somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ষ্টেশন অস্কার

১১ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





দুপুর ঠিক আড়াইটায় প্রায় জনমানবহীন রেল ষ্টেশনে নেমে খানিকটা বোকা হয়ে গেলাম, ষ্টেশনের নাম অস্কার, ওসলো থেকে খানিকটা আগের সাবার্ব ষ্টেশন।শুধু বোকা বললে ভুল হবে, খানিকটা ভীত ও হয়ে গেলাম। নরওয়ের শুনশান নীরবতার সাথে আমার পরিচয় এই প্রথম । এই ষ্টেশনে আমার জন্য রিসেল এস্ত্রেরার অপেক্ষা করার কথা, রিসেল কে আমি এতোদিন শুধু ল্যাপ্টপের পনের ইঞ্চি মনিটরেই দেখেছি,আজকে জ্বলজ্যান্ত প্রথম দেখার কথা।
কোন অচেনা জায়গায়, অদেখা কারো জন্য অপেক্ষা করতে হলে কি ধরনের ড্রেস পরতে হয় আমার জানা নেই, তবে আমি লন্ডনের মধ্যবিত্তদের চেইন ষ্টোর প্রাইমার্ক থেকে আমার ক্ষমতার সর্বোচ্চ দামের পোষাকই কিনে এনেছি।
আমি এখন সেই ড্রেস পড়ে হাতের নোকিয়া এন ৯৫ দিয়ে আশে পাশের সব কিছুর ছবি তুলে যাচ্ছি। ঘড়ির কাটা ইতিমধ্যে সাড়ে তিনটা পেরিয়ে গেলো,এক অচেনা অণুভুতিতে আমার গলার ভেতর টা খসখস করছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যা করা উচিত তাই এখন করতে হবে অর্থাৎ গলাটা ভেজাতে হবে।ষ্টেশনের ভেতরের কিয়ষ্ক থেকে কিছু পাউন্ড চেঞ্জ করে, ক্রোনার দিয়ে গলা ভেজাবার দামী পানীয় হাতে নিয়ে ফিরে আসলাম সেই একাকী কাঠের বেঞ্চে, যেখান থেকে ষ্টেশনের ভেতর - বাহিরটা প্রায় দেখা যায়।
অপেক্ষা করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম,হঠাত কারো স্পর্শে ঘুম থেকে চমকে উঠে গেলাম।
আমি আগেই জানতাম, রিসেলের চেহারা তেমন আহামরি কিছু নয়, বরং তার সাথে পরিচয়ের ঘটনাটা খুবই আহামরি টাইপের।
লন্ডনে আমার ফ্ল্যাটমেট কুতুবদিয়ার ছেলে..... প্রামাণিক তার জীবনের প্রথম ল্যাপ্টপ নিয়ে লন্ডনে আসছে, সেই ল্যাপ্টপের ইয়াহু মেসেঞ্জার কাজ করছিলো না। ফ্ল্যাটের টেকি বড় ভাই হিসেবে আমাকে অনুরোধ করে ম্যাসেঞ্জারটি ঠিক করে দেওয়ার জন্য।
ম্যাসেঞ্জার আন ইনষ্টল করে, আবার ইনষ্টল করে নিলাম।তখুনি চোখে পড়লো রিসেল এস্ত্রেরার আইডি। প্রামাণিক কে অযোচিতভাবেই জিজ্ঞাসা করে জানলাম,সে নিজে ও জানেনা এই আইডির খবর। কি মনে করে যেনো এই আইডির অধিকারীণিকে নক দিলাম, সাথে সাথেই ফিরতি উত্তর।
ইয়াহু মেসেঞ্জার থেকে সেই রিসেল কে জ্বলজ্যান্ত দেখার মাঝের ঘটনা বেশ দীর্ঘ এবং এই দীর্ঘ ঘটনা আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে লন্ডন থেকে স্যান্ডিফোর্ড এয়ারপোর্ট আর এই অস্কার ষ্টেশন পর্যন্ত।ষ্টেশনের এই কাঠের বেঞ্চিতে আধা শোয়া, আধা ঘুমন্ত আমি, আবার ও এক নরম, মোলায়েম সুগন্ধী ঘ্রাণে অস্কার ষ্টেশনে ফিরে এলাম, ফিরে এসে আমার কাধ স্পর্শ করা মানুষটির হাত ঘুরিয়ে সামনে এনে, পাশে বসালাম। দেখলাম এক খাটি বাংগালীর সামনে বসে আছে, খানিক মংগোলীয়, খানিক চৈনিক মিশ্রণের রিসেল এস্ত্রেরা।খানিকটা নার্ভাস রিসেল কেনো জানি ভীরু কবুতরের মতোন তিরতির করে কাপছিলো।
আমাদের মাঝে অনেক ক্ষণ কোন কথাই হয়নি।
মাঝে একবার সে অস্ফুটে বলেছিলো Was it real?

অস্কার ষ্টেশন থেকে আমার বুক করা হোটেল টি ৩০ মিনিটের দূরত্বে। এক আপেল বাগানের পড়ে থাকা অসংখ্য আপেলের মাঝের এক বিষণ্ণ প্রাসাদ - এটি এখন হোটেল।
নিশীথ সুর্যের দেশ নরওয়েতে আমি সূর্য দেখতে আসিনি, আমি এসেছি এক অনাগত, ভীরু ভালোবাসাকে খুব কাছে থেকে স্পর্শ করতে। হয়তো সে কথা মনে রেখে ,সে আমাকে হাতে ধরে হোটেলের প্রান্তরের পাহাড়ের ঢালে নিয়ে এলো। রিসেল ইংরেজীতে খুব পারদর্শী না, পাশাপাশি বসে যে সব কথা সে ইংরেজীতে বুঝাতে পারছিলো না, সেসব কিছু বলছিলো তার নেটিভ টাগালোগ ভাষায়, আর বাকী সব কথা গুলা সে বুঝাতে চাচ্ছিলো খুব অদ্ভুতভাবে।
আমার বাম হাত তার দুহাতের ভাঁজে রেখে কি কি সব বলতে বলতে তার চোখে বেশ কয়েকবার স্পর্শ করালো। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, রিসেলের চোখ পানিতে বারবার ভিজে যাচ্ছে। আমার সামনে রাত্রে সাড়ে আটটার ডুবন্ত সূর্য্য, এক অদ্ভুত ঘোর লাগা বিকেল, এক মোহময় প্রায় গোধুলী, আমি রিসেলের হাতের মাঝে থেকে জানি, আমার এই ক্ষুদ্র এক কালীন জীবনে এই মূহূর্তটি আর কখনো ফিরে আসবেনা। আমি চোখ বন্ধ করে একটি ভীরু কবুতরের মত তরতর করে কাপা শরীরটাকে যখন বুকের ভাজে নিলাম, আমি তখন ও জানি, এই জীবনে রিসেল কখনোই আমার হবে না। সন্ধ্যার ভিজে লাগা ওই সময়ে আমাদের চার পাশ থেকে যেনো কচুরিপানার সোঁদা সোঁদা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিলো, রিসেল কে তীব্রভাবে বুকে চেপে ধরে আমি জেনে ছিলাম ,
নীড়ের পাখি নীড়েই ফিরে যাবে।রিসেল কে বুকে চেপে ধরে অযোচিত এবং যুক্তিহীনভাবেই আমার বারবার কেনো জানি মনে আসছিলো লন্ডনের এপার্টমেন্টের ড্রয়ারে রাখা আমার অতি প্রিয় ফ্যামিলি ফটোটাকে, যেখানে আমি আমার স্ত্রীর পাশে, ছেলেটিকে পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে আছি।

অস্কারে আমার আর কখনোই যাওয়া হয়নি।
ফিলিপাইনের এক প্রত্যন্ত শহর চেবুর বালিকা রিসেল এস্ত্রেরা 'অর পার ' এর কাজ শেষে আমাকে মনে হয় অনেক খুঁজেছিলো। লন্ডনে ফিরে আসার পর বার দুয়েক তার চিঠিও পেয়েছিলাম,বছর তিনেক পরে এক ক্রিস্মাসে সে পাঠিয়েছিলো আমার পছন্দের ব্লু কালারের এক মোলায়েম কম্ফোর্টার, সে মনে রেখেছিলো ঠান্ডায় আমার গলায় সমস্যা হয়। এমনকি নরওয়েতে তার বিয়ের দিন ও সে আমাকে স্মরণ করেছে তার মেইল একাউন্টে।তাকে মনে করার আমারও খুব ইচ্ছে ছিলো বটে , কিন্ত কেনো যে মনে করে রাখতে পারিনি , সে কথা এখন আর স্মরণও করতে পারিনা ।

আমার পরিষ্কার মনে আছে, মেইলের এটাচমেন্ট ফাইলে রিসেলের সাদা গাউন পরা গীর্জার আইল ধরে হেঁটে যাওয়া ছবি দেখে অনেক আনমনা হয়ে গেছিলাম , সেই মন খারাপ করা নির্জন দুপুরে আমিও প্যান্টের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে, ষ্ট্রাটফোর্ড থেকে প্রচন্ড ঠান্ডার ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে হোয়াইট চ্যাপেল মুখী দীর্ঘ পথে চলে গেছিলাম, একা এবং নি:সংগ ।

ভালোবাসার সেই দীর্ঘ মনন যুদ্ধে আমি কি জয়ী হয়েছিলাম, না কি পরাজিত হয়েছিলাম - সেটি জানার জন্য , আমার অতিরিক্ত যে জীবন টির দরকার ছিলো, সেটিও আর পরে পাইনি , কারণ অজস্র হাহাকারের ভেতরে আমি ততোদিনে জেনে গেছি মানুষ তার সারা জীবনে,বাঁচার মতোন শুধু একটাই জীবন পায়!
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩২
১৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×