আমার এই ভ্রমণ কাহিনী মূলক সিরিজটা শুরু হয়েছিল দীর্ঘ আটমাস আগে । আজ এই যাত্রার শেষ পর্ব । গত পর্ব যেখানে শেষ করেছিলাম সেখান থেকে আসি ।
ঘুম ভাঙল ভোর ছটায় । বলা চলে ভাঙার চেয়ে ভাঙানো হল । কেননা এটাই ছিল আমাদের প্রথম ট্রাকিং । আমরা ঠিক জানতাম না বগা লেক থেকে হেটে রুমা বাজারে পৌছাতে আমাদের কত সময় লাগবে । তাই আমরা চাচ্ছিলাম যত দ্রুত উঠে খেয়ে নিয়ে রওনা হওয়া যায় ।
তো আমরা খেতে গেলাম সিয়াম বমের হোটেল এবং বাসায়, সেখানে খাওয়া দাওয়া সারলাম সাড়ে সাতটার ভিতরে । খাওয়া শেষে আমরা কিছুক্ষণ বসে এর পরে রওনা দিলাম ।পাহাড়ী জনগোষ্ঠী পানি রাখবার জন্য বিচিত্র এক ধরণের পাত্র ব্যবহার করে । এটা দেখতে এরকম ।
সুন্দর তাই না ?
আমরা রওনা দিলাম আটটার দিকে । প্রথমে একটু জোর কদমে হাটলাম কারণ যতক্ষণ দেহ পূর্ণ সতেজ থাকে ততক্ষণ একটু দ্রুত হওয়াই ভাল ।
সকাল আটটার সময়েও আমরা আসবার দিনের মতো ধোয়া ধোয়া মেঘের দেখা পাই । খুবই সুন্দর লাগে এটা দেখতে ।
আরো সময় গড়াল । পরিষ্কার হয়ে আসছিল সব, কেটে যাচ্ছিল মেঘ । কিছু দূর সামনে এগুতেই চোখে পড়ল অচল অটল সবুজ গিরিধার । সত্যি সুন্দর যেন এখানে গড়াগড়ি খায় নিজেরই মতন করে ।
এই বারে কিছু দূর এগোবার পরেই চোখে পড়ল ছোট একটা ঝর্ণার ধারা । একে ঠিক ঝর্ণা বলার চেয়ে ছরা বলাই ভাল । বন্দী করলাম ক্যামেরায় -
এরকম হাজারো ছরা গিয়ে মিশছে একটা বড় ঝরণায় তার থেকে উৎসরিত ঝর্ণাধারার ছবি এবারে দেখি -
এই ঝিরিপথ অনেকটা দূরে গিয়ে জন্ম দিয়েছে সাঙ্গু বা শঙ্খ নদের । কোথাও কোথাও জলের ধারা বেশ গভীর । সেখানে ঢেউও বেশ । তারই একটা নমুনা -
পুরো তিনটে পর্ব আপনাদেরকে সাথে নিয়ে ঘুরলাম অথচ আমাদের গাইড বাবাজী নামটাই বলা হল না আপনাদের । এর নাম রাহাত । বয়স আঠারো দেখে বোঝা যায় ?
জবর একটা হাসি দিয়েছে সে ? কি বলেন ?
যাত্রা পথে আরো অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা ছিল । কিন্তু আমরা সবাই ছিলাম ক্লান্ত আর মোটকথা সেদিনের শেষ নৌকো মিসের ভয় ছিল সবার মনে । তাই এক এক দফা ছবি তুলতে গিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিলাম । শেষে অন্যের ধমকে অনেক ছবি তুলিইনি । আপনাদের সাথে সাথে আমারো আফসোস হচ্ছে সেসব ছবির জন্য ।
যা হোক পথ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে । ঝিরি এখানে অনেক চওগা একই সাথে গভীর । আমাদের প্রায় ত্রিশ বার ঝিরি পার হতে হয়েছিল ।
বেলা একটা বেজে যাবার সময় আমরা এই পাহাড়চূড়োটার দেখা পেলাম । এইটির পরে আরেকটু হেটে এগোলেই সর্বশেষ পাহাড়ে উঠতে হয় । এর পরেই রুমা বাজার ।
আমরা পৌছে গেলাম রুমা বাজার । আর একটু পরেই রুমা থেকে বান্দরবনের উদ্দেশ্যে নৌকা ছাড়বে । তা গিয়ে ধরবো । খেয়ে নিয়ে আমরা প্রস্তুত হলাম । ঘাট থেকে ছাড়ল নাও । আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল ছোট্ট ছেলে গুলো ।
আমার খুব মায়া হচ্ছিল ওদের প্রতি । ইচ্ছে করছিল থেকে যাই না আর কটা দিন । কিন্তু সময়ের বাধনে বাধা আমাদের যে চলতে হবে সামনের পানে ।
আমার ভ্রমণ এখানেই শেষ । তবে ছবি কিন্তু আরো বাকি আছে । এখন আমরা এই সফরের বেশ কিছু ভিন্ন ধরণের ছবি দেখবো । এ সব ছবিতে পার্বত্য চট্রগ্রামের অধিবাসীদের যাপিত জীবনের চিত্র ফুটে উঠবে বলেই মনে করি ।
প্রথমে যে ছবিটা দেখছেন তাকে স্থানীয় অধিবাসীরা বলে থাকেন আলু । আমার কাছে জিনিসটা নতুন বৈকি-
আমরা জানি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভ্যাস আমাদের মতন নয় । একটু বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় । সে রকম এই ছবিটা আমার কাছে ধরা দিয়েছে বিচিত্ররূপেই -
এই শুকর টিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিক্রির জন্যে বাজারে । শুকরের ঘোৎ ঘোৎ যে কত মারাত্নক সেটা আমি এখানেই প্রথম শুনি ।
এর পরের ছবিটি একজন লোকের যে কিনা একটি বাশের তৈজসপত্র তৈরি করছে ।
পরের ছবিটি শুধুমাত্র শিশুদের । শিশুরা সুন্দর এমন কি উদোম নগ্ন গায়েও-
পরের ছবিটি সত্যই মজার । অফ সিজনে পাহাড়ে ভুলেও কেউ যাবেন না । গেলে এ রকম পস্তাতে হবে । আমার দ্বিতীয়বার ভ্রমণের সব কষ্ট মাটি হয়েছে ।
পুরো ভ্রমনে আমাদের সাথে ছিল একটি দুই জনের ফরাসি দল তারা পিতা পুত্রে বেশ মজা করেছে আমাদের সাথে । প্যাট্রিক এবং অ্যালান তাদের নাম ।
এবারে বন্ধুদের জন্য ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্য (যদিও আমি নিজেই একজন নবিশ ভ্রমণ কারী):
১) বান্দরবন বগা লেক যাবার উপযুক্ত সময় আমার মতে অক্টোবরের শেষ হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত । এটা অতি অবশ্যই তাদের কথা বিবেচনা করে বলা যারা কম কষ্টে ঘুরে বেড়িয়ে আনন্দ পেতে চান ।
২) ভরা বর্ষায় পথ ঘাট পিচ্ছিল থাকে । তাই অভিজ্ঞ না হলে না যাওয়াই মঙ্গল ।
৩) ঢাকা থেকে বাসে চড়ে আপনাকে আসতে হবে বান্দরবানে । সেখান থেকে রুমা যাবার জন্য আপনি পাবেন বাস । প্রতি ঘন্টায় ছাড়ে । এই বাস জার্নি খুব খারাপ । রাস্তা বেশ খারাপ ।
৪) একটা ব্রিজ করা হচ্ছে, সেটা যদি কমপ্লিট হয়ে গিয়ে থাকে তবে সরাসরি রুমায় গিয়ে নামবেন বাস থেকে । সেখানে থাকার মত বেশ কিছু হোটেল আছে । একটাতে টিভিও ছিল ।
৫) রুমা থেকে ট্রেকিং এর জন্য আপনাকে অনুমতি নিতে হবে আর্মিদের কাছ থেকে । সেখান থেকেই আপনাকে গাইড সরবরাহ করা হবে । তাকে নিয়ে চলে যান যেখানে খুশি ।
৬) গাইডের প্রতিদিনের বেতন চারশ টাকা । অর্থাৎ তাকে নিয়ে দুদিন ট্রেকিং এ গেলে আপনাকে দিতে হবে আটশ টাকা । আপনার দল দুজনের হলেও আটশ, পঞ্চাশ জনের হলেও আটশ ।
৭) যারা বগা লেক থেকে আরো বেশি দূরে যেতে চান, তারা অভিজ্ঞ গাইড নেবেন । আর অভিজ্ঞ গাইডরা আবার পেমেন্ট বেশি নেন
৮) মশা মাছি তেমন কিছু দেখিনি দুবারের একবারেও । দ্বিতীয়বার আমি অনেক দূরে গিয়েছিলাম । তাই অডোমাস খুব বেশি দরকার বোধ করি না । তবুও নিয়ে নেয়া ভাল
৯) সব থেকে দরকারী বিষয় রাবারের জুতো । ঢাকা থেকে নিন বা রুমা থেকে নিন নিতেই হবে । নইলে হাটতে গিয়ে ফোসকা পড়তে পারে কিন্তু ।
যেতে বা আসতে অনেকের হয়ত অনেক কষ্ট হবে । হয়ত অনেকেই ভাববেন দূর গিয়ে কি হবে ? কিন্তু যা দেখে আসবেন সে সত্যিই চমকপ্রদ । আরেকটি বগা লেকের ছবি দেখিনা কেন ?
শেষ হল ছবি ব্লগ ।
উৎসর্গ : প্রিয় সুমনকে । আর এইচ সুমন (সুমন্টোগ্রাফির সুমন) । বেচারা জ্বরে আক্রান্ত । আজ আমার সাথে তার ছবি তুলবার জন্যে যাবার কথা ছিল । কিন্তু পারেনি । আপনারা দোয়া রাখবেন তার জন্য
পূর্ববর্তী পর্বসমূহ :
১) বান্দরবানে একদিন, ১ম পর্ব
২) বান্দরবানে একদিন: ২য় পর্ব