‘দুঃখ আমাকে দুঃখী করেনি, করেছে রাজার রাজা’- ছোটবেলায় গানটা শুনলে অবাক হয়ে যেতাম। দুঃখ আবার কেমন করে রাজা করে। তখন রাজা রূপকথার গল্পের সৈন্য-সামন্তসহ এক দৌর্দণ্ড প্রতাপশালী এক সিংহপুরুষকেই বুঝতাম। কিন্তু এখন বুঝি, আসলেই দুঃখ মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে তৈরি করে। স্বর্ণকার যেমন পুড়িয়ে সোনাকে খাটি করে।
আনন্দ বেদনা আর স্মৃতি নিয়েই আবর্তিত হয় আমাদের জীবন। সময়ই আমাদের বলে দেয় কখন কী করতে হবে। দিন আসে, দিন যায়: আর গুটি গুটি পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় মানুষ। রয়ে যায় শুধু স্মৃতিসুধা। সেখানে শুধু সুখ-আনন্দই থাকে না; দুঃখ-কষ্টও স্থান করে নেয়। এই দুঃখ আর কষ্টকে উপভোগ করতে দেখেছি অনেককে। দুঃখস্মৃতিকে রোমন্থন করতে দেখেছি তাদেরকে। দুঃখের কথা বলতে গিয়ে তাদের চোখে-মুখে আনন্দের ছটা লক্ষ্য করেছি।
আসলে দুঃখ ও কষ্ট আমাদের জীবনেরই অঙ্গ। রাত ছাড়া যেমন দিনের অস্তিত্ব বোঝা যাবে না; তেমনই কষ্ট ছাড়া সুখের মাহাত্ম্য কোথায়? বর্তমানের দুঃখ-কষ্ট আমাদের ভবিষ্যতের পথ দেখায়। অতীতের কষ্ট আমাদের বর্তমানকে নির্দেশনা দেয়।
দুঃখ হলো প্রতিকূলতা, ক্ষতি, নিরাশা, শোক, অসহায়তা, হতাশাসহ বিভিন্ন অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানসিক যন্ত্রণার বিমূর্ত প্রকাশ। দুঃখে মানুষ চুপচাপ কিংবা অবসন্ন হয়ে পড়ে এবং অন্যের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়। এই দুঃখ-বেদনাকে এড়িয়ে নয়; সঙ্গে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। আর এগিয়ে যাওয়ার পথ খোলা না থাকলে সময়ের অপেক্ষা করতে হয়। সময়ই বলে দেবে কখন কী করতে হবে। সুসময় একদিন আসবেই।
সৃষ্টিকর্তার ওপর ভরসা করতে পারে, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। দুঃখ-কষ্টের সময় ধৈর্য ধারণের কারণে মর্যাদা বৃদ্ধি করে। আর কষ্টের পরই সুখ নিহিত আছে। মানুষ নানা উপায়ে দুঃখকে সামলায়। আসলে এই দুঃখ অনুভূতিটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষকে এগিয়ে যাওয়ারও প্রেরণা যোগায়।
মনোযোগ আর ধৈর্য থাকলে জীবন সম্পর্কে শেখার অনবদ্য মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে দুঃখ। তবে ‘দুঃখ নিয়েও বাঁচা যায়’— মানসিক সহায়তার মাধ্যমে এই তাগিদটা আমাদের মধ্যে থাকাটা জরুরি।
ইংরেজ কবি, লেখক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন রোনাল্ড রিউএল টলকিন (জে আর আর টলকিন নামে সমধিক পরিচিত) মনে করতেন, আশা কিংবা নিরাশার তুচ্ছতর প্রলোভনের চেয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে দুঃখকে বরণ করে নেওয়াই শ্রেয়। তারই জলজ্যান্ত প্রতিফলন হিসেবে ‘দ্য লর্ড অফ দ্য রিংস’-এ দুঃখ এবং নিরানন্দকে পৃথকভাবে দেখিয়েছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনায়ও দুঃখ জীবনের এক অনন্য অঙ্গ। তিনি বলেছেন, ‘আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন’। তার জীবনচেতনা, সাহিত্য, গান প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বারবার দুঃখের কথা উঠে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনেও দুঃখ বারবার এসেছে, তার মধ্যে বেশিরভাগ সময়ই তা আছড়ে পড়েছে মৃত্যুশোকের রূপ ধরে। তার বহু গানে তিনি দুঃখকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। তার ‘শেষ লেখা’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন,
‘দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে এসেছে আমার দ্বারে;
একমাত্র অস্ত্র তার দেখেছিনু
কষ্টের বিকৃত ভান, ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যত—
অন্ধকার ছলনার ভূমিকা তাহার।
মনোজ সরকার

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২৩ সকাল ১০:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



