দ্বিতীয় শ্রেণী পাওয়া এক ছাত্রীকে নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম করা হয়েছে। ওই ছাত্রীকে প্রথম করতে গিয়ে দুই নম্বর বাড়ানোর পর আরও তিন নম্বর গ্রেস দেওয়া হয়েছে। এই অন্যায় করতে গিয়ে শতাধিক শিক্ষার্থীর ফল পাল্টাতে হয়েছে। প্রথম হওয়া ওই ছাত্রী এখন একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
বিস্ময়কর এ ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এমএ পরীক্ষায়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত শিক্ষকেরা অপরাধ স্বীকার করেছেন। শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, ওই বিভাগের অনার্স পরীক্ষায় আরেক ছাত্রকে প্রথম শ্রেণী পাইয়ে দিতে চতুর্থ বর্ষে এসে অস্বাভাবিক রকম বেশি নম্বর দেওয়া হয়েছে। ওই ছাত্রের প্রথম তিন বছর প্রথম শ্রেণীর নম্বরের চেয়ে ৪২ নম্বর কম ছিল। চতুর্থ বর্ষে এসে সেই নম্বর দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পরীক্ষায় অনিয়ম তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া যায়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এটি পাঠানো হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা উপকমিটিতে। উপকমিটির আহ্বায়ক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর। পাঁচ সদস্যের এ উপকমিটির সদস্য-সচিব পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। এ ছাড়া উপাচার্য মনোনীত দুজন এবং আইন অনুষদের ডিন এর সদস্য।
কয়েকজন শিক্ষকের অভিযোগ, তদন্ত প্রতিবেদনের পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে একটি মহল। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক নুরুর রহমান খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তদন্তে যা পেয়েছি, সেটি উচ্চপর্যায়ের কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে আমি এখন কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
শৃঙ্খলা উপকমিটির আহ্বায়ক প্রক্টর কে এম সাইফুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলা বিভাগের ফলাফল নিয়ে অনিয়মের বিষয়টি আমাদের কাছে এসেছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। এর সঙ্গে জড়িত সব শিক্ষকের বক্তব্য নেওয়া হবে।’
কমিটির কাজ শুরু: শিক্ষকদের বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড, অতিরিক্ত নম্বর প্রদান, প্রাইভেট টিউশনির মাধ্যমে পরীক্ষার ফলাফলে শিক্ষকদের প্রভাব বিস্তার, শিক্ষার্থীদের দিয়ে কোর্সবহির্ভূত অ্যাসাইনমেন্ট করানো ও ওই সব রচনা নিজের নামে প্রকাশ, উপহার গ্রহণের মাধ্যমে পাঠদান, কোচিং সেন্টারে শিক্ষকদের ক্লাস নেওয়া ইত্যাদি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১০ মার্চ ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটি বৈঠক করে ২০০১ সালের পর অনুষ্ঠিত সব কটি অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষার ফল বিন্যাসপত্র নিরীক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক, সিরাজুল ইসলাম ও হোসনে আরাকে নিয়ে একটি উপকমিটি করা হয়।
শতাধিক ছাত্রের ফল পরিবর্তন: কমিটি কাজ করতে গিয়ে ২০০৩ সালের এমএ পরীক্ষার ফল বিন্যাসপত্রে গুরুতর অনিয়ম খুঁজে পায়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৩ সালে যে ছাত্রীকে (রোল-১৮১) প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান দেওয়া হয়, তিনি আসলে দ্বিতীয় শ্রেণী পেয়েছিলেন। মোট এক হাজার নম্বরের মধ্যে তিনি পেয়েছিলেন ৫৯৫। তাঁকে প্রথম করার জন্য শতাধিক শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ছাত্রীকে প্রথম শ্রেণী দিতে গিয়ে ৫০৩ নম্বর কোর্সের অনুশীলনী ও ইনকোর্স পরীক্ষার আগের নম্বর কেটে উভয় ক্ষেত্রে এক নম্বর করে মোট দুই নম্বর বাড়িয়ে ৫৯৭ করা হয়। এরপর তিন নম্বর গ্রেস দিয়ে প্রথম শ্রেণী দেওয়া হয়।
শৃঙ্খলা কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ওই ছাত্রীকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম করার জন্য ৫০৩ নম্বর কোর্সে প্রথমবার যে নম্বর দেওয়া হয়েছিল, সেটিও অস্বাভাবিক ছিল। কিন্তু দ্বিতীয়বার আবার সেই নম্বর কেটে আরও বাড়ানো হয়। এই পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আহমদ কবির। সদস্য ছিলেন এস এম লুৎফুর রহমান ও মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন। বাইরের সদস্য ছিলেন মনিরুজ্জামান।
বাংলা বিভাগের একজন শিক্ষক জানান, আগের ও পরের দুটি ফলবিন্যাস নিরীক্ষণ করে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের যে সদস্য ফল তৈরির কাজে জড়িত ছিলেন, একটি ফল বিন্যাসপত্রে তাঁর সই ছিল না। পরে তাঁর সই নেওয়া হয়। তার পরও দ্বিতীয় ফল বিন্যাসপত্রে তাঁর সই ছিল না।
চতুর্থ বর্ষে অস্বাভাবিক নম্বর: তদন্ত কমিটি ২০০৭ সালের বিএ অনার্স পরীক্ষার ফল তৈরির ক্ষেত্রেও অনিয়ম খুঁজে পায়। ওই পরীক্ষায় যে ছাত্রকে (রোল নম্বর-১৩৬) প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় করা হয়, প্রথম থেকে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত তাঁর প্রথম শ্রেণীর নম্বর ছিল না। কিন্তু চতুর্থ বর্ষে এসে তাঁকে অস্বাভাবিক রকম বেশি নম্বর দেওয়া হয়েছে।
এই ছাত্রকে ৪০৭ ও ৪০৮ কোর্সে অতিরিক্ত নম্বর দেওয়া হয়। এ দুটি কোর্সে প্রথম শ্রেণীর নম্বরের চেয়ে তিনি অতিরিক্ত ৪২ নম্বর পেয়েছেন। ওই পরীক্ষার ৪০৭ নম্বর কোর্সের শিক্ষক ছিলেন মুহাম্মদ শাহজাহান মিয়া এবং ৪০৮ নম্বর কোর্সের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষক ছিলেন মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন। এই পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
অভিযুক্ত শিক্ষকদের বক্তব্য: মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন তদন্ত কমিটির কাছে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো স্বীকার করেন এবং কমিটির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজি হন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তদন্ত কমিটির আহ্বানে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম। কিন্তু তারা যে আমাকে এ কারণে ডেকেছিল, সেটি আগে জানানো হয়নি। এটি কয়েক বছর আগের ঘটনা। আমার যা বলার তদন্ত কমিটির সামনে বলেছি। যা করা হয়েছে, কাগজপত্রের ভিত্তিতেই করা হয়েছে। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই।’
আরেক শিক্ষক আহমদ কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি পাঁচ-সাত বছর আগের বিষয়। কর্তৃপক্ষ এখনো আমাকে ডাকেনি। ডাকলে আমি যা বলার তাদেরই বলব।’
অতীতের ঘটনা: এর আগে ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ৫২ জনকে প্রথম শ্রেণী দেওয়া নিয়ে বড় ধরনের অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এ ছাড়া অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষের মাস্টার্সের ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এই পরীক্ষার ফল নিয়েও ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র আপত্তি রয়েছে।
সূত্র : প্রথম আলো।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




