙ্গালীদের আটক করে রাখলো।আমরা এই খবর শুনে ভীত হয়ে উঠলাম।কারন আমাদের দেশের বাড়ী কুমিল্লা যেতে হলে সেই ঢাকা অতিক্রম করতে হবে!আমাদের পরিচিত অনেকেই ইতিমধ্যে গ্রামে চলে যেতে শুরু করলো।আর এরই মধ্যে শুরু হলো নাটিয়া পাড়ার যুদ্ধ।আমাদের বাসার সামনে দিয়েই ঢাকা-টাংগাইল মহা সড়ক।দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম মুক্তিসেনাদের সঙ্গে বাংগালী পুলিশ ও ইপিয়ারের সেনারা যোগ দিয়ে একত্রে যুদ্ধে যাচ্ছে।তাই দেখে আমরাও কিছুটা ভরসা পেলাম।এই নাটিয়া পাড়ার যুদ্ধ থেকেই আমি প্রথম গোলাগুলীর আওয়াজের সঙ্গে পরিচিত হলাম। দুইদিন একনাগারে যুদ্ধ চললো, আকাশে আমরা কালো ধুয়া দেখে সঙ্কিত হলাম।রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুধু গাড়ী আসা যাওয়া দেখি,এরই মধ্যে একটা ট্রাক নাটিয়াপাড়া থেকে ফিরে এসে সবাইকে হাত নেড়ে পালানোর নির্দেশ দিতে লাগলো।মুক্তিসেনারা রাস্তার ধারের লোকজনকে বলে যাচ্ছিল তারা এবার হেরে গিয়ে পিছু হটেছে কিন্ত শীঘ্রই আবারো ফিরে এসে এই শহরসহ সারা বাংলা জয় করবেন।

আমি দৌড়ে হাপাতে হাপাতে বাসায় গেলাম এবং সবাইকে এই কথাটা বললাম।তখন দুপুরবেলা ছিল বলে সবাই বাসাতেই ছিল।তারাও বাইরে গিয়ে দেখতে পেল ওদিক থেকে আরো ট্রাকে করে মুক্তি সেনারা ছুটে আসছে আর হাত নেড়ে নেড়ে সবাইকে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বলছেন। অন্যদিকে তাকিয়ে দেখি ইতিমধ্যেই শতশত নারী-পুরুষ লোটাকম্বল নিয়ে বিলের দিকে দৌড়াচ্ছে।বাসায় ফিরে আমরাও হাতের কাছে যা প্রয়োজনীয় মনে করেছি সঙ্গে নিয়ে একইদিকে বেড়িয়ে পড়লাম।আমাদের ভাই-বোন সবার হাতেই ছিল কিছুনা কিছু জিনিষপত্র।আব্বা-আম্মার দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছিল। পাকিস্তানীদের স্টেনগানের একটানা শব্দ কানে আসতে লাগলো আর আমরা চিৎকার করে কান্না করছি আর দৌড়াচ্ছি। আশে পাশে আরো শত শত লোকজন একইভাবে দৌড়াচ্ছিল। আমরা হাটু পানির বিল ডিঙ্গিয়ে ওপাড়ে গিয়ে আব্বা-আম্মার জন্য একটু বসলাম।তখনই চোখে পড়লো আশেকপুর ব্রীজের দিকে পাকিস্তানীদের সারি সারি জলপাই রঙ্গের জিপ গাড়ী শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।আমরা তখন ফায়ার রেঞ্জের বাইরে ছিলাম তবুও ভয়ে আবারো উঠেপড়ে দৌড়াতে লাগলাম।এভাবে অনেক দুরের একটা গ্রামে গিয়ে উঠলাম।সেখানে গিয়ে দেখি অনেক লোকজন আগে থেকেই আশ্রয় নিয়েছেন।বাড়ীর মালিক আমাদেরকেও ডেকে নিয়ে আম্মা ও বোনদের একটা বড় টিন সেডের ভেতরে যেতে বললেন। আমি আব্বার সঙ্গে বাইরে খড় বিছিয়ে হাতে নিয়ে আসা চাদরের উপড় বসে পড়লাম।আমাদের আশে পাশে আরো প্রচুর লোকজন এভাবেই শুয়ে-বসে ছিলেন।তাদের মুখে শুনলাম কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই পড়ে রয়েছে।বড় ভাই এসে খবর দিলেন পাশের ঘড়ে জাতীয় দল নেতা আল-মুজাহিদ ভাইও আশ্রয় নিয়েছেন।আমি তাকে দেখতে দৌড়ে গেলাম।সেখানে তিনিসহ আরো কয়েকজন বসে ছিলেন।আমাকে দেখে তিনি বললেন আয় আমার নিকট বস।তিনি আমাদের ছোটদের নিয়ে খেলাঘড় জাতীয় একটা দল করেছিলেন।সেখানে আমাদের বুদ্ধি পরীক্ষা দিতে হতো।সেদিন উনার কাছে বসে দেখলাম কালো একটা পোটলা,জিজ্ঞেস করতেই বের করে দেখালো চকচকে একটি পিস্টল ও কিছু বুলেট।আমার জীবনে সেটাই ছিল প্রথম অতি নিকট থেকে স্বচক্ষে দেখা সত্যিকারের পিস্টল।আমি দৌড়ে আব্বার নিকট গিয়ে এই সংবাদটা দিলাম।
এদিকে রাত হতেই জোৎনার আলো নেমে এলো,অনেকে বলাবলি শুরু করলো নুতন টিনের চাল উপড় থেকে দেখে পাকিস্তানীরা বোমা মারতে পারে!কেউ কেউ কাথা দিয়ে এই চালকে ঢেকে দেয়ার পরামর্শও দিলেন!পুরো রাতটাই আমাদের কাটলো এই বুজি আমরা আক্রান্ত হলাম সেই ভয় আর দুঃচিন্তায়।আর সেদিন রাতে আমরা কিছু খেয়েছিলাম কিনা আমার মনেও নেই।সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম অর্ধেক লোকই চলে গিয়েছে।মুজাহিদ ভাইও নেই।শুনলাম সেখান থেকে অনেকেই মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিতে ইন্ডিয়াতে চলে যাচ্ছেন।আমরা কোথাও না গিয়ে সেখানেই আরো একদিন- একরাত কাটালাম।এদিকে শহরে মাইকিং করে সবাইকে ফিরে যেতে।বলা হচ্ছিল।অফিস আদালত,দোকানপাট এবং ব্যবসা শুরু করতে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে অন্যথায় শাস্তি দেয়া হবে।আব্বা এই খবর পেয়েই আমাদেরকে রেখে একাকী শহরে গিয়ে ফিরে এলেন বিকালে।এসেই আমাদেরকে ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরী হতে বললেন।তিনি বললেন সরকারী কর্মচারীদের কোন ভয় নেই।উনাকে চেকপোস্টে আর্মীরা উর্দুতে কিভাবে জিজ্ঞেস করেছেন সব বললেন।আব্বা সরকারী চাকুরে এবং মুসলমান শুনেই নাকি ছেড়ে দিয়েছে!আমরা এইসব শুনে বুকে সাহস পেলাম এবং শহরের দিকে ফিরে চললাম।

আমাদের কোয়ার্টারে ফিরে এসে দেখলাম সব আগের মতোই আছে।আমাদের গার্ড নিজামভাই সেখানেই ছিল,তিনি আম্মাকে দেখে ঢুকরে কেধে উঠলেন।যাক আমি আর ভয়ে বাসা থেকে তখন বের হইনা।তবে বারান্দা বা জানালার ফাক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখতাম একদম ফাকা রাস্তা,শুধু জলপাই রঙের মিলিটারীর টহল গাড়ী। সামনে এক আর্মী স্টেনগান তাক করে দাড়িয়ে থাকতে দেখা যেত।এদিকে আব্বা অফিস যাওয়া শুরু করলেন নাহলে মিলিটারী নাকি ধরে নিয়ে যাবে।অন্যদিকে আস্তে আস্তে অনেক প্রতিবেশীরাই ফিরে আসা শুরু করলো।আমাদের মনে তখন একটু একটু সাহস ফিরে আসতে শুরু হলো।কিছু দিনের মধ্যেই এখানে কিছু নুতন নেতার নাম শুনা যেতে লাগলো। তারা সবাই মিলিটারীদের সঙ্গে মিলে শান্তি কমিটি গঠন করলো।আমার মনে পড়ে তাদের একজন ছিল প্রফেসর খালেক। তার বাসা ছিল বিশ্বাস বেতকাতে,আগে আমরা তার বাড়ীর সামনে গোল্লাছুট/ দারিয়াবান্দা খেলতে যেতাম।কিন্তু মিলিটারী আসার পর সে হয়ে উঠলো টাংগাইলের প্রবল প্রতাপশালী লোক।তার বাড়ীতে নাকি প্রায় সব সময়ই মিলিটারীর আসা যাওয়া ছিল।এছাড়া আরেক জন ছিল ভাদু দারগা কন্ট্রাক্টর।ঐ এলাকাতে দুজনই ছিলেন,যারা সবাইকে অভয় দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে মিশে থাকার আহবান জানালেন।শান্তি কমিটির অনেক নেতার নাম আমার মনে নেই তবে তারা ঘড়ে ঘড়ে গিয়ে আমাদের মতো আটকেপড়া অসহায় লোকদের শান্তির বাণী শুনাতে লাগলো!সেই সঙ্গে গঠিত হলো কুখ্যাত আল-শামস ও রাজাকার বাহিনী!

তিন চারদিনের মধ্যে এই জামায়াত নেতাদের সহায়তায় রাজাকাররা শহরের পাচআনি বাজারে হিন্দুদের সোনার দোকান সহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে লুটপাটের ব্যবস্থা করে দিলেন।কিছু সংখ্যক লম্পট এই লুটপাটে অংশ নিলেন।হিন্দু লোকরা তাদের ভিটে বাড়ি ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে গেল আর তাদের বাড়ি ঘড় বেদখল হয়ে গেল।এরপর দুই-তিন মাস টাংগাইল শহর ছিল বেশ শান্ত ।

আমরা বাইরে যেতাম আইডেন্টিটি কার্ড (মিলিটারী ভাষায় ডান্ডি কার্ড)সঙ্গে করে এবং বুকে ছোট্ট আকারে পাকিস্তানী ফ্লাগ লাগিয়ে।তবে আমাদের বয়সের কাউকে তারা কিছু বলতেননা।এদিকে একদিন আব্বাকে চেক পোস্টে ধরে খুবই নাজেহাল করলেন।তিনি মুসলমান কিনা প্রমান দিতে সূরা পড়ে শুনাতে হয়েছিল।তাছাড়া সাচ্চা মুসলমানদের মুখে নাকি দাড়ি থাকে, তিনি কেন রাখেননি?এরপর থেকে আব্বা ওদের প্রচন্ড ঘৃনা করতে শুরু করেন।এদিকে কা্লো ড্রেস পড়ে রাজাকাররা সারা দিন টহল দেয়া শুরু করলো। তবে রাত আটটার পর তাদেরকে আর দেখা যেতনা।এই রাজাকার বাহিনীতে সব বেকার লোক এবং জামায়াত ইসলামীর ক্যাডাররা ঢুকে ছিল।আজ কাল টিভি টক শোতে দেখা জাতীয় পার্টির(মঞ্জু) মহাসচিব সাদেক সিদ্দিকীও এই রাজাকার বাহিনীতে অনেকদিন কাজ করেছেন।তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন আগে অস্ত্রসহ পালিয়ে গিয়ে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। এভাবে অনেক রাজাকারই তখন হাল দেখে দল বদল করেছিল!

আমরা মুক্তি যুদ্ধের খবর সাধারনতঃ বিবিসি বাংলা,আকাশবাণী কলকাতা আর স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুনতাম।এই অনুষ্ঠানগুলি খুবই গোপনে আস্তে আস্তে শুনতে হতো কারন রাজাকাররা জানতে পারলে ধরিয়ে দেয়ার ভয় ছিল।স্বাধীনবাংলা বেতারে মুক্তিসেনাদের বীরত্বগাথা চরমপত্র নামক একটি অনুষ্ঠানে বেশ ব্যঙ্গাত্বকভাবে পড়ে শুনাতো। আমরা গোপনে শুনতাম আর আনন্দে হাসতাম।এই চরমপত্র অনুষ্ঠানে মুক্তিসেনাদের বিচ্ছু আর টাংগাইলের মুক্তিবাহিনী প্রধানকে বাঘা সিদ্দিকী বলতেন।এই রেডিও থেকেই শুনেছিলাম বাঘা সিদ্দিকী টাংগাইলের আসপাশে চোরা গুপ্তা (গেরিলা) হামলা করে মিলিটারীদের ব্যস্ত করে রেখেছিল।এখনকার যমুনাব্রীজের নিকট ভূয়াপুর নদীতে মুক্তিবাহিনীরা পাকিস্তানী সেনাদের অস্ত্র বোঝাই একটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে সব অস্ত্র দখল করে নিয়েছিল।এইসব খবর তখন আমাদের যে কি আনন্দ দিত তা ভাষায় বুজানো যাবেনা।আমরা প্রায় প্রতি দিনই এই বাঘা সিদ্দিকীর বীরত্ব গাথা কাহিনী রেডিওতে শুনতাম।আর কিছু গান আমাদের মনে এখনো রেকর্ড হয়ে আছে।আর মধ্যে আপেল মাহমুদের মোড়া একটি ফুলকে বাচাবো বলে যুদ্ধ করি,আব্দুল জব্বারের ছালাম ছালাম হাজার ছালাম,শোন একটি মজিবরের কন্ঠে লক্ষ মুজিবের ধ্বনি সহ অনেক গান।

যাদের বয়স বারো-চৌদ্দ পেরিয়ে গিয়েছে এমন ছেলেরা তখন দলে দলে মুক্তি যুদ্ধে যোগ দেয়া শুরু করলো।প্রায় প্রতি রাতেই বাবা-মার অগোচরে তারা চলে যেত মুক্তি যুদ্ধে।আর এরাই ট্রেনিং শেষে ফিরে এসে শহরে গেরিলা অপারেশন শুরু করলো।তখন রুপবানী সিনেমা হলে খুব ঊর্দু সিনেমা চলতো।এক শো’তে মুক্তিরা সেখানে গ্রেনেড মেরে দিল,ফলে সেই হল হয়ে গেল বন্ধ!

তবে দিনের বেলায় শহর ছিল নিরাপদ।আমরা সকালে স্কুলে যেতাম আর ফিরে এসে ভাত খেয়েই দৌড় দিতাম খেলতে যেতে।একদিন যেতে যেতে দেখলাম এক হিন্দু বাড়ী হঠাৎ করে রাজাকার আর মিলিটারী মিলে ঘিড়ে ফেললো।আমি এগিয়ে যেতেই আমার এলাকার তারামিয়া রাজাকার আমাকে দূরে থাকতে বললো।আমি দূর থেকেই দেখলাম শুন্যবাড়ীতে পাউডার জাতীয় কিছু ছিটিয়ে ফায়ার করল।আর সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ীতে আগুন লেগে গেল! তাদের ধারনা ছিল রাতে এখানে মুক্তিরা থাকে।

ঈদের বাজার করতে আব্বার সঙ্গে একদিন কাচাবাজারে গেলাম।গিয়ে দেখি বাজার ভর্তি রাজাকারের দল।শুনলাম তারা এসেছে বাজারদর স্থিতি রাখতে।আমরা দুধের বাজারে গিয়ে দেখি দাম একটু বেশি বেশি।এক খদ্দের গিয়ে খোকা রাজাকারকে অভিযোগ করলেন।দুধওয়ালা ছিল বুড়ো,খোকা এসে বললো কি রে চাচা দাম বেশী নেও কেন? দুধওয়ালা উত্তরে শুধু বলেছিল আমি এর কমে নিমুনা কারন গাইটা আমার তোমাদের না।ব্যস তাকে ধরে কসাইয়ের টঙ্গে উঠিয়ে ঘোড়ার চাবুক দিয়ে সেকি মার।আমরা ভয়ে বাজার বাদেই সেদিন পালিয়ে এসেছিলাম। এই খোকা রাজাকার আর কেউনা আমাদের নায়ক মান্নার চাচা ছিলেন।

শিবনাথ হাই স্কুলের মাঠে বিকালে টেনিস বল দিয়ে আমরা ক্রিকেট খেলতাম। আমাদের বড়রা কেঊ মূক্তিসেনা কেউ রাজাকার কেউবা পলাতক তাই আমাদে্র ছোটদেরই তখন রাজত্ব।তবে আমরা যখন ক্রিকেট খেলতাম তখন পাকিস্তানী মিলিটারীরা জীপে বসে আমাদের খেলার আমুদে দর্শক হতো।কখনো কখনো হাত তালি দিত আবার খেলা শেষে আমাদেরকে চকলেটবার (তখন খোলা বাজারে পাওয়া যেতনা) উপহার দিত।একদিন এক ছেলে (ক্ষমা কর তুমি আমার ক্লাশমেট ছিলে অথচ নাম মনে নেই) খুউব ভাল খেলা দেখাল।সে অনেক চকলেট আর বাহবাও পেল।সন্ধ্যে বেলায় বাসায় যেতে যেতে সে আমাকে বলেছিল তারা গ্রামের বাড়ী চলে যাচ্ছে।পরদিন করোটিয়া ব্রিজে মুক্তিসেনাদের পুতে রাখা মাইন বিস্ফোরনে বাসের আরোহী হয়ে সে শহীদ হলো। শেষ দেখার দিন তার পড়নে ছিল ব্লু-সার্ট ,আমি আজও দেখতে পাই ব্লুসার্ট পরিহিত আমার সেই ছোট্ট শহীদ বন্ধুটিকে।
চলবে

লেখাটি পুনঃ প্রকাশিত হচ্ছে সুরঞ্জনা আপার সৌজন্যে
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×