somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শরতের উৎসব, শারদীয়া উৎসব

২৭ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কদিন আগে বাংলাদেশের প্রখ্যাত এক ছড়াকার কণ্ঠে খুব উষ্মা ঢেলে স্বভাবজাত আঞ্চলিক বলছিলেন, 'আইচ্ছা কও তো, এই যে দুর্গাপূজারে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব বলে ঘোষণা দিতেছে, এইটা কি সত্য? আমরা কি দুর্গাপূজা করি?'

আমি বলি, 'না, করি না। এরপর গলায় কৌতূহল ঢেলে বলি 'এমন বলে নাকি! কারা বলে?'

ছড়াকার বললেন, 'কোলকাতার লোকেরা বলে।' কই! আমরা তো ঈদরে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব বলি না! তাইলে তারা বলেন ক্যান!'

আমি বলি, 'যারা বলে, তারা ভুল ভাবনায় বলে। তাদের বলতে হতো বাঙালির অন্যতম বড় উৎসব। তবে কোলকাতার লোকেরা বললে তো ঠিক আছে। তারা তাদের হিসাবে বলে।'

তিনি বললেন, 'এইটারে প্রোটেস্ট করতেই আমি রোজার ঈদরে লেখছি বাঙালির অন্যতম বড় উৎসব ঈদ। তাগো মতো সবচেয়ে বড় উৎসব লেখি নাই।'

আমি বলি, 'লেখবেন ক্যান! ঈদ তো খালি বাঙালি পালন করে না। দুনিয়ার সকল মুসলমান লোকেরা পালন করে। সবচেয়ে বেশী পালন করে আরবের জাতির লোকেরা। দেশ হিসাব করলেই তো আরব জাতি সাতটা। কিন্তু জাতি হিসাবে আরও বেশী। আরেক কথা হলো, যারা দুর্গাপূজারে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব লেখছে, তারা লেখছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আপনি লেখছেন ওইটারে প্রোটেস্ট করতে- আপনের লেখায় স্বতঃস্ফূর্ততা নাই, ঠেকা দেয়ার একটা ব্যাপার আছে। পার্থক্যটা বুঝতে পারছেন?'

ছড়াকার এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর ফিক করে হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন, 'আরে তোমার দেখি কথা ফুটছে! তুমি আমার লগে এমনে করে কও না কখনও!' তার হাসি এবার প্রসারিত হলো।

এবার আমিও হেসে উঠি। হাসতে হাসতে বলি, '... ভাই মাইন্ড করলেন?... একলা একলা সিগ্রেট খাইতেছেন। আমিও খাই একটা। মাইন্ড কইরেন না।'

'আরে ধুর! কি কও! আমি তোমারে কতটা পছন্দ করি তুমি তো জানো না! বিশ বছর আগে তোমারে নিয়া ছড়া লেখছিলাম, তোমার মনে আছে?'

কথাটা সত্যি। বিশ বছর আগে তিনি আসলেই ছড়া লিখেছিলেন। তবে সে ছড়ায় আমার উপস্থিতি থাকলেও উপলক্ষ্য ছিল কৃষ্ণবর্ণ এক তরুণী। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে আমার এ ছড়াকার ভাইটি তখনও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবনার পক্ষে ছিলেন। আর এখন সে ভাবনা আরও প্রকট হয়েছে। আগে প্রতিক্রিয়াশীল হলেও সে ভাবনা প্রচার করতেন না। এখন করেন। আগে প্রতিক্রিয়াশীল ছড়া লিখতেন না। এখন লেখেন। তো ইনি স্বনামে প্রখ্যাত বলে সঙ্গত কারণেই তার নাম বলছি না।

দুর্গাপূজা সমগ্র সনাতন ধর্মের তথা হিন্দুসমাজেই প্রচলিত থাকলেও বাঙালি হিন্দু সমাজে দূর্গাপূজাকে প্রধান ও অন্যতম বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আশ্বিন বা চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপূজা পালন করা হয়। তবে দুর্গাপূজা কিন্তু হিন্দু ধর্মীয় সকলের কাছেই প্রধান ধর্মীয় উৎসব নয়। মূলত বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবাংলার বাংলা ভাষাভাষী সনাতন ধর্মের মানুষেরা বিশাল আড়ম্বরে দুর্গাপূজা পালন করেন। তবে নেপালের সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকেরাও দুর্গাপূজা উদযাপন করেন বটে।

আমরা যে স্কুলটিতে লেখাপড়া শিখেছি, তার নাম সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়। দুটা স্কুল আছে। একটা ছেলেদের। অন্যটা মেয়েদের। আমি দুটাতেই পড়েছি। ক্লাস ফাইভ মেয়েদের শাখাটাতে ছেলেরা পড়তে পারত। সব বোনেরা ওখানে পড়ত বলে আমাকেও ওই সুবিধা নিতে হয়েছিল। অজান্তেই।

দু স্কুলের মাঝামাঝিতে একটা মন্দির আছে। নাম সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির। মন্দিরের প্রধান ফটকের পাশ ঘেঁষে একটা বিশাল বটগাছ। বটগাছ থেকে লম্বা ঝুল ঝুলে প্রায় মাটি ছোঁয় ছোঁয়। ওটা দেখে আমার টারজানের কথা মনে পড়ত। টারজানের মতো দোল খেয়ে আরেক গাছে যেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু ওর আশপাশে আর কোনও গাছ ছিল না। এটা একটা দুঃখ হয়ে বিরাজমান ছিল অনেকদিন।

তো ওই সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের নাম থেকে আমাদের স্কুলটির নামকরণ। ওই এলাকাটির নামও তাই- 'সিদ্ধেশ্বরী।' মেয়েদের স্কুলটাতে যেতে একটা সংক্ষিপ্ত পথ ছিল। সেটা মন্দিরের সামনে দিয়ে গেছে। রোজ খুব সকালে আমরা বাড়ি থেকে হেঁটে যেতাম বলে ও পথটা ধরেই যেতাম। মন্দিরের প্রধান ফটকের ঠিক আগে ছোট একটা ঘরের মতো ছিল। ওই সকালেই ঘরটির সামনের রাস্তাতে বালতিতে পানি নিয়ে রোজ কাউকে না কাউকে গোসল করতে দেখতাম।

আমি একদিন একজনকে খুব কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, 'রাস্তার উপ্রে গোসল করেন ক্যান!'

লোকটি ঝুঁকে বালতি থেকে পানি তুলছিল। ওই অবস্থাতেই আমার দিকে তাকাল। তারপর হেসে ফেলল। ঘরের ভেতর থেকে কেউ ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। এরপর দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে গোসল করতে থাকা লোকটিকে বলল, 'কি হইছে? কি কয়?'

লোকটি মগ বালতিতে ফেরত দিয়ে বলল, এইহানে স্নান করি ক্যান জিগায়।' বলে হাসিটি আরেকটু প্রসারিত করে পরনের ভেজা লুঙ্গিটি হাঁটু অবধি তুলে দু হাতে চিপে পানি নিংড়াতে লাগল।

ঘরের ভেতর থেকে উঁকি দেয়া লোকটি এবার দরজায় দাঁড়াল। লোকটা টকটকে লাল রঙের একটা কাপড় পেঁচিয়ে লুঙ্গির মতো পরে আছে। গায়ে গেরুয়া ফতুয়া। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর বলল, 'পূজা করব তো এইল্লেইগা স্নান কইরা পবিত্র হইতে হয়, বুঝছ?

আমি জানলাম, স্নান মানে গোসল। এই জানাটা পরে স্কুলে কাজে লেগেছিল। কেননা এই জানাটা বন্ধু চন্দন ছাড়া আর কেউ জানত। ক্লাসের অন্যরা জেনেছে আমাদের দুজনের অনেক পরে।

ঘরটিতে কজন লোক ও ঘরে রোজ ওপরে একটা সাইনবোর্ডে ওর পরিচিতি লেখা। রোজ স্কুলে যেতে আসতে আমি ওটা পড়তে চেষ্টা করতাম। ক্লাস ওয়ানে যাতায়াতে শুরু করে ক্লাস থ্রিতে উঠে ওটা পড়তে পেরেছিলাম। ওতে লেখা ছিল 'শ্রী শ্রী মা আনন্দময়ী আদি আশ্রম।' তার নীচে ছোট ছোট অক্ষরে আরও কিছু লেখা ছিল। সেগুলো মনে নেই।

আমাদের সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের কথা প্রসঙ্গে এত এত কথা এল। আমাদের এই মন্দিরটি খুব প্রাচীন। ইতিহাসবিদ ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন থেকে জেনেছি বিক্রমপুরের অধিপতি চাঁদ রায় আনুমানিক ১৫৮০ সালে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির নির্মাণ করেন। তখন নাকি বিশাল পুকুর ছিল মন্দিরের সামনে। এখন নেই। আমার পূর্ব পুরুষ যারা তারাও দেখেন নি। তারমানে অনেক বছর ধরেই নেই। কয়েক পুরুষ ধরেই।

শুরুতে দুর্গা পূজা প্রচলিত ছিল চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে, যা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত; পঞ্চদশ শতাব্দীর বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ওঝা রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করেন। কিন্তু রামায়ণের মূল রচয়িতা বাল্মিকী রচিত মূল সংস্কৃত রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ নয় কৃত্তিবাসী রামায়ণ। মধ্যযুগে কবি কৃত্তিবাস ওঝা যখন রামায়ণ অনুবাদ করলেন তখন মূল সংস্কৃত রামায়ণে রাম দুর্গা পূজা করেছে, এমন কথার উল্লেখ না থাকলেও কোনও তথ্যসূত্র ছাড়াই শুধুমাত্র পুরাণে রামের দুর্গাপূজার কথা বলা হয়েছে বলে কৃত্তিবাস নিজের অনুদিত বাংলা রামায়ণে উল্লেখ করে দিলেন- রাম দুর্গার পূজা করেছে। কৃত্তিবাস ওঝা রামায়ণের চরিত্রগুলো তৎকালীন সাধারণ বঙ্গীয় সমাজের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন, যা বাল্মিকীর রামায়ণের ওই একই চরিত্রর ভিন্ন রূপে দেখা যায়।

তো সে কৃত্তিবাসী রামায়ন পাঠ করেই বাঙালিরা শরৎ কালে দুর্গাপূজা করতে শুরু করে দিল। দুর্গাপূজার সময় হিসেবে শরৎ কালকে বেছে নেবার কারণ হলো, দুর্গাপূজা কিছুটা অঞ্চলভিত্তিক পূজা। আর এসব অঞ্চলে এ সময়টাতে বৃষ্টিও তেমন হয় না। এবং নবান্ন। এ সময় ধান ও অন্যান্য শস্য ফলত, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকত। ফলে মানুষ আনন্দ উৎসবে অংশ নিতে পারত। শরৎ কালের এই দুর্গাপূজাই হলো ‘শারদীয় উৎসব।’

ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করে জানা গেল, মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ১১শ’ শতকে অভিনির্ণয়-এ, মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির 'দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী'তে দুর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। বাংলায় ১৪শ’ শতকে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল কিনা সেটা অবশ্য ভালোভাবে জানা যায় না। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন।

আমাদের সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের সামনের পথ ধরে আমাদের নিত্য যাতায়াত বলে বারো মাসের তেরো পার্বণনের খবরই আমরা পেয়ে যেতাম। আর কোনটা কোন্‌ পার্বণ তার দীক্ষা পাওয়া যেত চন্দনের কাছে। চন্দন আমার খুব ভালো বন্ধু হয়েছিল। আড়াই টাকা রিকশার দূরত্বে বাস করেও গ্রীষ্মের ছুটিতে চিঠি চালাচালি করতে আমরা ঠিকানা বিনিময় করেছিলাম।

একদিন হঠাৎ দেখি মন্দিরের সামনে অনেক মূর্তি বানাবার কাজ চলছে। একটা সাজ সাজ রব। কি ব্যাপার!

পরিচিতজনেরা জানালো, হিন্দুদের তো অনেকগুলা পূজা। এইটা সবচে' বড় পূজা। দুর্গাপূজা। দুর্গার মূর্তি বানাইতেছে।

এখনকার মতো মন্দিরের চারপাশ জুড়ে পাঁচিল ছিল না তখন। চলতি পথেই দেখা যেত। কিন্তু সকালের ক্লাস ফেলে তো ও জিনিস দেখা যাবে না। ম্যাডামরা জানতে পেলে ছাল তুলে নেবে। ফেরার পথে মূর্তি বানানো দেখতাম। বাঁশ চাটাই দিয়ে কাঠামো বানিয়ে মাটি দিয়ে ভরাট করে কি অদ্ভুত সুন্দর করে অবয়ব বানিয়ে ফেলল! আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম বড় হয়ে মূর্তি বানানো শিখব।

দুদিন পর মূর্তির মাটি শুকালে শুরু হলো রঙ করা। এবার আরও মুগ্ধতা। রঙ করার ফলেই না মূর্তি অমন জীবন্ত হয়ে উঠল! রঙ শুকালে পরে পরানো হতো পোশাক। অলঙ্কার। সে আরেক বিস্ময়! গল্প শুনতাম, জমিদার আমলে নাকি খুব দামী আর সত্যিকার অলঙ্কার পরানো হতো। জমিদাররাই সেসব দিত। এখনকার লোকেদের তো অত পয়সা নেই। অত ভক্তিও নেই।

অর্থনীতির সঙ্গে ভক্তির যোগটা খুব সূক্ষ্মভাবেই আমাকে দেখিয়ে দেয়া হলো।

কিন্তু মূর্তি বানানো শিখবার যে সিদ্ধান্ত, আমি সেটা বদলে ফেললাম। উঁহু, মূর্তি বানিয়ে লাভ নাই। আঁকিয়ে না থাকলে তো মূর্তি কোনও কাজের জিনিস না। আমি আঁকিয়ে হবো। আমাদের বাড়ির পাশে চারুকলার এক লোক থাকতেন। তিনি তাতে ঢেলেছিলেন। এরপর সত্যি সত্যি আঁকাআঁকি শুরু করেছিলাম। আরেকটু বড় হতে দলবেঁধে চলে যেতাম পুরান ঢাকায়। সেখানে চলত পূজার জমকালো আয়োজন। আমাদের সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের আয়োজন সে তুলনায় কিছুই নয়।

কিন্তু সেখানেও হতাশাকে পাওয়া গেল। পুরান ঢাকার বন্ধুরা বলল, কোলকাতায় দুর্গাপূজার যে আয়োজন হয়, তার কাছে নাকি পুরান ঢাকা কিছুই না। টাকাঅলা চলে যেত কোলকাতা পূজা উদযাপন করতে।

আমাদের রাজধানী ঢাকা শহরটার সঙ্গেও দেবী দুর্গার যোগ আছে। প্রাচীনকালে নদীগুলোকে কেন্দ্র করেই নগর গড়ে উঠত। ঢাকা নগরও এর ব্যতিক্রম নয়। বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ঢাকা নগরী। এই বুড়িগঙ্গার ঠিক পার ঘেঁষেই ছিল ঢাকেশ্বরী মন্দির।
ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির মূলত একটি দুর্গা মন্দির। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে অর্থাৎ ১১শ' থেকে ১২শ' সালের মধ্যে বাংলার সেন বংশের কোনও এক রাজা গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটি দেবী দুর্গা সদৃশ মূর্তি খুঁজে পান। তারপর তারা সেখানেই একটি মন্দির বানিয়ে সেই মূর্তি স্থাপন করেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন দেবীর এই মূর্তির নাম ঢাকেশ্বরী। সেই নাম অনুযায়ীই এই মন্দিরের নাম হয় ঢাকেশ্বরী মন্দির। এবং পরবর্তীতে এই ঢাকেশ্বরী মন্দিরকে কেন্দ্র করেই বিস্তৃত হতে শুরু করে একটি নগর বা জনপদ, আস্তে আস্তে যার নাম হয় ঢাকা। আমাদের আজকের ঢাকা শহর। আমাদের রাজধানী।

১২শ' সালের আগে থেকেও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পূজা হতে থাকলেও সম্ভবত জঙ্গলে ঘেরা থাকার কারণে এই পূজার কথা লোকেরা তেমন জানত না। ফলে বর্তমান বাংলাদেশের প্রথম দুর্গাপূজা বলা হয় রাজশাহী জেলার তাহেরপুর থানার রাজা কংসনারায়নের পূজাকে, যেটা শুরু হয় মোটামুটি ১৬শ' সালের দিকে। তাছাড়া ১৬১০ সালে কোলকাতার বারিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দূর্গাপূজার আয়োজন করেছিল বলে ধারণা করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ব্যাখ্যা করলেন এভাবে- 'মূলত ব্রিটিশ শাসনের সময় হিন্দু এলিট শ্রেণী আর জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্গাপূজা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হিন্দুদের মধ্যে যে বর্ণবাদ বা শ্রেণীভাগ ছিল, সেটা নিয়ে তখন অনেক সামাজিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। যার ফলে তখন হিন্দু ধর্মকে পরিবর্তন করার দরকার হয়ে পড়েছিল। তখন বাংলার এলিট শ্রেণী মনে করল, এমন একটা শক্তির দরকার, যাকে সবাই মেনে নেবে। তখনই, ওই সময়টা থেকেই দুর্গার পূজা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাছাড়া দেবী দূর্গার জনপ্রিয়তার আরেকটা কারণ হলো দুর্গার মাতৃরূপ।

আসেন, দুর্গা মানে দুর্গতিনাশিনীর ব্যাপারটা একটু জানা যাক। দুর্গতিকে বিনাশ করতেই দুর্গার আবির্ভাব। অসুরেরা যখন দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ দখল করে নিচ্ছিল, তখন সকল দেবতারা তাদের শক্তিকে মিলিত করে দেবী দুর্গার উৎপত্তি করল। এই দুর্গা অসুরদের পরাজিত করে দেবতাদের বাসস্থান- স্বর্গ উদ্ধার করেছিল।

অসুরদেরকে হত্যা করতে দুর্গা যুদ্ধে নেমেছিল। অসুরদের প্রধান নানা রূপ ধারণ করতে পারত। সম্ভবত অসুরের পছন্দের রূপ ছিল মহিষ। ধারণা করা হয়, বাঘ বা সিংহ হিংস্রতায় অনেক উঁচু হলেও শক্তির দিক দিয়ে বাঘ বা সিংহের চেয়ে একটি মহিষের শক্তি অনেক বেশি। ফলে অসুরের এই রূপ পরিবর্তনের ক্ষমতাকে বোঝানোর জন্যই দুর্গার কাঠামোয় ব্যবহার করা হয় মহিষ এবং এই মহিষের নাম অনুসারেই অসুরের নাম মহিষাসুর।

অসুরেরা দেবী দুর্গাকে রক্তবীজ নামক এক দৈত্যকে পাঠাল। রক্তবীজের বৈশিষ্ট্য হলো তার দেহ থেকে রক্ত মাটিতে পড়লেই সে রক্ত থেকে আবার নতুন অসুরের উৎপত্তি হয়। রক্তবীজের রক্ত যেন মাটিতে না পড়ে সেজন্য দুর্গা নিজের থেকেই কালীকে সৃষ্টি করল। তখন কালী রক্তবীজের রক্তপান করে তাদের উৎপত্তি বন্ধ করতে লাগল। এভাবে দেবী দুর্গা অসুরকে মেরে ফেলতে লাগল।

দুর্গাপূজাকে সার্বজনীন উৎসব বলা হয়। দেবী দুর্গা মায়ের রূপে বিরাজ করেন, সকলের মা। মা যেমন সন্তানের সুরক্ষাদায়িনী, তেমনি দেবী দূর্গাও সকল অপশক্তি বিনাশিনী, মুক্তিদায়িনী, আনন্দময়ী দুর্গা। মায়ের কাছে সকল সন্তানই সমান, সব সন্তানের কাছে মা অনন্য। সে কারণেই মা দুর্গা সর্বজনের, দুর্গাপূজা সার্বজনীন। তারপর সার্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব উৎসব হিসেবে বাংলা সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।

সার্বজনীনতার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল এরকম, রাজাদের বাইরে প্রথম বারোজন বন্ধু মিলে দুর্গা পূজা শুরু করেছিল। বন্ধু শব্দের হিন্দি প্রতিশব্দ’ ইয়ার।’ এই ‘ইয়ার‘ শব্দটা বাংলাতেও প্রচলিত ছিল। এখনও আমরা ‘ইয়ার-দোস্ত’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করি। তো এইভাবে বার+ইয়ার মিলিত হয়ে হয় বারোয়ারি।

দুর্গাপূজা অনেক খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল তখন। রাজা বা জমিদার ছাড়া কারও একার পক্ষে এর খরচ বহন করা সে সময় খুব কষ্টসাধ্য ছিল। এই সমস্যা থেকে উৎপত্তি হয় বারোয়ারি পূজার। এই ধরণের পূজাই এখন সার্বজনীন পূজা বলে পরিচিত।

সকলকে শরতের শারদীয় উৎসবের শুভেচ্ছা।❐
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০২০ দুপুর ২:৩২
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×