somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পতাকার সম্মান রক্ষার দায়িত্বে একজন ভীনদেশী বন্ধু মেঘ সিং

১১ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(প্রথমেই বলে রাখি ইনি ভারতীয় ব্যক্তি। তাই বলে দয়া করে পোস্টে ভারতের বর্তমান কার্যকলাপ, সীমান্ত হত্যা, বাঁধ, ক্রিকেট ইত্যাদি নিয়ে কমেন্ট করতে আসবেন না। যিনি সম্মানীয় তাকে সম্মান জানাতে হয়, তার কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেই হয়)

একজন লম্বা, সদাহাস্যরত মানুষ। মানুষের জন্য যার মনের দুয়ার সবসময় খোলা।

নাম তার লে: কর্ণেল মেঘ সিং। ভারতীয়-১৮ বিএসএফের কমান্ডিং অফিসার। রাজপুত ব্যাটালিয়নের কমান্ডো। জন্ম ১ইমার্চ ১৯২৪, ভারতের রাজস্থানে।

লোকটা সিনিয়রদের সামনে অপ্রিয় সত্যি কথা বলতো এজন্যে তার পদোন্নতিও হত না। এই দু:সাহসী লোকটা ১৯৬৫সালের যুদ্ধে সাহসীকতা প্রদর্শনের জন্য “বীর চক্র” পদক লাভ করেন। লে.জেনারেল হারবক্স সিংয়ের In the Line of Duty: A soldier remembers বইয়ে মেঘ সিং সম্পর্কে বলা হয়েছে কোর্ট মার্শাল করে মেঘ সিং কে মেজর পদে ডিমোশন দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৬৫ সালে আবার তার বীরত্ব দেখে প্রমোশন দেওয়া হয়।

মেঘ সিংএর রাজপুত ব্যাটালিয়নকে ফেব্রুয়ারিতে বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তের পেট্রাপোলে নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৯৭১ এর ৩০শে মার্চ ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ করা হলে লে: হাফিজ ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২০০ সৈনিক ও ইপিআরের ৩০০ সৈনিক নিয়ে প্রতিরক্ষাযুদ্ধ করতে করতে বেনাপোলের দিকে অগ্রসর হয়।

১৯৭১ এর ২৩ শে এপ্রিল….
যশোর-বেনাপোল রোডের পাশে বেনাপোলের কাগজপুকুরে প্রতিরক্ষা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে লে:হাফিজ এর সৈনিকরা আর ইপিআরের সৈনিকেরা।
অনেক হতাহত হলেও যুদ্ধটাকে চালিয়ে যেতে থাকে এরা। হাফিজ কোম্পানি দুটিকে বেনাপোল চেকপোস্ট এলাকায় পিছিয়ে আনেন। যুদ্ধ চলছে, আর্টিলারি ফায়ারিং….

হঠাৎ পিছনদিক থেকে জিপ চালিয়ে একজন হাফিজের কাছে নামলেন। সে লে: কর্ণেল মেঘ সিং। এতো গোলাগুলির মাঝেও সে শান্ত। পাকা সড়কের উপর দাড়িয়ে স্বাভাবিকভাবে হাফিজকে জিঙ্গাসা করলো যে, “হাফিজ ভালো আছো তো?”
আহতদের পিছনে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিলেন। ফিরে গেলেন মেঘসিং….
কিন্তু আমাদের প্রতি তার একটা ভালবাসা ছিল। ফিরে গিয়েই সে নিজের পক্ষ থেকে পাঠিয়ে দিলেন ৬টি ৩ইঞ্চি মর্টার ও পর্যাপ্ত পরিমাণে গোলা।

১৭ই এপ্রিল সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই মেঘসিং সামনের সারিতেই বসেছিল যেন আমাদের দেশের সেনা!

এপ্রিলেই যশোরের নাভারণের কাছে মেঘ সিংয়ের দুইজন্য সৈন্য পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এরফলে পাকিস্তানিরা অনেক তোলপাড় করে। কারণ তখনও ভারত কোনরকম সরাসরি যুদ্ধের সাথে জড়িত ছিল না। আসলে ঘোষণা দিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের যুদ্ধ করার অনেক আগে থেকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী ব্যাপক সাহায্য করে। কোথাও ব্যাকআপ হিসেবে কোথাও বা মেঘ সিংয়ের মত এগিয়ে।

লে. কর্নেল মেঘ সিং, বিএসএফ-এর অফিসারসহ দুটি কোম্পানি পূর্ণ সামরিক সম্ভার নিয়ে ঝিকরগাছা লাওজান গেটের নিকট প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য।

মে মাসের মাঝামাঝিতে একদিন হাফিজ গিয়েছিলেন মেঘসিং এর হেডকোয়ার্টারে। মেঘ সিং সেদিন বলেছিলো, "ভারত সরকার কেন আরো সক্রিয়ভাবে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করছে না।"
এ যেন এদেশের কোন সৈনিক ভারতের উপরে ক্ষোভ দেখাচ্ছে!!!

সেদিন মেঘসিং হাফিজের সাথে একটা গোপন ইচ্ছার কথা বলেছিল, সেটা হলো, "আমি ভাবছি বিএসএফের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মুক্তিবাহিনীর সৈনিক হয়ে যাবো!"

বেনাপোলের এক মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে শুনেছিলাম, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বেনাপোল নোম্যানসল্যান্ডে পুরো যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকাটা পত পত করে উড়েছিলো। আর এই পতাকাটা পুরো সময়ে এইভাবে উড়ার পিছনে ছিল মেঘ সিং।

জেনারেল অরোরা আসেন পেট্রাপোলে। হাফিজের সাথে কথা বলেন। এমন সময় মেঘসিং এসে জেনারেল অরোরা স্যালুট দিয়ে নোম্যানসল্যান্ডের ফ্লাগ স্ট্যান্ডের বাংলাদেশের পতাকা দেখিয়ে ইংরেজিতে বলেন, “স্যার, আমি মুক্তিবাহিনীর এই অফিসারটাকে কথা দিয়েছি যে এই পতাকাটি কেবল আমার মৃতদেহের উপরদিয়েই নামানো সম্ভব (The flag will be come down only over my deadbody)। স্যার, আমি চাকরি ছেড়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
মেঘসিং এর কথা শুনে জেনারেল অরোরা হতভম্ব হয়ে যায়। যদিও মেঘসিং চাকরি ছেড়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে পারে নি কিন্তু ঐ পতাকাটা সত্যি কেউ নামাতে পারে নি। যুদ্ধের পুরোটা সময় বেনাপোলের নোম্যান্সল্যান্ডে পত পত করে উড়েছিলো আমাদের ঐ পতাকা। তিনি ঠিকই পতাকা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বেনাপোলের বাসিন্দা হয়ে এটার জন্য আমি গর্ববোধ করতে পারি।

মেজর কামরুল হাসান ভূইয়ার লেখা “জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা” বইয়ে মেঘ সিং এর সম্পর্কে হালকাভাবে জানার পরে তার ছবি আর তার সম্পর্কে আরেকটু বেশি জানার চেষ্টা করেছিলাম। গুগল করে একটা ওয়েবসাইট থেকে ঐ ঝাপসা ছবিটা পেলাম। আরো বিভিন্ন ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া থেকে হালকা তথ্য পেয়েছি।

তিনি অবসর নেওয়ার পরে খুব সম্ভবত জয়পুরে একটা থ্রি স্টার হোটেল তৈরি করেন। হোটেলটির নাম Meghniwas Hotel. জানতে পারি নি তিনি বেঁচে আছেন কিনা। বেঁচে থাকলেও হয়ত বয়স অনেক হয়ে গেছে। কারণ হোটেলটি এখন তার পরিবারের অন্য সদস্যরা পরিচালনা করে। তার পরিবারের সদস্যদের কিছু ফেসবুক আইডিও পেয়েছিলাম। কিন্তু সেখান থেকেও তেমন কোন তথ্য পায় নি।

এমন অনেক মেঘ সিং নিজে থেকে সাহায্য করেছে আমাদের মুক্তিবাহিনীকে।

জানি সবার নাম মনে রাখা যায় না। তবুও কিছু মানুষের নাম মনে রাখতে হয়, মনে রাখা লাগে। মেঘ সিং তেমনই একজন… যে বাংলাদেশী না হয়েও আমাদের প্রতি দেখিয়েছে অসীম ভালবাসা……

তথ্য কৃতজ্ঞতা:
১. জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা- মেজর কামরুল হাসান ভূইয়া
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র নবম খন্ড
৩. view this link
৪. view this link
৫. view this link
৬. view this link
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১:৪৪
১৯টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×