গল্পটি কুড়িয়ে পাওয়া, ভাল মন্দ বিচারের ভার পাঠকের উপর।
তিথি আজ পৃথিবীর কয়েকজন সুখী নারীর একজন। স্বামী আহসান আর মেয়ে পৃথাকে নিয়ে তার সাজানো সংসার। তিথির স্বামী আহসান পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। সারাদিন অফিসে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিথি খেয়েছে কিনা, পৃথা কি করছে এসব খবর নিতে কখনো ভুল করেন না তিনি। কোম্পানীর বিশাল একটা অংশের দায়িত্বে আছে আহসান সাহেব। তার ১০ বৎসরের কর্ম জীবনের প্রশংসা করে শেষ করা যাবে না। আহসান আর তিথির বিয়ে হয়েছে ২ বছর আগে। পৃথিবীতে খুব কম পুরুষই আছে যে একজন নারীর পুরোটা মন দখল করতে পারে। আহসান সেই কম পুরুষেরই একজন। তিথির একমাত্র মেয়ে পৃথা স্ট্যান্ডার্ড ওয়ানে পড়ে। বাবা মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যায়, আর মা স্কুল শেষে মেয়েকে বাসায় নিয়ে আসেছ। বাসায় আসার পথে মেয়ের বায়না পূরণ করতে করতে তিথি বিরক্ত হয়ে যায়। কিন্তু নিষেধ করতে পারে না। পৃথার বাবার কড়া নির্দেশ তার মেয়ে যা চাইবে তাই কিনে দিতে হবে।
সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততা শেষে আহসান বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজায়। দৌড়ে এসে দরজা খুলে তিথি। পাশে এসে দাঁড়ায় মেয়ে পৃথা। তিথির মায়াবী চাহনী, পৃথার কন্ঠে “বাবা’’ ডাক আহসানের সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই দূর করে দেয়। সব ক্লান্তিকে দরজায় ঝেড়ে ফেলে স্বচ্ছ কিছু প্রশান্তি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে আহসান। এরপর তিথি ব্যস্ত হয়ে পড়ে স্বামীর জন্য ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাতে আর পৃথা শুরু করে তার স্কুলের গল্প। বাবা গভীর মনোযোগ দিয়ে মেয়ের গল্প শুনে।
আজ এতোটাই সুখী তিথি, এতোটাই সাজানো-গোছানো তিথির জীবন। কিন্তু তিথির অতীত জীবন ফিরে দেখলে এমন সুন্দর পরিণতি কল্পনা করা যায় না। আসলে আমাদের জীবনটা একটা বইয়ের মতো। এক পৃষ্ঠা থেকে আরেক পৃষ্ঠায় না গেলে বুঝতে পারবো না আগের পৃষ্ঠাটা কেমন ছিল, এই পৃষ্ঠা কি অপেক্ষা করছে। একটা পৃষ্ঠাটা অধ্যায় শেষ করে অন্য অধ্যায়ে না গেলে বুঝতে পারবো না পরের অধ্যায়টা কত সুন্দর। কত কিছু অপেক্ষা করছে এই অধ্যায়ে।
তিথি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। সেসময় দশম শ্রেণীর এক ছাত্রের কাছ থেকে প্রেম-পত্র পেয়ে এমনই ভয় পায় যে জ্বর চলে আসে তিথির। সেই জ্বর সারতে ৭ দিন সময় লাগে। ৭ দিন পর স্কুলে গিয়ে শুনে যে দিন সেই ছেলেটা তাকে চিঠি দিয়েছিল সেদিনই ছিল ওই ছেলের স্কুল জীবনের শেষ দিন। তিথি অনেক লজ্জা পায় আর নিজের প্রতি জেদ হতে থাকে তার, “সব কিছুতে এত নার্ভাস হয়ে যায় কেন সে?” এ ভাবনা তার পিছু ছাড়ে না। পরে আর প্রেম-পত্র প্রেরক সেই সিনিয়র ভাইয়ের দেখা মেলে নি। কিশোর বয়সের প্রেমে ভালোবাসার চেয়ে বেশী কাজ করে আবেগ আর মোহ।
এই ঘটনার কয়েকমাস পর তিথির বাবা খুলনা থেকে রাজশাহীতে বদলী হন। অনিচ্ছাস্বত্তেও তিথির পুরো পরিবারকে খুলনা ছেড়ে রাজশাহীর সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশে উঠতে হয়। রাজশাহীতে তিথিদের পরিচিত কেউ নেই। তাই রাজশাহীর জীবন-যাপন মোটেও ভাল লাগছিল না তাদের। তিথিকে রাজশাহীর একটি ভালো স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। সেই স্কুলের নতুন বন্ধুদের সাথে তিথি কিছুতেই মানিয়ে উঠতে পারছিল না। এভাবেই চলছিল তিথিদের রাজশাহীর জীবন। হঠাৎ কথায় কথায় পাশের বাসার একজন মহিলার কাছ থেকে তিথির মা জানতে পারে তার ছোট্ট বেলার বান্ধবী রোকসানা এই এলাকায় থাকে। রোকসানাকে কিছু না জানিয়েই তাদের বাসায় গিয়ে উঠে তিথির মা বীণা, সঙ্গে ছিল তিথি। দীর্ঘ ১২ বছর পর দুই বান্ধবী একে অন্যকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। তিথি সব দেখে আর ভাবে এভাবে যদি তার কোন বান্ধবীকেও সে পেয়ে যেত। তিথির মা বান্ধবী রোকসানার সাথে তার মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দেয়।
“রোকসানা এই হচ্ছে তিথি, আমার একমাত্র মেয়ে”
“বাহ! তোর মেয়ে তো দেখি তোর মত সুন্দরী হয়েছে”
লজ্জা পায় তিথি।
তিথিকে লজ্জা পেতে দেখে রোকসানা খালা বলে “দেখো দেখো মেয়ে লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। মা তুমি কোন ক্লাসে পড়?”
তিথি জবাব দেয়ার আগেই তিথির মা জবাব দিয়ে বসল “ক্লাস নাইনে পড়ে। ওকে নিয়েই তো আছি ঝামেলায়, এখানকার কারো সাথে নিজেকে মানাতে পারছে না।”
“প্রথম প্রথম একটু আধটু এমন হবেই। নতুন পরিবেশ তো, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তো আছিই।”
‘‘হুম, তোর ছেলে-মেয়েরা কোথায়? কাউকে তো দেখছি না।”
“আমার এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলে রাহুল সামনের বছর এস, এস, সি পরীক্ষা দিবে মেয়ে লিনা ক্লাস সিক্সে পড়ে।” উত্তর দেয় রোকসানা খালা।
‘‘তো ডাক ওদের, একটু দেখি’’
‘‘রাহুল খেলতে গেছে, লিনা কোচিংয়ে। রাহুল একটু পর চলে আসবে। লিনার আসতে দেরী হবে।”
তিথির মা আর রাতুলের মায়ের আলোচনা থেকে রাতুলদের পরিবার সম্পর্কে কিছু ধারণা পায় তিথি। রাতুলের বাবা জাফর সাহেব একজন ব্যবসায়ী। সারাদিন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। রাতুলের রোল নং কত কিংবা কোন সেকশনে পড়ে তাও তিনি বোধ হয় ঠিক করে জানেন না। রাতুলের মা রোকসানা খালা একজন দায়িত্বশীল মহিলা, রান্না-বান্না, সংসার গোছানো, ছেলে রাতুল আর মেয়ে লিনাকে নিয়েই তার যত ব্যস্ততা।
তাদের আলাপচারিচতার মাঝেই ঘরে প্রবেশ করে কালো প্যান্ট, সাদা টি-শার্ট পরা আর কালো ফ্রেমে চশমা চোখে রাতুল। রাতুল তার নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল। তার মা তাকে থামায়।
“রাতুল এদিকে আয়”
রাতুল তাদের সামনে আসে।
“তোমাদের বলেছিলাম না আমার ছোট্ট বেলার বান্ধবী বীণার কথা? এই হচ্ছে তোমার বীণা খালা”
রাতুল বীণা খালাকে সালাম দিল। আর জিজ্ঞেস করল “কেমন আছেন?”
“ভালো আছি বাবা, তুমি কেমন আছো?”
“জ্বি ভালো”
“তোমার পড়াশোনা কি অবস্থা বলো?”
“জ্বি ভালো”
কথার মাঝখানে রাতুলের মা বলে উঠল “এই বীণা তুই রাতুলের সাথে কথা বল, আমি সমুচা আনি। আজকে ঘরে সমুচা বানিয়েছি।”
বীণা খালা বলল, “আমিও আসব নাকি?”
আরে না, তুই কথা বল”
“আচ্ছা ঠিক আছে”
বীণা খালা আবার কথা শুরু করল “রাতুল, তিথিকে তো মডার্ণ হাইস্কুলে ভর্তি করিয়েছি। স্কুলটা কেমন?”
এই মাত্র রাতুল বুঝতে পারলো এই ঘরে আরো একজন আছে।
রাতুল তিথির দিকে এক পলক চেয়ে জবাব দিল, “জ্বি খালা ভাল স্কুল”
“যাক, আমি তো অনেক চিন্তায় ছিলাম”
রাতুল আবারো তিথির দিকে তাকায়। তিথি বিষয়টা বুঝতে পারে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় তিথির ব্যাপারটা ভালো লাগছে।
এমন সময় রাতুলের মা প্রবেশ করে।
“নে বীণা শুরু কর। আমার তৈরী স্পেশাল সমুচা। রাতুল তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। তোমার ঘরে নাস্তা পাঠাচ্ছি।”
রাতুল উঠে তার ঘরে চলে যায়। তিথির মা, বীণা খালা আর তিথি সমুচা খেতে থাকে। হঠাৎ তিথি লক্ষ্য করে দূর থেকে রাতুল তাকে দেখছে। তিথিকে দেখে চোখ সরিয়ে নেয় রাতুল।
কিছুক্ষণ পর তিথি আর তিথির মা সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
তিথি চলে যাওয়ার পর রাতুলের কেমন যেন লাগছির। তিথিকে ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারছে না সে। এই যখন অবস্থা তখন রাতুলের ঘরে প্রবেশ করে রাতুলের ছোট বোন লিনা।
“কিরে আজ নাকি সুন্দর একটা আপু আসছিল?” লিনার প্রশ্ন।
“হ্যাঁ আসছিল”
“অনেক সুন্দর?”
“আমি কি করে বলবো অনেক সুন্দর নাকি কম সুন্দর?”
“ও অনেক সুন্দর নাকি কম সুন্দর সেটা তো তুমি আবার বুঝ না।” এই বলে লিনা রাতুলের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রেগে গেলে লিনা রাতুলকে “তুমি” বলে সম্বোধন করে।
লিনা রাতুলের চেয়ে ৪ বছরের ছোট। অনেক চালাক আর দুরন্ত প্রকৃতির মেয়ে। ওর কথা শুনলে কেউ বুঝবে না সবে মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ে এই মেয়ে। রাতুলকে কখনো ভাইয়া বলে ডাকে না। তার কথা শুনলে মনে হয় সেই উল্টা রাতুলের চেয়ে ৩-৪ বছরের বড়। রাতুলও মজা পায়। সব ছোট বোনরা বড় ভাইকে ভয় পায় আর ওর ক্ষেত্রে পুরাই ভিন্ন। রাতুলের এ নিয়ে তেমন কোন মাথা ব্যাথা নেই।
রাতে তিথিকে ভাবতে ভাবতে রাতুলের ঘুম আসে। সকালে মায়ের ডাকে রাতুলের ঘুম ভাঙ্গে।
“রাতুল জলদি ওঠো তোমার টিচার আসছে।”
রাতুল লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠলো। কখন যে ১০ টা বেজে গেল রাতুল টেরই পায় নি।
ফ্রেস হয়ে, জাষ্ট অল্প একটু পাউরুটি আর একটা কলা খেলে রাতুল রিডিং রুম এ গেল।
টিচারকে সালাম দিয়ে চেয়ারে বসলো।
সালামের জবাব দিয়ে টিচার বলল, “কি অবস্থা রাতুল.. ম্যাথগুলো শেষ করছো?”
রাতুল মাথা নিচু করে জবাব দিল, “ভাইয়া করি নি।”
রাতুল তার টিচারকে ভাইয়া বলে ডাকে। রাতুলের টিচারের নাম জামান। পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স করছে। খুবই ভদ্র-শালীন এজন মানুষ।
“কেন করলে না? রাতুলের টিচারের প্রশ্ন।”
“ভাইয়া রাতে আমার শরীর ভাল লাগছিলো না। তাই করতে পারি নি।”
“এখন শরীর খারাপ হলে চলবে? ক’দিন পরেই তো পরীক্ষা।”
“সরি ভাইয়া, আর এমন হবে না।”
“সরি বলতে হবে না রাতুল, আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে পড়া ফাঁকি দাওনি। শরীরের প্রতি যতœ নাও।”
“ঠিক আছে ভাইয়া”
“আজ তাহলে আমি যাই, ম্যাথগুলো করে রেখো। আমি কাল এসে দেখব।”
“ঠিক আছে ভাইয়া।”
টিচার চলে যাবার পর রাতুল পড়ার টেবিল থেকে উঠলো না। ম্যাথগুলো করতে শুরু করল। রাতুল নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না, তিথির কথা বার বার মনে পড়ছে।
পরদিন কোচিং সেন্টারে মডেল টেস্ট দিতে গিয়ে বেষ্ট ফ্রেন্ড সজলের সাথে দেখা হলো রাতুলের।
সজল রাতুলকে দেখে বলল, “বন্ধু খবর কি?”
রাতুল জবাব দিল, “এইতো কোন রকম।”
“কোন রকম কেনো? কোন প্রবলেম?”
“নারে এমনি!”
“ব্যাপার কি, তোকে আজ একটু অন্য রকম লাগছে।”
“আরে কিচ্ছু হয় নি, এমনি।”
“কিছু একটা হইছে দোস্ত, আমাকে বল।”
“আরে না কিচ্ছু হয় নাই।”
সজল রাতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই আমাকে বলবি না?
রাতুল আর চুপ থাকতে পারল না। কোচিংয়ের পাশে নবাবের টং দোকানে বসে চা খেতে খেতে সব খুলে বলল।
সব কিছু শুনে সজল লাফিয়ে উঠে বলল, “দোস্ত মিষ্টি আনা, মিষ্টি খাবো।”
“কিসের মিষ্টি?”
“প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার মিষ্টি।”
“ওই, আমি প্রেমে পড়ছি তোকে বলল কে?”
এই কথা বলেই রাতুল লজ্জা পেয়ে যায়। আসলেই কি সে প্রেমে পড়েছে? একবার দেখেই প্রেম? তাহলে কি একইে বলে, ‘খড়াব ধঃ ঋরৎংঃ ংরমযঃ’?
সজল বলে উঠে, “বন্ধু শোন তুই ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা কর, এমন কিছু কর যাতে তোকে ওর ভাল লাগে। আমি জানি আমার বন্ধুকে কারো খারাপ লাগতে পারে না।”
“আর একটু ভেবে দেখি।” রাতুলের জবাব।
“কি ঠিক করলি আমাকে জানাবি কিন্তু।”
“ঠিক আছে জানাব।”
“আর শোন, এখন থেকে বেশী বেশী মিষ্টি আর মধু খাওয়া শুরু কর।”
“কেন, এসব খাব কেন?”
“কিছুদিন পর তিথির সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হবে না।”
“লাথি খাবি বললাম। তুই দেখি আমার চেয়ে সিরিয়াস।”
“সিরিয়াস হব না? আমার যে বন্ধু কোন মেয়েকেই কেয়ার করে না সে বন্ধুর ঘুম আজ কেড়ে নিয়েছে একটা মেয়ে, আমি সিরিয়াস হব না?”
“চুপ থাক।”
“চুপ থাকব না, বন্ধু আমারো না তিথিকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“না তোকে দেখতে দিবো না।”
“কেন ? আমি কি দোষ করলাম?”
“তুই একটা শয়তান, তাই দেখতে দিব না।” এই কথা বলে রাতুল নিজেই হাসতে শরু করে, সাথে সজলও হাসতে থাকে।
নবাবের চায়ের দোকানে অনেক্ষণ আড্ডা মেরে বিকেলে বাসায় ফেরে দু’জন।
আজকের বিলেকটা অনেক সুন্দর। আকাশে নীল আর সাদা মেঘের রাজি খেলা, কে কার আগে ছুটবে...
তিথিকে দেখতে রাতুলের খুব ইচ্ছে করছে। তাই ঠিক করলো মাকে গিয়ে তিথিদের বাসায় যাওয়ার কথা বলবে।
রাতুল তার মায়ের ঘরে গিয়ে বসলো।
কিভাবে শুরু করবে বুঝতে না পেরে হুট করে বলে বসলো, “মা কি কর?”
মা বলল, “এই তো রেডি হচ্ছি, বীণার বাসায় যাব।”
এ কথা শুনে নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারল না রাতুল। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি...
রাতুল জিজ্ঞেস করলো, “লিনা যাবে?”
“যাবে তো।”
“তো আমি একা কি করবো?”
“তুমি পড়তে বসো। আর আমাদের সাথে যেতে চাইলে যেতে পারো। বীণা খুশী হবে।”
রাতুল বলল, “ঠিক আছে যাই তোমাদের সাথে, বাসায় থাকতে ভাল লাগছে না।”
রাতুল কথাটা এমন ভাবে বললো যেন না যেতে পারলে সে খুশী হতো। কিন্তু যাওয়ার কথা শুনে সে যে কতো খুশী হয়েছে তা রাতুল আর উপরে একজন ছাড়া কেউ হয়তো বুঝতে পারে নি...
রাতুল রেডি হলো। সাদার মাঝে গাঢ় নীল চেকের একটা শার্ট গায়ে দিল।
লিনা বলল, ‘‘কিরে আজ এত সাজছিস কেন?”
“আরে সাজলাম কোথায়?”
লিনা এমনভাবে হাসলো যেন সে রাতুলের উদ্দেশ্য বুঝে গেছে।
এমন সময় রাতুলের মা এসে রাতুলকে বলল, “রাতুল যাও তো পাশের দোকান থেকে ১ লিটারের একটা আইসক্রীম নিয়ে আসো।”
“আইসক্রীম কেন?”
“তোমার বীণা খালামণির জন্য, ওর আইসক্রীম অনেক পছন্দ।”
“ঠিক আছে যাচ্ছি। তোমরা নিচে নামো।”
“হ্যা, যাও, আমরা নামছি।”
“টাকা দাও।”
‘‘টেবিলের উপর রেখে এসেছি, নিয়ে যাও।”
“আচ্ছা যাচ্ছি।”
রাতুলের মা তিথিদের বাসার দরজায় নক করল। তিথির আম্মু দরজা খুলে রাতুলের মায়ের হাত টেনে ধরে বলল, রোকসানা আসছিস! রাতুল, লিনা তোমরা আসছো বাবা? কেমন আছো তোমরা?”
লিনা উত্তর দিলো, “ভাল আছি খালামণি। আপনি কেমন আছেন?”
“ভাল আছি মা।”
রাতুলের মা তিথির মায়ের হাতে আইসক্রীম ধরিয়ে দিয়ে বলল, “তোর জন্য।”
তিথির মা হেসে বলল, “তোর এখনো মনে আছে?”
“মনে থাকবে না কেন?”
“তিথিও আমার মত হইছে, আইসক্রীম আর চকলেট ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না।”
রাতুলের মা, লিনা, রাতুল তিথিদের ড্রইং রুমে বসল। তিথিকে দেখা যাচ্ছে না। রাতুলের অস্থির লাগছে, আর অপেক্ষা করতে পারছে না।
রাতুলের প্রতীক্ষার অবসান হলো, তিথি ড্রইং রুমে প্রবেশ করল। রাতুলের মা কে সালাম দিল।
রাতুল অবাক হয়ে তিথির দিকে তাকিয়ে আছে। কালো স্কার্ট আর লাল রঙয়ের ফতুয়াতে তিথিকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। রাতুল তিথির দিকে তাকিয়ে ছিল, ঠিক তখন তিথি রাতুলের দিকে তাকাল। তিথি তাকাতেই রাতুল চোখ সরিয়ে নিল। রাতুল লজ্জা পেল। তিথি বুঝতে না পারলেও লিনা ঠিকই বুঝতে পারল।
তিথি রাতুলকে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন?”
রাতুল জবাব দিল, “ভাল। তুমি কেমন আছো?”
“জ্বি ভালো।”
এমন সময় তিথির মা ড্রইং রুমে প্রবেশ করে বলল, “রান্না প্রায় শেষ, রাতে কিন্তু খেয়ে যেতে হবে।”
রাতুলের মা বলল, “হায়রে তোর পাগলামি এখনো গেল না।”
তিথির মা হাসতে হাসতে বলল, “রাতুল বাবা তুমি গিয়ে তিথির পড়াশোনার অবস্থাটা একটু দেখ না।”
রাতুল জবাব দিল, “জ্বি আচ্ছা।”
“যাও তিথি রাতুলকে তোমার পড়ার ঘরে নিয়ে যাও, তোমার পড়াশোনাগুলো কেমন হচ্ছে দেখাও।”
তিথি রাতুলকে বলল, “আসেন।”
রাতুল তিথির ঘরে প্রবেশ করল। সুন্দর পরিপাটি একটা ঘর। বিছানায় অনেকগুলো পুতুল। পড়ার টেবিলটা সুন্দর করে গোছানো। পড়ার টেবিল দেখেই রাতুল বুঝলো পড়াশোনা বেশী একটা করে না তিথি। যারা বেশী পড়াশোনা করে তাদের পড়ার টেবিল আগোছালো থাকে।
পড়ার টেবিলের পাশে থাকা চেয়ার দেখিয়ে তিথি রাতুলকে বসতে বলল।
রাতুল বসলো। তিথিও আর একটি চেয়ারে বসলো। এরপর দুজনই চুপ। কেউ কথা বলতে পারছে না।
অনেকক্ষন পর রাতুল নিরবতার সমাপ্তি টানলো। জিজ্ঞেস করল, রাহশাহী কেমন লাগছে?”
“ভাল।”
“ফার্স্ট টার্ম এক্সাম কবে?”
“এখনো জানায় নি।”
অনেকক্ষণ যাবত পড়াশোনা বিষয়ক কথা চলতে থাকে। রাত ৯টার দিকে তিথির আব্বু অফিস থেকে আসেন। তিথির আব্বুর নাম রফিকুল ইসলাম। জনতা ব্যাংকে সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে নিয়োজিত আছেন। উনি খুব ক্লান্ত ছিলেন, তাই রাতুলদের সাথে একটু কথা বলে উনার বেডরুমে চলে গেলেন। রাতুল দেখেই বুঝলেন ভদ্রলোক গম্ভীর মানুষ।
রাতে খেয়ে রাতুলরা বাসায় ফিরল।
বাসায় ফিরে রাতুল টিভি দেখছিল।
লিনা এসে বসল। কিছুক্ষণ পর বলতে লাগলো, “কেউ একজন বুঝে না তিথি আপু দেখতে কেমন। কিন্তু ঠিকই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।”
রাতুল কোনো জবাব দিল না।
রাতুলকে রাগানোর জন্য লিনা ইচ্ছে করে হাসতে থাকে।
এবার রাতুলের মেজাজ খারাপ হয়। ধমক দিয়ে বলে, “যা বলছি এখান থেকে।”
“যাচ্ছি” লিনার উচ্চস্বরে জবাব।
রাতে ঘুমাতে গেল রাতুল। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে রাতুল, তিথির কথা। আজকে সে কয়েকটা বিষয় আবিষ্কার করলো। তিথি মেয়েটা শুধু সুন্দরই না তার আরো অনেক গুণ আছে। যেমন মেয়েটা খুব শালীন, বিনয়ী, শান্ত, চুপচাপ।
রাতুলের কল্পনায় এখন শুধু তিথি, তিথির মায়াবী মুখ, মিষ্টি হাসি। রাতুলের পৃথিবীটা যেন শুধু তিথির জন্য।
কিশোর বয়সের প্রেম বোধহয় এমনি হয়...
এমনি করে কেটে গেল আরো কিছুদিন। এর মাঝে রাতুলের সাথে তিথির দু’বার দেখা হয়। রাতুলের পড়াশোনার অবস্থা বেশী ভালো যাচ্ছে না। রাতুল বুঝতে পারল এমনি করে চলতে থাকলে তার পরীক্ষার অবস্থার বারটা বাজবে। তাই রাতুল ঠিক করলো এবার তিথিকে সে বলবে। সজলও তাই বলেছে, দেরী করা ঠিক হবে না। কিন্তু তিথির সামনে দাঁড়িয়ে এ কথা রাতুল বলতে পারবে না। তাই অনেক সাহস করে একটা চিঠি লিখলো রাতুল। ছোট্ট একটা চিঠি...
তিথি,
আমি জানি চিঠিটা তোমাকে অবাক করবে। অবাক আমিও হয়েছিলাম, যেদিন প্রথম দেখাতেই তোমাকে ভাল লাগে। আমি জীবনে কখনো চিন্তাও করিনি একটা মেয়েকে আমার এতো ভাল লাগবে। তোমার মায়াবী চেহারা, শালীনতা, এমনকি সমুচা খাওয়াও আমার ভাল লেগেছে।
তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন, খুব...
-রাতুল।
চিঠিটা লিখে রাতুল নিজের কাছেই রেখে দিল। একদিন তিথি রাতুলদের বাসায় আসলো গল্পের বই নিতে। রাতুল সেদিন একটা গল্পের বইয়ের ভেতরে চিঠিটা দিয়ে দিল। এরপর রাতুল বড়লো দুঃশ্চিন্তায়।
চিঠিটা পেয়ে কি করবে তিথি?
কি হতে পারে চিঠিটার উত্তর?
তিথি তাকে ফিরিয়ে দিবে না তো?
এরকম হাজার প্রশ্ন রাতুলের মাথায় খেলতে থাকে।
তিন দিন চলে গেল তিথির কোন উত্তর নাই, রাতুলের প্রতীক্ষা যেন শেষ হবার নয়। এরই মাঝে কোচিংয়ে যাওয়ার সময় রাতুল তিথিকে দেখে, তিথিও রাতুলকে দেখে। তিথি স্কুল থেকে ফিরছিল। কিন্তু রাতুল তিথির চোখে-মুখে চিঠির কোন উত্তর পেল না। রাতুলের দুঃশ্চিন্তা পরিণত হলো মহা দুঃশ্চিন্তায়।
তিথি কি তার চিঠি গ্রহণ করে নি?
নাকি চিঠিটা বই থেকে পড়ে গেছে?
চিঠিটা অন্য কেউ পেল না তো?
প্রশ্নে প্রশ্নে কাটে রাতুলের আরো দু’দিন।
একদিন বিকেলে কোচিং থেকে ফিরে রাতুল দেখল তার পড়ার টেবিলের উপর একটা বই।
রাতুল বইয়ের পাতাগুলো উল্টিয়ে দেখছিল। দেখতে দেখতে রাতুল বইয়ের ভেতর একটা ছোট্ট চিরকুট পেল লেখা ছিল- “চিঠিটা ভালো হয়েছে।”
রাতুলের চোখে-মুখে প্রাপ্তির হাসি। বুঝতে পারলো এটা তিথির দেয়া।
তারপরও কেন যেন লিনাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিরে আজকে বাসায় কেউ এসেছিল?
“কালো-বিশ্রী একটা আপু আছে না উনি আসছিল।” লিনার উত্তর।
“কার কথা বলছিস?”
“তিথি, পিখি, কিখির কথা।”
রাতুল বুঝতে পারে সেদিনের রাগ এখনও রয়ে গেছে লিনার। রাতুল আজ অনেক খুশী, তার চিঠি তিথির ভাল লেগেছে। রাতুল অনেকগুলো চকলেট এনে লিনাকে দিল।
লিনা অভিমানের সুরে বলল, “লাগবে না।”
“আরে নে, অনেক মজা।”
“অনেক মজা হলে তুমি খাও, যাও। আমি খাবো না।”
“আমিও খাবো, তুইও খা।”
“যাও আমার ঘরে রেখে আসো।”
এ যেন ছোট ভাইকে বড় বোনের নির্দেশ।
রাতুলের দিনগুলো ভালই যাচ্ছে। পড়াশোনার অবস্থা আগের চেয়ে ভাল। কিন্তু এখনো তিথিকে ভালোবাসি কথাটা বলা হয়নি। আর তিথির সেই ছোট্ট উত্তরটার মানে এই না যে তিথি ওকে ভালোবাসে।
রাতুল গেল সজলদের বাসায়। সজলদের বাসার ছাদে উঠল।
“কি করব দোস্ত?” রাতুলের প্রশ্ন।
“বলে ফেল তিথিকে।”
“কিভাবে?”
“ওর সামনে দাঁড়িয়ে।”
“অসম্ভব।”
“সম্ভব।”
“পারব না।”
“পারবি।”
“যদি ফিরিয়ে দেয়?”
“দিবে না।”
“আচ্ছা তুই সব কিছু এতটা পজেটিভ ভাবিস কিভাবে?”
“শোন বন্ধু, যদি তোকে রিফিউজ করার ইচ্ছে থাকতো তাহলে তোর চিঠির এত সুন্দর একটা উত্তর দিত না, বুঝলি?”
রাতুল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ঠিক আছে বন্ধু তোর কথাই সই, কালই বলব।”
সজলের আশ্বাসে রাতুল অনেক সাহস পেল।
রাতুল তিথির প্রাইভেট টিচারের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে। উদ্দেশ্য তিথিকে প্রেম নিবেদন করা। ২০-২৫ মিনিট পর তিথি বের হয়ে আসল। সাথে ওর অনেক বান্ধবী।
রাতুলকে দেখে তিথি অবাক হলো। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন?”
“ভাল, তুমি কেমন আছো?”
“জ্বি, ভাল।”
“এখানে কি করছেন, কোন কাজ আছে?”
“না, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
“ও আচ্ছা” এই বলে তিথি বান্ধবীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে বলল, “বলুন।”
“চলো অন্য কোথাও বসি।”
“এখন? দেরী হলে আম্মু টেনশন করবে”।
“অল্প কিছুক্ষণ বসি।”
তিথি নীরব থাকল। নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।
রাতুল বলল, “চলো।”
অতঃপর ওরা একটা রেস্টুরেন্টে বসল। দুজন মুখোমুখি বসল।
কিভাবে শুরু করবে রাতুল বুঝতে পারছে না। ঠিক করল প্রথমেই বলে ফেলবে “তিথি আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
প্রস্তুতি শেষ।
বলা শুরু করল, “তিথি স্যার আজকে কি পড়িয়েছেন?”
তিথি অবাক হলো এবং উত্তর দিলো, ট্যাগ কোশ্চেন এর রুল। কেনো?”
কি বলতে গিয়ে কি বলল রাতুল। নিজের প্রতি রাগ হলো রাতুলের। সামলে নিলো নিজেকে। এবার বলবেই বলবে। শরু করল, “তিথি... আমি.... আচ্ছা তুমি কি আচার খাও?”
“খাইতো, কেনো?”
“না এমনি।”
“আপনার কথা কি শেষ? আম্মু চিন্তা করছে।”
“আর একটু বসো।”
“বলুন।”
আসলে আমি তোমাকে ভালো... এতটুকু খুব তাড়াতাড়ি বলে একটু থেমে পরের অংশে বলল, আমি তোমাকে ভালো কিছু বই দেব।
তিথি একটু মুচকি হাসলো। তারপর বলল, “আচ্ছা দিয়েন, পড়বো। কথা শেষ?”
“না... মানে... আচ্ছা তুমি যাও।”
তিথি চলে গেল। রাতুল নির্বাক হয়ে তিথির প্রস্থান দেখলো।
রাতুলের ইচ্ছে করছে মাথার চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। কিন্তু তাও পারছে না। কারণ তিথি যদি মাথায় কম চুলওয়ালা ছেলে পছন্দ না করে।
‘ভালোবাসি’ নামক শব্দটা বলার ক্ষেত্রে মেয়েরা ছেলেদের একটুও সাহায্য করে না।
সেদিনের ঠিক দুদিন পর রাতুল আবার তিথির প্রাইভেট টিচারের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
তিথি বের হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি খবর?”
“এইতো।”
“আজকেও কিছু বলতে আসছেন?”
রাতুল কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল, “হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে।” এই বলে তিথি বান্ধবীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে বলল, “আজকেও কি কোথাও বসে বলতে হবে?”
রাতুল চুপ করে থাকল। কিছুক্ষণ পর হুট করে তিথির মুখে আলতো করে স্পর্শ করে বলে ফেলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
তিথি কোন উত্তর না দিয়েই চলে গেল।
রাতুল এত সাহস কোথা থেকে পেল তা বুঝতে পারছে না।
নিজেকে রক্তশূন্য মানুষ মনে হতে লাগলো রাতুলের।
সেদিন রাতে রাতুলের ঘুম হলো না। টেনশনে যেন মারা যাচ্ছে।
তিথি যদি খালামনিকে বলে দেয়...
খালামনি যদি মাকে বলে দেয়...
এরকম হাজার টেনশন রাতুলের মাথায় ঘুরতে থাকে। দুই দিন কেটে গেলো চিন্তা করতে করতে।
রাতুলের এস. এস. সি পরীক্ষার আর মাত্র ১ মাস ৭ দিন বাকি।
দিনটা ছিল সোমবার। রাতুল তার ঘরে ঢুকে তার বিছানায় একটা বই দেখতে পেল। নতুন একটা বই। কবি জসিম উদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’। বই খুলতেই দেখল বইয়ের প্রথম পাতার একটা কোনায় লিখা ‘আমিও...’
রাতুল আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। তিথিও তাকে ভালোবাসে? সে নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছে না।
রাতুল আজকের দিনটা স্মরণ করে রাখতে আজকের তারিখটা দেখল। আজ ১৪ই ফেব্র“য়ারী। রাতুলের মনে পড়লো আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। জলদি বাসা থেকে বেরিয়ে একটা গিফট হাউজ থেকে কিছু গিফট আর একটা কার্ড কিনে আনল। কিন্তু সেদিন তিথিকে এসব দিতে পারল না। কোন উপায় ছিল না।
পরদিন রাতুল তিথির প্রাইভেট টিচারের বাসার সামনে আবারো দাঁড়াল। তিথি বেরিয়ে আসলে দুজন দুজনকে দেখে লাজুক হাসি হাসলো। তিথি তার বান্ধবীদের সাথে রাতুলকে পরিচয় করিয়ে দিল।
সেদিন রাতুল আর তিথি একসাথে রিকশায় করে ঘুরল, ফুসকা খেলো, আইসক্রীম খেলো, অনেক অনেক কথা বলল। কথা যেন শেষ হয় না...
দুজনের মনে হতে লাগল, আজকের বিকেলটা আর একটু দীর্ঘ হলে কত ভাল হতো।
খুব সুন্দর কেটে যাচ্ছে রাতুল-তিথির দিন গুলো। সুযোগ পেলেই রাতুল তিথিদের বাসায় যায়, তিথিও আসে রাতুলদের বাসায়। সবার অগোচরে নিজেদের একান্ত কথাগুলো বিনিময় করে দু’জন। দু’জন দু’জনকে চিঠি দেয়। রঙ্গিন কাগজে লিখা সুন্দর সুন্দর চিঠি। মাঝে মাঝে তিথিকে নিয়ে রাতুল ঘুরতে যায়। কিন্তু রাতুলের এস. এস. সি পরীক্ষা এগিয়ে আসতে থাকলে রাতুল তিথিকে আগের মতো সময় দিতে পারে না। তাতে তিথির কোন আক্ষেপ-অভিযোগ নেই। বরং রাতুলকে ভালোভাবে পড়াশোনা করতে বলে, শরীরের প্রতি যতœ নিতে বলে। মাঝে মাঝে রাতুলদের টিএনটিতে ফোন করে রাতুলের সাথে কথা বলে, রাতুলকে সাহস দেয়।
তিথিকে যতোই দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে রাতুল।
একটা মেয়ে এত গুণবতী কি করে হয়!
শুরু হলো রাতুলের এস.এস.সি পরীক্ষা। পরীক্ষার আগের রাতে রাতুল তিথিদের টিএনটিতে ফোন করে। তিথি ফোন ধরে।
“হ্যালো...”
“হ্যালো তিথি।”
“হ্যা... রাতুল, কাল তোমার পরীক্ষা। তুমি ফোন করেছ কেন?”
“এমনি।”
“ভাল রেজাল্ট কিন্তু করতে হবে বলে দিলাম।”
“তুমি পাশে থাকলে করব।”
“আমি তো আছিই।”
“একটা কথা বলি?”
“বলো।”
“আগে বলো বকা দিবা না।”
তিথি হাসতে হাসতে বলে “আচ্ছা দিব না।”
“আমার না তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে তোমাকে একবার দেখলে কালকের পরীক্ষাটা অনেক ভাল হবে।”
“হায়রে পাগল এখন তুমি আমাকে কিভাবে দেখবো?”
“আমি তোমাদের বাসার সামনে আসছি, তুমি জানালায় দাঁড়াও।”
“এতো রাতে বেরুলে আন্টি বকবে না?”
“বকবে না, বলব কলম কিনতে যাচ্ছি।”
“আচ্ছা আসো।”
ঠিক আছে, তুমি দাঁড়াও। রাতুল তিথিদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে, তিথি জানালায়। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে, অপলক দৃষ্টিতে। কিছুক্ষণ পর রাতুল হাতের ইশারায় বিদায় নিল।
দীর্ঘ ২৮ দিন পর শেষ হয় রাতুলের এস. এস. সি পরীক্ষা। বাংলাদেশ তো ৭১ সালে স্বাধীন হয়েছিল রাতুল যেন আজ স্বাধীন হলো! শুরু হলো রাতুল-তিথির সুন্দরের চেয়ে সুন্দরতর পথচলা। এখন দু’জন প্রায়ই ঘুরতে বের হয়। প্রায়ই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুসকা, ঝালমুড়ি খায়। একদিন ঝালমুড়িতে ঝাল একটু বেশী দেয়াতে তিথির অনেক ঝাল লাগে। তিথির চেহারা পুরো লাল হয়ে যায়, তিথির চোখ থেকে পানি ঝরতে থাকে।
রাতুল অবাক হয়ে দেখে, মুগ্ধ হয়। একটা মেয়ে এতো মায়াবী কিভাবে হয়?
আরেকদিন রাতুল আর তিথি রিক্সায়। হঠাৎ বৃষ্টি নামে।
রিক্সাওয়ালা বলে, “ভাইজান পর্দা লন।”
তিথি বলে, “লাগবে না।”
রাতুল অবাক হয়ে বলে, “কেন?”
“বৃষ্টিতে ভিজবো। তুমি হুডটা ফেলে দাও।”
রাতুল তাই করল। বৃষ্টির শীতল ফোঁটা তাদের দু’জনকে ছুঁয়ে দিতে শুরু করল।
এভাবে স্বপ্নের মত সুন্দর দিন কাটতে থাকে রাতুল-তিথির...
রাতুলের এস.এস.সি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলো। রাতুল খুব ভাল রেজাল্ট করল। সবাই অনেক খুশী।
রাতুল-তিথি তাদের স্বপ্ন আর পরিকল্পনা সাজাতে ব্যস্ত।
- বিয়ের দিন রাতুল খয়েরী রঙের শেরোয়ানী আর তিথি লাল রঙের শাড়ী পরবে।
- দু’জনে কেউ রাগ করলে অন্যজন রাগ ভাঙাতে হবে।
- বিয়ের পর থেকেই তিথি রাতুলকে বাবুর বাবা আর রাতুল তিথিকে বাবুর মা ডাকবে।
- তাদের ছেলে বাবুটার নাম হবে স্বপ্ন আর মেয়ে বাবুটার নাম হবে সীমানা।
- রাতুলকে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরতে হবে।
এবং ইত্যাদি, ইত্যাদি...!!
এবার রাতুলের কলেজে ভর্তি হবার পালা। রাতুল ঢাকায় ভালো একটি কলেজে চান্স পায়। বাংলাদেশের সেরা কলেজে চান্স পেয়েও রাতুলের মন খারাপ। ওই কলেজে পড়লে যে তাকে তিথিকে ছেড়ে থাকতে হবে।
কিন্তু তিথি রাতুলকে যেতে বলল। সে রাতুলকে অনুরোধ করে বলল, “তুমি ওই কলেজেই পড়বে। এতে তোমার-আমার জীবনটা আরো সুন্দর হবে। তুমি অনেক বড় হবে। আমি তোমার আছি, তোমারই থাকবো। মাঝে মাঝে রাজশাহী এসো, আমাকে প্রতিদিন ফোন দিও।”
অতঃপর সেই দিনটি চলে আসে, রাতুলদের রাজশাহী ছাড়ার দিন। তিথি, তিথির বাবা-মা আসে রাতুলদের বিদায় দেয়ার জন্য। তিথি রীতিমত কান্না শুরু করল।
রাতুলকে আশে-পাশে দেখতে না পেয়ে তিথি রাতুলের ঘরে গেল। গিয়ে দেখে রাতুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তিথি ডাকল, “রাতুল।”
রাতুল ফিরল না, কোন জবাবও দিলো না।
তিথি আবার ডাকল, “রাতুল, এই রাতুল!”
রাতুল নিঃশব্দ।
তিথি রাতুলের কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, “রাতুল!”
রাতুল বরাবরই নিঃশব্দ।
এবার তিথি রাতুলের হাত টেনে ওকে নিজের দিকে ফেরালো। তিথি দেখলো রাতুলের চোখে পানি টলমল করছে। তিথির চোখেও পানি এসে যাচ্ছিলো, কিন্তু নিজেকে সামলে নিল। চোখের ভেতরে সব পানি বন্দি করে রেখে দিয়েছে তিথি। রাতুলকে বিদায় দিয়ে নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে হয়তো সেই পানি গুলোকে মুক্ত করে দেবে। রাতুল কিছুক্ষণ তিথির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। শব্দহীন কান্না। এই কান্নার কষ্টটা একটু বেশী।
তিথি নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করে বলল, “কাঁদছো কেন? রাজশাহী থেকে ঢাকা কি বেশী দূর? তুমি তো প্রতি মাসেই আমাকে দেখতে আসবে, আমাকে প্রতিদিন ফোন দিবে।”
রাতুল চোখ মুছে বলল, “আমি তোমাকে একটা উপহার দিতে পারি?”
“দাও।”
রাতুল তিথিকে সুন্দর একটা প্যাকেট দিলো।
তিথি জিজ্ঞেস করলো, “এটা কি?”
রাতুল বলল, “এটাতে নুপূর আছে। তুমি যখন এই নুপূর পরে হাঁটবা তখন নূপুরের শব্দ আমার কাছে পৌছাবে। আমার মনে হবে তুমি আমার কাছে আসছো।”
তিথির চোখে পানি এসে গেল। তবু আটকে রাখার চেষ্টা করছে।
রাতুলদের গাড়ি ছাড়ল।
তিথির বুকটা যেনো ছিঁড়ে যাচ্ছে।
এই ছিল তিথি আর রাতুলের কিশোর বয়সের প্রেম। কিন্তু ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে রাতুল। রাতুলের নামের পাশে অন্যান্য মেয়েদের নাম যুক্ত হতে থাকে। একটা সময় তিথির নামটা রাতুলের নামের পাশ থেকে অনেক দূরে সরে যায়। রাতুলই সরিয়ে দেয়। রাতুল এভাবে বদলে যেতে পারে তিথি এটা কখনও কল্পনাও করে নি। তিথি আজো জানে না রাতুলের সেই পরিবর্তনের কারণ। যে ছেলেটা তাকে পাগলের মত ভালোবাসত সেই ছেলেটা কেন এমন বদলে গেল? কিছু কিছু পরিবর্তনের কারণ যে পরিবর্তন হয় সেও হয়তো জানে না। তিথি ফোন দিলে রাতুল ফোন ধরতো না। সারা রাত কল ওয়েটিং থাকতো। একটা সময় রাতুল নিজের মুখেই বলে ফেলে তার আরেকটা মেয়ের সাথে রিলেশন চলছে। তিথি অনেক ভেঙ্গে পড়ে। ধরে নেয় ঢাকায় লাল-নীল আলো আর আধুনিকতা তার রাতুলকে বদলে ফেলেছে। তবুও আশায় থাকে রাতুল একদিন তার ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসবে। অপেক্ষা করতে থাকে তিথি।
এর মাঝে কেটে যায় কয়েকটা বছর। তিথি রাহুলের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। রাতুল ভালো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেয়ে ইংল্যান্ড চলে যায়। এর পরের বছরই তিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায়। হলে উঠে তিথি। স্বাভাবিক নিয়মে জীবন চলতে থাকে তার। বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে তিথির জন্য। তিথি রাজি হয় না, ফিরিয়ে দেয়। অপেক্ষা করতে থাকে রাতুলের জন্য। কিন্তু রাতুলের কোন সাড়া নেই। এর কয়েকমাস পরই তিথি জানতে পারে রাতুল ইংল্যান্ড প্রবাসী এক বাঙালীকে বিয়ে করেছে। তিথির স্বপ্ন আর অপেক্ষা সব জলে ভেসে যায়। অনেক কষ্টে, সব দুঃখ বেদনা ভুলে গিয়ে পড়াশোনা করপ্লিট করে তিথি। রাতুলকে নিয়ে বাজে অভিজ্ঞতার পর ছেলেদের প্রতি তার একটা তিক্ততা চলে আসে তিথির। তবুও নারী হয়ে জন্মেছে, বিধে তাকে করতেই হবে। বাবার পছন্দে কোটিপতি বাবার একমাত্র ছেলে কামরানকে বিয়ে করে তিথি। বিয়ের কিছুদিন পর তিথি টের পায় কামরান পুরোপুরি ড্রাগ আসক্ত। বাইরে থেকে নেশা করে এসে কোন কারণ ছাড়াই তিথির সাথে খারাপ ব্যবহার করতো। তিথির গায়ে হাত তুলতো। পরিবারের সবাই মিলে নানাভাবে বিষয়টা সমাধানের চেষ্টা করে। কিনউত তাতে কোন কাজ হয় না। তিথি সিদ্ধান্ত নেয় সে একটা সন্তান নেবে। বাচ্চা পেয়ে কামরুন হয়তো ঠিক হয়ে যাবে এই আশায় সন্তান নেয় তিথি। তাদের বিয়ের দু’বছরের মাথায় জন্ম নেয় পৃথা। কিন্তু কামরানের নেশার প্রবণতা কিংবা তিথির উপর অত্যাচার কোন ভাবেই কমে না। বরং ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বাঙালী মেয়েরা এই ভুলটা প্রায়ই করে। যে লোক তার স্ত্রীকে সুখী করতে পারে না, সে কখনো একজন বাবা হতে পারে না। এই ভুলের প্রভাব সন্তানের উপর পড়তে থাকে। পৃথা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। নিজের চোখে বাবা কে নেশা করতে দেখে, মায়ের উপর অত্যাচার করতে দেখে। কামরানের নেশার বলি হয় স্ত্রী তিথি আর মেয়ে পৃথা এবং সেটা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। সব কিছুরই একটা সীমা থাকে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় তিথির। ডিভোর্স নিতে বাধ্য হয় তিথি। পৃথার বয়স যখন ৪ বছর তখন ডিভোর্স হয় তার বাবা-মায়ের। আদালতে দাঁড়িয়ে ছোট্ট পৃথা মা কে দেখিয়ে বলেছে সে তার মায়ের কাছে থাকবে। পুরুষ জাতির প্রতি দ্বিতীয় বারের মত ঘৃণা জন্মে তিথির।
তিথি একটা বাসা ভাড়া নেয়। নতুনভাবে জীবন যুদ্ধ শুরু হয় তিথির। এর মাঝে একটা চাকুরী পেয়ে যায় তিথি। পৃথাকে স্কুলে ভর্তি করায় সে। মোটামুটি ব্যস্ত হয়ে পড়ে তিথি। কিন্তু আশে পাশের মানুষ এবং পরিবেশ তাকে ব্যস্ত কিংবা ভালো কোনটাই থাকতে দিল না। অফিসে তার “ডিভোর্স” নিয়ে নানান মানুষ নানান কথা বলতো। তার আত্মীয় স্বজনরাও নানান কথা বলতো। ডিভোর্স নেয়ার চেয়ে বড় অপরাধ যেন ডিভোর্স নেয়ার পর একা একা জীবনযাপন করা। ডিভোর্স বিষয়টা যে কোন নারীর জন্য অভিশাপ স্বরূপ। কোন নারীই শেষ চেষ্টা না করে ডিভোর্সের মত বড় সিদ্ধান্ত নেয়না। তিথিও আগে ভাবতো মানুষ কেন ডিভোর্স নিবে। চেষ্টা করলেই তো সব ঠিক করা যায়। কিন্তু এখন সে ঠিকই বুঝতে পারছে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে একটা মেয়ে ডিভোর্স নিতে বাধ্য হয়। তিথি সমাজ এবং আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার নানান কথা, নানান উপদেশ, নানান মন্তব্যকে সহ্য করে যখন পৃথাকে নিয়ে নিজের মত করে বাঁচতে শিখছিল ঠিক তখন তার বাবা তাকে আরেকটা বিয়ে করার পরামর্শ দিল। পরামর্শ পর্যন্তই ঠিক ছিল কিন্তু বিষয়টা যখন অনুরোধের পর্যায়ে চলে গেল তখন তিথি কি করবে বুঝতে পারে না। পৃথিবীতে তিথির সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তার বাবা। সেই বাবাকে সে কবে বুঝাবে পৃথিবীর কোন পুরুষকেই সে আর বিশ্বাস করতে পারবে না। তিথি বুঝতে পারে তার জন্য বাবাকে সমাজের মানুষের কাছে বের হতে হচ্ছে। দোষ তিথি কাকে দেবে? সমাজ কে, তার ভাগ্যকে, নাকি নিজেকেই? কিন্তু কি এমন ভুল করেছিল সে যার জন্য সব দোষের বোঝা নিজে নিবে? রাতুলকে ভালোবাসা কি তার ভুল ছিল? কামরানকে বিয়ে করে সুখী হতে চাওয়াটাও কি তার ভুল?
পৃথিবীতে নিজের সুখের আশা ছেড়ে দেয় তিথি। তাই নিজের সুখের কথা, নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা নিজের ইচ্ছের কথা ভুলে গিয়ে সুখী করতে চায় এ সমাজকে। সে তো সবার কাছেই ছোট হয়েছে। তাই তার বাবাকে আর কারো কাছে নতুন করে ছোট হতে দিতে চায় না।
তিথিদের বাসার ড্রইং রুমে একজন ভদ্র লোক বসে আছেন। আহসান জামান। বয়স আনুমানিক ৩১-৩২ হবে। দেখে অনেক গম্ভীর মনে হয়। তিথি এসে ভদ্রলোক যে সোফায় বসা ছিল তার উল্টা পাশে বসল।
“কেমন আছেন”- তিথি জিজ্ঞেস করবে।
“জ্বি, ভালো, আপনি কেমন আছেন?”
“আমি আছি মোটামুটি”
“আপনার বাবা আমাকে আসতে বলেছিলেন”
“হুম বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে। আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।”
“জ্বি বলুন।”
“সাধারণত কোন অবিবাহিত ছেলে ডিভোর্সী মেয়েকে বিয়ে করে না। আপনি কেন আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন?”
ভদ্রলোক কোন কথা বলবেন না। উত্তর যে উনার জানা নেই।
“কিছু বলার নেই আপনার?” জিজ্ঞেস করে তিথি।
“আপনার বাবার মুখে আপনার জীবনের গল্প শুনে আপনার জন্য খারাপ লেগেছিল।”
“দেখুন আহসান সাহেব দয়া-মায়া-করুনা এসব দিয়ে সংসার হয় না।”
“ভুল বললেন। দয়া-করুনা দিয়ে সংসার না হতে পারে কিন্তু একটা সংসার টিকে থাকে কেবল ‘মায়া’র জন্য।”
কথাটা খুব ভালো লাগে তিথির। কিন্তু তবু নিজেকে আরো শক্ত করে আহসান সাহেবকে বলল, “আহসান সাহেব বাবার কাছ থেকে নিশ্চয়ই আমার অতীত সম্পর্কে জেনেছেন। বিয়ে, সম্পর্ক, সংসার এসবের প্রতি আমার একটা বাজে ধারণা জন্মেছে। আমার একটা মেয়ে আছে। তারও ‘বাবা’ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা আছে।”
“হুম সেটা আমি বুঝতে পারছি” সরল জবাব দেয় আহসান।
“তাহলে কেন আমাকে বিয়ে করে নিজের জীবনটাকে অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাবেন?”
চুপ করে থাকে আহসান সাহেব। তিথি তার নিরবতার অর্থ বুঝতে পারে।
“আপনি অনেক ভালো মেয়ে পাবেন। যে আপনাকে অনেক ভালোবাসবে। আমি হয়তো আপনাকে কখনোই ভালোবাসতে পারবো না।”
আহসান তিথির দিকে তাকায়। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে “তিথি আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আপনি অন্যের ভালো চান। তার মানে আপনি অনেক ভালো মানুষ। আমাকে ভালোবাসতে হবে না, বিশ্বাস করলেই হবে।”
আহসান সাহেব অনেক ভালো একটি বিষয় তুলে এনেছেন। বিশ্বাস! মানুষ যাকে ভালোবাসে তাকে হয়তো একটা সময় বিশ্বাস নাও হতে পারে। কিন্তু যাকে বিশ্বাস করে তাকে সবসময় ভালবাসতে পারে।
কিছুক্ষণ নীরব থাকবে দুজন। নীরবতা ভেঙ্গে তিথি বলে, “হয়তো আপনি কখনোই সুখী হতে পারবেন না। হয়তো আমাকে আর পৃথাকেও ভালো রাখতে পারবেন না। আমি আমার অতীতের বাজে স্মৃতিগুলো কখনোই ভুলতে পারবো না।”
“আপনার সব বাজে ধারণা পুরুষের প্রতি তো? আপনার বাবার কাছ থেকে জেনেছি। পৃথিবীতে আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ আপনার বাবা। আপনার বাবা আপনার মাকে যথেষ্ট ভালো রেখেছেন। আবার বাবাও কিন্তু একজন পুরুষ। পৃথিবীর সব মানুষ এক রকম হয় না।”
আহসানের এই কথাটা তিথির অনেক ভালো লাগে। অনেক সময় কোন মানুষের হাজারো কথা কারো মনকে ছুঁতে পারে না। কিন্তু আহসানের অল্প কিছু কথা তিথির খুব ভালো লাগলো। তবুও অনিশ্চয়তা তিথির পিছু ছাড়ে না। রাতুলও অনেক সুন্দর করে কথা বলতো, কামরানও বিয়ের আগে নিজেকে খুব ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ হিসেবে প্রকাশ করেছিল। সেদিন রাতে পৃথাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে নানান চিন্তার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল তিথি। পৃথার ‘মা’ ডাকে চিন্তার জগত থেকে ফিরে আসে তিথি।
“মা তোমার কি মন খারাপ?” পৃথার সরল প্রশ্ন।
“না মা, আমার মন খুব ভালো, তুমি ঘুমাচ্ছো না কেন?”
“মা সবার বাবা আছে। সবাই বাবার সাথে স্কুলে আসে। সবার বাবা অনেক ভালো। আমার কেন বাবা নেই?
পৃথার এই কথাটা তিথির বুকে গিয়ে লাগে। তার মেয়ে বাবার অনুপস্থিতি, বাবার প্রয়োজন অনুভব করছে।
“তোমার বাবা লাগবে?”
পৃথা মাথা নাড়িয়ে জানায় “হুম”
তিথি পৃথাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে।
“কিন্তু পচা বাবা না, ভালো বাবা।”
“আচ্ছা ঠিক আছে মা আমি তোমাকে ভালো বাবা এনে দিব।”
“ভালো বাবা কি তোমাকে বকা দিবে না?”
“না বকা দিবে না মা।”
“আমাকে বকা দিবে?”
“না তোমাকে একদম দিবে না, অনেক আদর করবে।”
তিথি পৃথাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা একটু শান্তিময় ঘুমের জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করে। কিন্তু সেই মূল্যবান মুহুর্তটির দেখা মিলে না। সামান্যতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় তিথির। অনেক ভাবার পর তার বাবার কথা ভেবে, পৃথার কথা ভেবে, নিজের অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও আহসানকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় তিথি।
প্রতিটা মানুষেরই স্বপ্ন থাকে তার বিয়েটা হবে খুব ধুমধাম করে। আজকালকার ছেলেদের দেরীতে বিয়ে করার অন্যতম কারণ ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করা। চাকুরী পাওয়ার ২-৩ বছর পর বিয়ে করে এখনকার ছেলেরা। এই সময়টা ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়। আহসানেরও ইচ্ছে ছিল তার বিয়ে হবে খুব ধুমধাম করে। কিন্তু তিথির অনুরোধে বিয়েটা হল খুব সাদামাটা ভাবে। আহসানের বাবা-মা বেঁচে নেই। বিয়েতে তার ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন যারা যারা এসেছিল সবাই সেই রাতেই অনুষ্ঠান শেষে যার যার বাসায় চলে যায়। সত্যি কথা বলতে কি আহসানের কোন আত্মীয় স্বজনের এই বিয়েতে মত ছিল না। সবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আহসান বিয়ে করে। তাই আহসানের বিয়েটাকে কেউ তেমন গুরুত্ব দেয়নি। সেই রাতে আহসান তিথি আর পৃথাকে নিয়ে নিজের বাসায় উঠে। তিথির বাবা পৃথাকে রেখে যেতে বলেছিল। ভেবেছিল নতুন বিয়ে করল। স্বামী-স্ত্রী দু’জন একা কিছু সময় কাটাক। কিন্তু আহসান নিজেই পৃথাকে নিয়ে আসলো। আর বলল, “আমি শুধু তিথির স্বামী নই, আমি তিথির স্বামী এবং পৃথার বাবা।”
কথাটা তিথির বাবা-মা এবং তিথিকে অনেক স্পর্শ করলো। পৃথা হয়তো এত কঠিন কথার অর্থ বুঝে উঠতে পারে নি। বুঝলে হয়তো তারও এই মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা জন্মাত। আহসানের বাসাটা খুব সুন্দর পরিপাটি। বোঝাই যায় না এই সংসারে এই প্রথম কোন নারী প্রবেশ করলো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে আহসান খুব গোছালো এবং শৌখিন মানুষ।
পৃথাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে তিথি। কিন্তু পৃথার যে আজ হাজারো প্রশ্ন।
“মা, এটা কার বাসা?”
“আমাদের বাসা।”
“আমরা কেন এখানে থাকবো?”
এমন সময় আহসান ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে বিছানায় বসে।
পৃথার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, “মা তোমার এই বাসা ভালো লাগছে?”
“না’’ পৃথার জবাব।
“কেন মা?”
“পুতুল নেই”
হেসে উঠে আহসান। “আচ্ছা বাবা কালই তোমার জন্য অনেকগুলো পুতুল নিয়ে আসবো।”
হঠাৎ পৃথার মনে হবে এই লোকটা কে তো চেনে না। তাই তার মাকে জিজ্ঞেস করে, “মা, এটা কে?”
এই প্রশ্নের তিথি কিছুটা বিব্রত হবে। তেমন কিছু না ভেবেই বলে ফেলল “তোমার বাবা।”
“এই বাবাটা পচা? আমাকে বকা দিবে?” আশংকা নিয়ে প্রশ্ন করে পৃথা।
“না মা এই বাবাটা তোমাকে অনেক আদর করবে। তোমার সাথে খেলবে।”
আহসানের দিকে তাকায় তিথি। আহসান যেন তিথির চোখে মায়া খুঁজে পা। যে মানুষটা দেখতে সত্যি অনেক মায়াবী হয় তাকে যে কারোই মায়া লাগে। কেউ মায়াটা নিজের করে নিতে পারে, কেউ পারে না।
পৃথা আরো অনেকগুলো প্রশ্ন করতে থাকে। তিথি আর আহসান সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে। একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে পৃথা। আহসান আর তিথি বারান্দায় গিয়ে বসে। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর তিথিই প্রথম কথা বলে, “আজকের আকাশটা সুন্দর।”
“হুম, কিন্তু আপনার যদি মন আরো ভালো থাকতো তাহলে আকাশটাকে আরো বেশী সুন্দর লাগতো।”
“মানে বুঝলাম না।”
“আপনার যদি মন অনেক বেশী খারাপ থাকতো তাহলে এই একই আকাশকে আপনার কুৎসিত লাগতো। আর যদি মন অনেক বেশী ভালো থাকতো তাহলে আজকে আকাশটাকে আপনি অনেক সুন্দর বলতেন। আমাদের সব কিছুই মনের নিয়ন্ত্রণে।”
“আপনি তো অনেক গুছিয়ে কথা বলতে পারেন।”
“আপনার গোছানো, কথা ভালো লাগে?”
“হুম।”
“তাহলে এখন থেকে গুছিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করবো।”
মৃদু হাসবে তিথি। সেই রাতের অনেকটা সময় তারা বারান্দায় পাশাপাশি বসে কাটিয়েছে। দু’জন দু’জনের উপস্থিতি অনুভব করেছে। কিন্তু কথা হয়েছে খুব কম। মাঝরাতে তারা ঘুমাতে যায়।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তিথি দেখে সকালের নাস্তা রেডি। আহসান সব নিজের হাতে বানিয়েছে।
তিথি একটু দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করলো, “নতুন বিয়ে করেছেন, এই জন্যই কি এতসব?”
“আরে নাহ। আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। অনেকদিন ধরে সকালে নিজে ব্রেকফাস্ট বানাই।”
“আজ আপনার অফিস নেই?”
“বিয়ে করলে অফিস ৫ দিনের ছুটি দেয়। সেই ছুটিতে আছি।”
তিথি নিজের অতীতের বাজে অভিজ্ঞতাগুলোকে ভুলে বর্তমানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাচ্ছে।
সুখের আশা আর করে না তিথি। কিন্তু একটু ভালো থাকতে চায় সে। আহসানকে নিয়ে, পৃথাকে নিয়ে।
“সুখ এমন একটা বিষয় যেটার পেছনে মানুষ প্রতিনিয়ত ছুটছে। কিন্তু সুখটা বোধহয় প্রজাপতির মত। তাকে ধরতে গেলে সে পালিয়ে যাবে। কিন্তু তুমি অন্য কিছুতে মনোযোগ দিয়ে সে হয়তো নিঃশব্দে তোমার কাঁধে এসে বসবে।”
তিথি, আহসান, পৃথা তিনজন এক সাথে সকালে নাস্তা করে। আহসানের গাড়ি ছিল না। ভেবেছিল ২-৩ বছর পর কিনবে। কিন্তু তার বিয়েতে তেমন কোন খরচ হয়নি। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য আহসানের জমানো প্রায় সব টাকাই রয়ে যায়। সেই টাকা দিয়ে গাড়ি কেনার পরিকল্পনা করে আহসান। গাড়ি কিনতে যায় তিনজন, সাথে আহসানের অফিসের একজন কলিগ, সবকিছু ঠিক করার পর বাধলো গাড়ির রং নিয়ে। আহসানের পছন্দ সাদা রং, তিথির কালো। কিন্তু আহসান তিথির পছন্দকে পেছনে ফেলে জয়ী হয় পৃথার লাল রঙের গাড়ি। পৃথার চেয়ে বেশী খুশি হয় তিথি। আহসান পৃথাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে ভেবে তিথির অনেক ভালো লাগে। আগের কুৎসিত অভিজ্ঞতাগুলোকে ভুলে আহসানের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মাচ্ছে তার।
আহসান আগে থেকেই ড্রাইভিং জানতো। নতুন গাড়ি নিয়ে বাসায় আসে তারা। আসার সময় পৃথার জন্য অনেকগুলো পুতুল, খেলনা কিনে আনেন।
ধীরে ধীরে তিথির পুরো মনোযোগ চলে যায় আহসানের প্রতি। অতীতের বাজে অভিজ্ঞতাগুলোকে ভুলতে শুরু করে তিথি। এরই মাঝে তারা “আপনি আপনি” থেকে “তুমি তুমি” তে রূপান্তরিত হয়েছে।
একদিন তিথি খুব বিনয়ের সুরে আহসানকে বলে বসল, “আমরা কিন্তু কোন সন্তান নিব না, পৃথাই আমাদের একমাত্র সন্তান।”
তিথি ভেবেছিল আহসান হয়তো রাজি হবে না। কিংবা মন খারাপ করবে কিন্তু তাকে আবারো অবাক করে দিয়ে আহসান বলে, “ঠিক আছে।”
তিথি এই মানুষটাকে যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে, মুগ্ধ হচ্ছে। পৃথিবীতে কত রকমের মানুষ আছে। কেউ রাতুলের মত, কেউ কামরানের মত। কিন্তু আহসানের মত কতজন আছে? খুব জানতে ইচ্ছে করে তিথির।
কিছুদিন পর তিথি আবার জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা আমি কি চাকুরীটা করবো না?”
“সেটাও তোমার ইচ্ছা” জানায় আহসান।
“তোমার কিছুই বলার নেই?”
“না, তুমি হলে ছিলে, এরপর কিছু খারাপ সময় পার করে এসেছো। নিজেকে এমদম সময় দিতে পারনি। তাই যদি সাজেশান চাও তাহলে বলবো তুমি কিছু দিন নিজেকে সময় দাও। সংসারটা নিজের মত করে গুছিয়ে নাও। পৃথাকে এই পরিবেশে মানিয়ে নাও। তারপর তোমার ইচ্ছে হলে চাকুরী করো।”
তিতি লক্ষ্মী বউয়ের মত উত্তর দেয় “আচ্ছা।”
এভাবে চলতে থাকে তাদের দিনগুলো। তিথির এখন আর মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গে না, কোন কিছু নিয়ে টেনশন হয় না, বাজে অধ্যায়গুলো তাকে আর নাড়াতে পারে না।
অফিসে কাজের চাপ বাড়তে থাকে আহসানের। ব্যস্ততা বাড়তে থাকে তার। কিন্তু তার মাঝেও তিথি কি করছে? পৃথা কি করছে, খেয়েছে কি না এসব খবর নিতে একদম ভুল করে না আহসান। তিথি ভেবেছিল প্রথম প্রথম এত কেয়ার করছে শুধুমাত্র নতুন বউ বলে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা আরো বাড়তে থাকে। আহসানের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা দিন দিন বাড়তে থাকে তিথির।
হঠাৎ একদিন প্রচন্ড জ্বর আসে তিথির। মায়ের জ্বর দেখে কাঁদতে শুরু করে পৃথা। পৃথাকে ঘুম পাড়িয়ে সারারাত তিথির মাথায় পানি দিয়েছে আহসান। সারারাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে আহসান। সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গে যখন দেখলো আহসান বিছানায় বসে বসে ঘুমাচ্ছে তখন তিথি ঠিকই বুঝতে পারলো এই মানুষটা তাকে কত ভালোবাসে। তিথি আহসানকে না জাগিয়ে তার হাতটা বুকে জড়িয়ে ধরে। নিজের অজান্তেই চোখে পানি এসে যায় তিথির। এমনই একদিন জ্বর এসেছিল তিথির। সেদিন সে কামরানকে বলেছিল, “তুমি ফেরার পথে কিছু ঔষধ নিয়ে এসো, আমার অনেক জ্বর আসছে।” কামরান ঘরে ফিরে ঠিকই তবে ঔষধ হাতে না, মদ হাতে।
আহসান আর কামরান দু’জনই মানুষ। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। কিন্তু কত ব্যবধান, পার্থক্য। তিথি বুঝতে পারে তার যাকে প্রয়োজন ছিল সৃষ্টিকর্তা তাকেই তার কাছে পাঠিয়েছেন। হয়তো একটু দেরী করে।
পৃথা তার বাবাকে নিয়ে মহা খুশি। মায়ের চেয়ে বাবাকে নিয়েই তার জগৎ। কিছুক্ষণ পরপর বাবাকে ফোন দিয়ে বলে। বাবা কি করো? এই একটা প্রশ্নের উত্তর আহসানকে দিনে কমপক্ষে ১০-১২ বার দিতে হয়। পৃথার খুব শখ বাবার মত সে নিজে গাড়ি চালাবে। বাবারও খুব ইচ্ছে মেয়ের পাশে বসে অফিসে যাবে। আর একটু বড় হলেই ড্রাইভিং শেখাবে পৃথাকে।
তিথির বাবা-মা খুব খুশি মেয়েকে সুখী দেখে। একজন বাবা কিংবা মায়ের একমাত্র চাওয়া “আমার সন্তান যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক।” তিথিকে ভালো থাকতে দেখে তার বাবা একদিন তিথিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে “এখন মরে গেলেও আমার দুঃখ নেই।”
তিথি কান্না থামিয়ে বলে, ‘‘তুমি মরবে কেন বাবা? তোমার কিছু হলে পৃথাকে কে বিয়ে দিবে?”
সবাই হেসে উঠে।
পৃথার মন খারাপ হয়। কারণ “সে বিয়ে করবে না।”
পৃথার কড়া জবাব “আমি বিয়ে করবো না। আমার বিয়ে করতে ভালো লাগে না।”
আহসান পৃথাকে কোলে নিয়ে বলে, “ওরে আমার বাবাটারে, কয়টা বিয়ে করেছেন আপনি, যে আপনার আর বিয়ে করতে ভালো লাগে না?”
পৃথা উত্তর দেয় “১২টা।”
সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে। এই মুহুর্তে এই ঘরের প্রতিটা মানুষ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ দাবি করতেই পারে।
দেখতে দেখতে কেটে যায় একটি বছর। বিয়ের অনুষ্ঠানটা ধুমধাম করে করতে পারে নি তিথির অনুরোধে। কিন্তু এবার তিথি নিজেই বলল প্রথম বিবাহ বার্ষিকীটা খুব ধুমধাম করে করবে। শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি, শপিং, ঘর সাজানো। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, কলিগ সবাইকে দাওয়াত দেওয়া। পৃথাও বাবা-মায়ের বিবাহ বার্ষিকী নিয়ে মহা খুশি। হয়তো সে বিবাহ বার্ষিকীর কিছুই বুঝে না। কিন্তু এইটা খুব মজার কিছু হবে সেটা বুঝতে পারে।
বার্ষিকীর রাতে আহসান তিথিকে একটা রিং পরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে “তিথি আমি কি তোমাকে ভালো রাখতে পারছি?”
তিথি মুখে কোন উত্তর না দিয়ে আহসানের বুকে মাথা রাখে। আহসানের বুকে মাথা রেখে তিথি একদম শান্ত হয়ে যায়। আহসান তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায়।
এমন একজন স্বামী, এমন একটি সংসার সম্ভবতো সব মেয়েরই প্রথম চাওয়া।
নানান আয়োজনের মাধ্যমে শেষ হয় আহসান আর তিথির প্রথম বিবাহ বার্ষিকী।
পৃথার খুব মন খারাপ। সবাই গিফট করছে ‘বড়দের জিনিস’ কেউ পুতুল, খেলনা গিফট করছে না।
“পৃথা মনির কি মন খারাপ?” জিজ্ঞেস করে আহসান।
“হুম”
“কেন?”
“কেউ আমাকে গিফট করে নি।”
আহসান বিছানা থেকে উঠে বলে “চলো বাবার সাথে চল।”
“কোথায়।”
“আরে আসো তো, মাকেও আসতে বলো।”
“মা, আসো” পৃথা তিথিকে ডাকে।
আহসান, তিথি, পৃথা ড্রইং রুমে যায়। ড্রইংরুমে গিয়ে অবাক হয়ে যায় পৃথা। পৃথার সাইজে বড় একটা বারবি ডল পৃথার পাশে রেখে আহসান বলে, “এটা তোমাকে তোমার মা গিফট করেছে।” তিনি অবাক হয়ে বলে, “আমি কখন কিনলাম এটা। আমি তো কিছুই জানি না।”
আহসান চোখের ইশারায় তিথিকে চুপ থাকতে বলে।
আহসান একটা চার চাকার লাল রঙের সাইকেল এনে পৃথাকে দিয়ে বলে ‘‘আর এটা দিলাম বাবা।”
পৃথা খুশিতে লাফাতে থাকে। পৃথার চেয়ে বেশী খুশি তার মা তিথি। পৃথিবীর সবচাইতে ভালো মানুষটি হয়তো তার স্বামী। এটা ভেবে খুশিতে তার পৃথার মত লাফাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তিথি তো আর বাচ্চা মেয়ে না। তাই মনে মনেই লাফাচ্ছে। কখনো কখনো আনন্দ জিনিসটা মানুষকে বাচ্চাদের মত আচরণ করতে বাধ্য করে।
পৃথাকে সাইকেল দেয়াতে মহা বিপদে পড়লো তিথি। সারাক্ষণ সাইকেল চালাতে চায় পৃথা। বিরক্ত হয়ে যায় তিথি। কিন্তু আহসান মেয়ের সাইকেল চালানোর আগ্রহটা বেশ উপভোগ করে। ড্রইংরুমের সোফাগুলো সব একপাশে রেখে মেয়ের জন্য সাইকেল চালানোর জায়গা করেছে আর বিকেলে অফিস থেকে ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে পৃথাকে নিয়ে আর তার প্রিয় সাইকেল নিয়ে ছাদে উঠে। মেয়ে ছাদে পরম আনন্দে সাইকেল চালায়। বাবা দেখে আর মেয়ের আনন্দে নিজে খুশি হয়।
আচ্ছা সব বাবারাই কি আহসানের মত হয়?
ধীরে ধীরে সময় কাটতে থাকে। তিথির জীবন থেকে তার অতীতের দুঃস্বপ্নের মত দিনগুলোর ছায়া সরে যেতে থাকে। তিথির ধারণা বদলাতে থাকে। তিথি বুঝতে পারে মানুষের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় একরকম না। কোন অধ্যায় বিষাদময়, অনেক কষ্টের, আবার কোন অধ্যায় অনেক সুখের, অনেক আনন্দের। কামরানের সাথে থাকাকালে তিথির মনে হত পৃথিবীর সব ছেলেরাই রাগী, বদমেজাজী। কিন্তু আহসানকে পেয়ে তার সব ধারণা বদলে যাচ্ছে। তিথির ধারণা সে কখনো কোন অন্যায় করলেও আহসান তাকে কিছু বলতে পারবে না। এটা আহসানের দূর্বলতা নয়, ভালোবাসা।
আহসানের প্রচন্ড মাথা ব্যথা, ঘুমাচ্ছে সে। তিথি আহসানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আহসানকে না পেলে তিথির কাছে জীবনের সবচেয়ে ভালো অধ্যায়টাই হয়তোবা অজানা থাকতো।
তিথি নিজেই আহসানকে বলেছিল তারা কোন সন্তান নিবে না। পৃথাই তাদের একমাত্র সন্তান। আহসানও খুব সহজভাবে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। কিন্তু আজ তিথির আবারো মা হতে ইচ্ছে করছে। একটা ছেলে সন্তানের মা। যে হবে পুরোপুরি আহসানের মত।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। অঝোর বৃষ্টি। বৃষ্টি আহসানের অনেক পছন্দ।
“আচ্ছা এখন কি আহসানকে জাগানো উচিৎ?” তিথি যখন এই ভাবছে ঠিক তখন পৃথা দৌড়ে এসে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠে “বাবা উঠো, অনেক বৃষ্টি।”
ছোট্ট পৃথাও বাবার অতি পছন্দের বিষয়টির কথা ভুলে নি।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে আহসান, তিথি আর পৃথা।
জীবনটা সত্যিই অনেক সুন্দর।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



