আমাদের রাস উৎসব
এম এস রানা
চন্দ্রমাসের প্রথম দিনে যেদিন সন্ধ্যার আকাশে হেসে উঠেছিল এক চিলতে চাঁদ, আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল মণিপুরীরা। এই পক্ষে যে রাতে আকাশের কোলজুড়ে হেসে উঠে পূর্ণিমার চাঁদ, মণিপুরীরা সে রাতে মেতে ওঠে রাসউৎসবে। অনেকে একে রাসপূর্ণিমাও বলেন। অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষত দিন। সকাল থেকেই শুরু হয় নানা উৎসব আয়োজন। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা, এরপর রাত। অনুষ্ঠান চলে পরদিন ভোর পর্যন্ত। আর এই যে উৎসব আয়োজন, এর জন্য মাসব্যাপী চলে নানা রকমের মহড়া। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণে রাস উৎসব আজ কেবল মণিপুরীদের নয়, হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের উৎসব।
প্রতি বছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমার তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় মহারাসলীলা উৎসব। তার আগে আশ্বিন মাস থেকেই মণিপুরী অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ও মাধবপুরে মণিপুরীদের ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যায় উৎসবের প্রস্তুতি। ধনী-গরিব এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মণিপুরীদের রাস উৎসব আজ হয়ে উঠেছে সর্বজনীন এক উৎসব। স্থানীয় ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন তো বটেই, সুদূর ভারত থেকেও ছুটে আসে সেখানকার মণিপুরীরা। সাদা কাগজের নকশা আর নানা ফুলের আবরণে সজ্জিত মণ্ডপগুলো কী এক অমোঘ আকর্ষণে রাতভর ধরে রাখে হাজারো মানুষকে। আর সেই সঙ্গে মণিপুরী মেয়েদের নৃত্য সবার মনে ছড়িয়ে দেয় মুগ্ধতা।
জানা যায়, মণিপুরীদের এই মহারাস বলতে প্রেমরসকেই বোঝানো হয়। বস্তুত রস শব্দ থেকেই থেকেই রাস শব্দটির উৎপত্তি। রস আস্বাদনের লক্ষ্যে পূর্ণিমার এই তিথিতে রাধা-কৃষ্ণের লীলানুকরণে নৃত্য-গীতের মাধ্যমে মণিপুরীরা যে উৎসব করে, তা-ই রাস উৎসব। নৃত্য, সঙ্গীতে মণিপুরীদের প্রাচীন জাতীয় লোকনৃত্য লাই হারাওবা থেকেই রাস নৃত্যের জন্ম। এ বছর কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরে মণিপুরী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী মহারাসলীলা উৎসবের ১৬৬তম বার্ষিকী এবং আদমপুরে ১৮তম বার্ষিকী পালিত হয়েছে।
গত ১৩ নভেম্বর সরেজমিন মাধবপুর রাস উৎসবে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরে মণিপুরী শিশু কিশোররা রাখাল নৃত্য করছে। শিশুশিল্পীরা রাখাল সাজে সজ্জিত হয়ে একটি মাঠে সমবেত হয়। রাখাল নৃত্য সাধারণত দিনের বেলায় অর্থাৎ সূর্যাস্তের আগেই অনুষ্ঠিত হয়। এদের পরনে ছিল ধুতি, মাথায় ময়ূর পালকের মুকুট, কপালে চন্দ্রের তিলক, গলায় সোনার মালা, হাতে বাঁশি ও পায়ে নূপুর। এরপর বাঁশি হাতে বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করতে করতে শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন অনুকরণে একজন শিশু শিল্পী মাঠে প্রবেশ করে। অনেকক্ষণ ধরে চলে এই নৃত্য গীতি। এরপর খানিকটা বিরতি।
আমরা ছিলাম আদমপুরে। রাত বারোটায় শুরু হবে মহারাসলীলা উৎসব। ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত দর্শনার্থীদের ভিড়ে কোথাও যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। দর্শনার্থীদের গাড়ির ভিড়ে তৈরি হয়েছে অস্বাভাবিক যানজট। ফলে আদমপুরের উৎসব ভেন্যু থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরেই থামিয়ে দেওয়া হয়েছে ওসব গাড়ি। একদম প্রয়োজনীয় গাড়ি ছাড়া প্রায় সব গাড়ি থেমে থাকে সরু রাস্তার দুই ধারে। হাজার হাজার মানুষ পায়ে হেঁটে এগিয়ে চলে মূল ভেন্যুর দিকে। ওদিকে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে পাশাপাশি তিন-তিনটি মণ্ডপ। রাত বারোটায় শুরু হয় মহারাসলীলা।
শুরুতেই পরিবেশিত হয় রাসধারীদের অপূর্ব মৃদঙ্গনৃত্য। মৃদঙ্গনৃত্য শেষে প্রদীপ হাতে নৃত্যের তালে তালে সাজানো মঞ্চে প্রবেশ করেন শ্রীরাধার সাজে সজ্জিত একজন নৃত্যশিল্পী। তার নৃত্যের সঙ্গে বাদ্যের তালে তালে পরিবেশিত হয় মণিপুরী বন্দনাসঙ্গীত। মঞ্চে এলো শ্রী কৃষ্ণ রূপধারী বাঁশী হাতে মাথায় কারুকার্য খচিত ময়ুর পুচ্ছধারী এক কিশোর নৃত্যশিল্পী। তার বাঁশির সুর শুনে ব্রজগোপী পরিবেষ্টিত শ্রীরাধারূপী আরেক শিশুশিল্পী এলো মঞ্চে। তাদের নানা নৃত্যকলা প্রদর্শনের পর একে একে মঞ্চে আসে সুবর্ণ কঙ্কন পরিহিতা মণিপুরী কিশোরীরা। অপরূপ সাজে তারা সাজিয়েছে নিজেকে। নিজস্ব পোশাক, সাজ-সজ্জা আর নিজস্ব ঢঙে শুরু হয় তাদের নৃত্য। অন্যদিকে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে কীর্তন গেয়ে যাচ্ছে একদল মানুষ। রাধা-কৃষেষ্ণর প্রেম কাহিনী আর লীলাখেলার কথামালা নিয়ে রাতভর গেয়ে যায় গান। রাধার কাছে কৃষ্ণের প্রেম নিবেদন, কখনো বা কৃষ্ণের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে রাধার নিরন্তর চেষ্টা, কৃষ্ণের নিকট রাধার সমর্পণ, কৃষ্ণের প্রেমে দিশেহারা রাধার করুণ আকুতিÑএমনি নানা ঘটনা পরিত্রক্রমার মধ্য দিয়ে চলে গীত কিংবা কীর্তন। সঙ্গে চলে মণিপুরী কিশোরীদের নৃত্যকলার অপরূপ প্রদর্শনী। রাতভর এই নৃত্য শেষে ভোরবেলায় রাধাবিদায় পর্বের মাধ্যমে শেষ হয় রাসনৃত্য।
ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে মণিপুরের মহারাজ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রবর্তন করেন তা-ই রাসনৃত্য। মহারাজার মৃত্যুর একশ বছর পরে মহারাজ চন্দ্রকীর্তির শাসনামলে গোটা রাসনৃত্য আচৌকা, বৃন্দাবন, খুডুম্বা, গোস্ট, গোস্ট বৃন্দাবন, আচৌবা বৃন্দাবনসহ নানা ভঙ্গির পর্যায়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, মহারাজ ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাদের বেশিরভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাসনৃত্যে অংশগ্রহণ করতেন। এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতার সুত্র ধরেই ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজ অবধি কোনোরূপ বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছে এ রাস উৎসব। মণিপুরী এ নৃত্যকলা শুধু কমলগঞ্জের নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্যকলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। ১৯২৬ সালে সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরীদের রাসনৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জিকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ১:৫৪