রাত দশটা বাজতেই আনিসের শরীরটা ম্যাজম্যাজ করতে লাগল। তাকে এখন বাইরে গিয়ে খোলা হাওয়ায় একটু হাঁটাহাঁটি করতে হবে। কিন্তু বাইরে যাওয়ায় ঝামেলা আছে। লকডাউন চলছে। যেনতেন লকডাউন না। কঠোর লকডাউন। জায়গায় জায়গায় মাঝ রাজপথে লম্বা লম্বা বাঁশ ফেলে দল বেঁধে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে। বেরুলে পাস নিয়ে বেরুতে হবে। এই পাসের নাম মুভমেন্ট পাস।
অবশ্য পাসের ব্যবস্থাও আছে। কঠিন ব্যবস্থা না। সহজ ব্যবস্থা। জ্ঞানী জ্ঞানী বন্ধুবান্ধবরা বলেছে, পুলিশ লোকেরা ওয়েব সাইট বানিয়ে রেখেছে। সেখানে যেতে হবে। গিয়ে নিজের সম্পর্কে তথ্য দিতে হবে। তাহলেই পাস দিয়ে দিবে।
আনিস ল্যাপটপ খুলে পুলিশের ওয়েবে ঢুকে পড়ল। ফরম পূরণ করার পর দেখে 'পরবর্তী' লেখা। সেখানে ক্লিক করতে স্থাবর-অস্থাবর সকল তথ্য দেয়া লাগল। তারপর কই যাবে, কেমনে করে যাবে, কি করতে যাবে- এমন নানান প্রশ্নর উত্তর দেয়া লাগল। এগুলো শেষ করার পর জানা গেল একটা পাস একবারই ব্যবহার করা যাবে। এক পাস নিয়ে দু'বার হাওয়া খেতে যাওয়া যাবে না। আনিস আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। এত ঝক্কি নেয়া যায় না। আনিসের উসখুস লাগতে লাগল। খোলা হাওয়া না খেলে তো এখন হবে না। আনিস আল্লাহ্র নাম নিয়ে খোলা হাওয়া খেতে বেরিয়ে পড়ল।
রাস্তায় নামতে দেখা গেল রাস্তা ভরতি বিস্ময়। পাড়ার দোকানপাট প্রায় সবই খোলা। মোড়ের মারুফ মার্কেটের সামনে ফলঅলা বসে ফল বিক্রি করছে। আজকে তার পাশে তরকারিঅলাকেও দেখা যাচ্ছে। ইউনিফর্ম পড়া দু’জন পুলিশ পটল কিনেছে। পটলের পলিথিন হাতে নিতে নিতে এক পুলিশ বলছে, ‘ওই, বেগুণ কত রাখবা?’
তরকারিঅলা বলল, নেন স্যার, আপনের লগে দামাদামি আছে নাকি!
এখানে তরকারিঅলার এক গাল হাসি দেয়ার কথা। মুখে মাস্ক বলে হাসল কিনা বোঝা গেল না।
পাস নেই সেটা মাথায় আছে। আনিস খুব সন্তর্পণে ওদের পাশ কাটালো। বড় রাস্তার পাশের ফুটপাতের পান-সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কিনছে আরেক পুলিশ। পাশেই পুলিশের গাড়ি। এরা যদি ডাক দিয়ে এখন পাস দেখতে চায় তবে আনিস অকূল পাথারে পড়বে। আনিস ঘামতে লাগল। ভয় কাটাতে ফোন বের করে খুব ব্যস্ত ভঙ্গীতে ফোন করল, হ্যালো বস্, আপনার শরীর এখন কেমন?
বস্ তখন কাশছেন। একলা একলাই বলতে বলতে আনিস খুব দ্রুত রাস্তা পেরুলো। সিদ্ধেশ্বরীর দিকে যাওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু মৌচাক ট্রাফিক সিগনালের কাছে আসতে দেখল ঠিক মৌচাক মার্কেটের সামনে বাঁশ ফেলে রাখা। পাশেই পার্ক করা একটা পুলিশের গাড়ি। অনেকগুলা পুলিশ দাঁড়িয়ে। ও জায়গা পাস ছাড়া পার হওয়া যাবে না। আনিস খুব দ্রুত দিক বদলে লিলি প্লাজার সামনের ফুটপাতে উঠে পড়ল। ওর বুক ধুকপুক করছে। ভাব করল যেন বাসের জন্যে অপেক্ষা করছে। পরক্ষণেই মনে পড়ল, হায় হায়! লকডাউন তো! বাস আসবে কেমনে করে! এবারে রাস্তা পেরিয়ে ফুজি কালারের সামনে চলে এল।
রিকশা ভালোই চলছে। একটা রিকশায় দেখা গেল তিনজন বসে আছে। এদের বোধহয় পাস আছে। এরা ফুজিকালারের সামনে নেমে পড়ল। এদের গন্তব্য মগবাজার। মৌচাকের সামনে বাঁশ ফেলে রাখা জায়গাটুকু হেঁটে পেরুবে। তারপর আবার রিকশায় চড়ে মগবাজারের দিকে যাত্রা করবে।
আনিস বলছে, বস্, আপনার সঙ্গে কথাবার্তা না বললে ভাল্লাগে না বস্!
খাঁটি বেচারা! লকডাউনে দিশাহারা হয়ে তেল দিচ্ছে। মৌবন রেস্তোরাঁ পেরুতে দেখা গেল এক লোক ফুটপাতে দাঁড়িয়ে একটু পরপর টেনে দোকানের শাটার খুলছে, আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ করে দিচ্ছে। কাছে যেতে দেখা গেল ওটা একটা চায়ের দোকান। আনিস লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, চা আছে? লোকটা জবাব না দিয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে আনিসকে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করে টেনে শাটার অর্ধেকটা ওঠালো। আনিস সামান্য ঝুঁকে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে শাটার নেমে গেল।
চা খেয়ে বেরিয়ে মালিবাগ মোড়ের হোসাফ টাওয়ারের কাছাকাছি আসতে দেখে ফুটপাতে ওজন মাপা যন্ত্র নিয়ে এক লোক উদাস ভঙ্গীতে বসে আছে। লকডাউনের মধ্যে কে ওজন মাপাতে আসবে এটা একটা রহস্য বটে। আনিস লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, আজকে মাপছেন? লোকটা কোনো উত্তর দিল না। আনিসের দিকে একবার তাকাল, তারপর আবার উদাস হয়ে গেল।
মালিবাগ মোড়ের মসজিদের কাছাকাছি আসতেই মসজিদ থেকে অসংখ্য লোক বেরুতে লাগল। তারাবি নামাজ শেষ হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভাইয়েরা নামাজ আদায় করে বেরিয়ে আসছেন। যারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভাই না, তারা মসজিদের বাইরে কাপড় দিয়ে ঘেরা জায়গাটার ভেতরে বসে আছেন। সেখানে বিরাট ডেকচিতে করে খিচুড়ি আনা হয়েছে। খিচুড়ির সঙ্গে একটা করে সেদ্ধ ডিম। পঞ্চাশ টাকা প্লেট। ধর্মপ্রাণ মুসলমান না ভাইরা সেখানে বসে খিচুড়ি খাচ্ছেন। আনিস দ্রুত তাদের সঙ্গে যোগ দিল।
আনিসের বস্ তখন কাশতে কাশতে বলছেন, আনিস সাহেব, আপনি বাড়ি যান।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০২১ বিকাল ৩:২৭