বাচ্চাদের সাথে আমার সখ্যতা কেমন এটা আমি নিজেও ঠিক ঠাক জানিনা। বাচ্চাদের সাথে মিশতে হলে বাচ্চা হয়ে যেতে হয়, ওদের মত করে ভাবতে হয় এটা সব সময় সবার মুখে মুখে মুখে শুনে আসলেও আমি খুব ভাল ভাবে বুঝেছি আমার তিন মাসের শিক্ষকতা জীবনে।
বাচ্চা কাহিনী-কাচ্চা কাহিনী: ১
বাচ্চাদের আগ্রহ, কৌতুহল থাকে অসীম। বিশেষ করে শিক্ষকদের প্রতি, আর যদি হয় সেই শিক্ষক নতুন তাহলে তো কথাই নেই! শুরুটা বড় বাচ্চাদের দিয়েই করি। আমি নবম শ্রেণীতে একদিন ক্লাস নিচ্ছিলাম, এই ক্লাসটাই শেষ ক্লাস ছুটির আগে। ছুটির কয়েক মিনিট বাকী এমন সময় আম্মা ফোন দিয়েছেন। পড়ানো শেষ, ফোন রিসিভ করলাম। আমার এক বান্ধবী এসেছে সেটা জানাতে ফোন দিয়েছেন। আমি বান্ধবীকে বসাতে বললাম। আম্মা বললেন আমার সাথে টাকা থাকলে যাতে দুধ নিয়ে যাই চা বানাতে। বললাম দুধ তো ফ্রিজে আছে, আমি গতকাল রাতে রেখেছি। মোটামুটি এরকম কয়েকটা কথা বলে ফোন ছেড়ে ছিলাম। সামনের বেন্ঞ্চে বসা দু'জন ছাত্রী এবার আমাকে বলে, "মিস কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি ?" । অভয় দিয়ে প্রশ্ন শুনে বুঝলাম আমার ফোনের আলাপ শুনে ওরা অনুমান করে নিয়েছে যে আমার বিয়ে হয়েছে এবং বাচ্চা আছে। বললাম বিয়ে হয়নি, এবার তাদের আবার প্রশ্ন তাহলে কথা কার সাথে বললাম। উল্লেখ্য আমি আম্মার সাথে 'তুমি' করে কথা বলছিলাম। সেটা শুনে ওরা ধরে নিয়েছে হাজবেন্ডের সাথে কথা বলেছি। খুব মজা পেয়েছিলাম ওদের এই অনুমান দেখে। মনে মনে ভাবলাম আমরাও তো এরকম-ই করেছি। টিচারদের বিশেষ করে ম্যাডামদের ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে জানার কত আগ্রহ ছিল। কেউ যদি কোন টিচারের বাসায় যেতো তার ভাব-ই ছিল আলাদা!
বাচ্চা কাহিনী-কাচ্চা কাহিনী: ২
তৃতীয় শ্রেণী। আমার চামেলী, আমার মেয়েরা, আমি যেটার ক্লাশ টিচার ছিলাম। সত্যি বলতে স্কুল ছেড়ে আসার সময় আমার খারাপ লেগেছে এই বাচ্চাগুলোর জন্যেই। এখনো মিস করি এদের। একদিন ক্লাসে পড়ানোর পরে এক বাচ্চা খুব আগ্রহ নিয়ে দাড়িয়ে বলছে, "মিস আপনার কয়টা বাচ্চা?" হেসে বললাম আমার বিয়েই হয়নি। বাচ্চাটার মুখটা যা হয়েছিল! ও নিজেও বিব্রত হয়ে গিয়েছিল প্রশ্ন করে।
তো এই বাচ্চারাই আমাকে প্রায়-ই অনুরোধ করতো গল্প, গান বা কবিতা শোনাতে। সময় সুযোগ হয়নি কোন দিন। আমি আবার ওদের বলেছিলাম ওদের ক্লাস পার্টিতে গল্প, গান, কবিতা সব কিছু করবো ক্লাসের সবাই মিলে। এটা নিয়ে খুব উচ্ছসিত ছিল ওরা।
একদিন এক ছাত্রী বলছে আগামী কাল তার জন্মদিন। আমি ভাবলাম এরা যেরকম কাল তো নিশ্চিত কিছু একটা নিয়ে এসে আামাকে দিবেই (এর আগে অন্য দুই ক্লাসে দুই বাচ্চা তাদের জন্মদিনে আমাকে চকলেট দিয়েছিল)। ক্লাসে পারত পক্ষে কোন উপকরণ উপহার দেওয়ায় অনুৎসাহিত করা হয় এটা জানতাম। তাই বাসায় গিয়ে ঠিক করলাম একটা কবিতা শোনাবো। পরদিন স্কুলে গিয়ে দেখলাম ঠিক-ই ক্যান্ডি নিয়ে এসেছে এবং বান্ধবীদের সাথে সাথে আমাকেও দিয়েছি। পড়ানো শেষে বললাম আমি আজ একটা কবিতা শোনাবো যেটা আমার তরফ থেকে লাইসার (যার জন্ম দিন) জন্যে গিফট। বাচ্চারা খুব-ই খুশি হয়েছিল। ছোট খাটো একটা গানের অনুষ্ঠানও হয়েছিল সেদিন। যার জন্মদিন সে ছাড়াও কয়েকজন গান গেয়েছে। খুব উপভোগ করেছিল বাচ্চারা।
এই ক্লাস থেকে প্রায়-ই আমি এটা সেটা গিফট পেতাম, যার জন্ম দিন সে তার পছন্দের টিচারদের কলম বেশি দিত। আমাকেও দিয়েছে অনেক গুলো। একদিন দেখি দুটো কাগজ দিয়েছে। খুলে আমি থ'বনে গেলাম। এত চমৎকার দুটো ছবি! ছবি আঁকা ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই আশ্চর্যের লাগে। আমি ভেবেই পাইনা কিভাবে দাগ টেনে টেনে মানুষ এত সুন্দর জিনিস এঁকে ফেলে!
মুগ্ধতা!
মুগ্ধতা!
আমি যেদিন চলে আসি স্কুল থেকে সেদিন আমিও জানতাম না যে চলে আসবো। হুট করেই সিদ্ধান্ত হয়! আমি কোন ক্লাসেই বলতে পারিনি যে আজ-ই আমার শেষ ক্লাস! কিন্তু ঐদিন ক্লাসে গেলে সকালেই এক বাচ্চা এত্ত সুন্দর এক ফুল দিয়েছিল!
এই সেই চমৎকার ফুল যেটা আমার স্কুলের শেষ দিন দিয়েছিল ছোট্ট এক বাচ্চা!
বাচ্চা কাহিনী-কাচ্চা কাহিনী: ৩
স্কুল থেকে যেদিন চলে আসি ঠিক ঐদিন-ই দুপুরে একটা ফোনকল আসে। বেশ কিছুদিন আগে এক কিন্ডাগার্টেনে সিভি দিয়ে এসেছিলাম। ওরাই ডেকেছে একটা টেস্ট ক্লাস দিতে পারবো কিনা জানতে। আমি পারলে পরদিন-ই যাতে যাই। কিন্ডারগার্টেনে তেমন ইচ্ছে নেই তাও ভাবলাম গিয়ে দেখি কী অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম এতদিন।
অভিজ্ঞতায় যে লবডংকা সেটা পরদিন-ই বুঝেছিলাম!
প্রথমেই দিল চতুর্থ শ্রেণীতে। পরীক্ষা চলছিল তাই সেখানে পড়ানোর কিছু নেই। নাম ডেকে গার্ড দিয়েছি। ছেলে বাচ্চারা যে আসলেই দুষ্টু সেটা সেই দিন-ই প্রথম ক্লাসে গিয়ে বুঝতে পারেছিলাম। যাই হোক পরের ক্লাসেও পরীক্ষা, ক্লাস থ্রীতে গেলাম। এখানে এক হ-জ-ব-র-ল অবস্থা! পরীক্ষায় কোন টাইম নাই, ওদের সবার লেখা শেষ হলে তবেই পরানো শুরু করবো। কারো পরীক্ষা শেষ কারো লেখা এখনো চলছে, কেউ খাতা দিচ্ছে এরকম অবস্থা ক্লাসে। এখানেও পড়াতে আর পারিনি। মনে মনে বললাম যাক বাঁচলাম। একটা বিল্ডিংয়ে খুপড়ির মত ঘরে আমার হাঁপ ধরে যাচ্ছিল। আগের দিন পর্যন্ত আমি ক্লাস করিয়ে এসেছি অক্ষরিক অর্থেই লম্বা বারান্দা ওয়ালা বিল্ডিং যার সামনে বিশাল মাঠ এরকম স্কুলে। পরদিন-ই এই বদ্ধ ঘরে মন না টেকাই স্বাভাবিক।
সময় শেষ হলে অন্য টিচারদের সাথে বসে আছি এমন সময় হেড স্যার এসে নিয়ে গেলেন এক ক্লাসে। কেজি বা নার্সারী ছিল হয়ত সেটা। স্যার বললেন সামনে ওদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আছে তাই সুরা, কবিতা এসব পড়াতে। মনে মনে বললাম খোদা রক্ষা করো! এত ছোট বাচ্চাদের ক্লাস নেইনি কখনো। আসল পরীক্ষা শুরু হল আামার তখন।
আমি আর কী পরিচয় দেবো বাচ্চারাই জিজ্ঞেস করে ফেলেছে , "মিস আপনার নাম কী?" । সুন্দর করে নাম বলে উতরে গেলাম প্রথম পরীক্ষায়। দেখলাম নতুন টিচার বলে ওরা তেমন আন ইজি ফিল করছেনা, বেশ ভাল ভাবেই নিয়েছে।
স্যারের কথা মত সুরা পরানো শুরু করবো এমন সময় এক বাচ্চা মেয়ে জিজ্ঞেস করল, "মিস সুরা কী?" । মনে মনে বললাম বাবারে এইটা আবার কী প্রশ্ন! এর মাঝেই ছেলে বাচ্চাগুলো গন্ডগোল করছে দেখে মনযোগ সেদিকে গেল। মেয়েটিকে সম্ভবত তার পাশের মেয়ে বুঝিয়েছে সুরা কী। আমাকে বলছে, "মিস আমিতো হিন্দু তাহলে আমিও কি পড়বো?" এরকম পরিস্থিতিতে কিভাবে সামাল দিবো বুঝতে পারছিলাম না তাই তাকেও বললাম পড়তে।
এর মাঝেই এক ছেলে পাশের ছেলেকে দেখিয়ে বলছে, "মিস ও বলেছে আমি নাকি ওকে (এক মেয়েকে ইশারা করে) ভালবাসি!!" অনেস্টলি বলছি আমার পরে মনে হয়েছে এটা ছিল আমার খুব খুব বড় একটা পরীক্ষা যেটায় আমি দুঃখজনক ভাবে ফেইল করেছি ! আমি অভিযোগ শুনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম কী উত্তর দিবো কয়েক মুহুর্ত বুঝতে পারিনি। পরে মনে হয়েছিল আমার হয়ত এভাবে বলা উচিত ছিল যে, "ক্লাসে আমরা সবাই বন্ধু, আর আমরা আমাদের সব বন্ধুকেই ভালবাসি"।
প্রথম বলে নিজেকেই নিজে মাফ করেছি। ভবিষ্যতে এরকম পরিস্থিতিতে আর তব্দা খেতে হবেনা।
কারো অভিযোগ, "ও আমাকে বকা দিয়েছে" , কেউ কাঁদ কাঁদ গলায় বলে " ও আমার আম্মুকে মোটা বলেছে" এসব সামলাতে সামলাতে আমার যখন পাগল হবার দশা তখন দেখি এক ছেলে কাঁদছে!! কারন জিজ্ঞেস করতে জানা গেল গার্জেন এক বাচ্চাকে নিয়ে গিয়েছে আগেই। ওর জায়গাটা খালি হলে পাশের ছেলে নিজের সিট টপকে সামনে খালি সিটে বসেছে। অভিযোগকারী বলছে , "আমি ওখানে বসতে চেয়েছিল ও আগে বসে পরেছে"! বললাম যে যার সিটে বসো। কিন্তু কাজ হল না। যে সামনে গিয়েছে সে কিছুতেই ছুটির আগে আর নড়বে না ঐ জায়গা থেকে!
কী আর করা অভিযোগকারীকে বললাম একদম সামনে চলে আসতে কিন্তু সে সামনে আসবে না, ওই সিট-ই চাই তার! অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে শেষে সামনেই বসিয়েছিলাম।
ক্লাস শেষে মনে হল আমার জন্যে এই গুড়াগুড়া বাচ্চা কাচ্চা নয়!
লাস্ট বাট নট লিস্ট
বাচ্চাদের ক্লাসে সবচাইতে চ্যালেন্জ্ঞিং বিষয় হল ওদের অভিযোগ গুলো শোনা এবং ঠিক ঠাক সমাধান করা (ওদের ভাষায় বিচার) । একবার ক্লাস টু-তে এক মেয়ে মাথা নিচু করে কাঁদার ভান করছে, কারন জানতে গিয়ে শুনি এক মেয়ে ওকে হনুমান বলেছে। যে হনুমান বলেছে তাকে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দিল "তুমি যে আমাকে চিড়িয়াখানার বাদর বলেছো!" হাসতে হাসতে শেষ আমি। বললাম দু'জন দু'জনকে সরি বলো। বাচ্চাদের বিচার আসলে তা শুনে এই রায়টা দিতাম বেশির ভাগ। এটা দেখতাম বেশ ভাল কাজ করে ঝগড়া বন্ধ করতে।
একবার এক মেয়ে এসেছে তাকে পাশের মেয়ে খারাপ কথা বলেছে, সরি থেরাপী দিয়ে আমি অন্য কাজে মনযোগ দিলাম। কয়েক মুহুর্ত পরেও তার নামে আবার অভিযোগ এসেছে সেই খারাপ কথা বলেছে আবারো। এবার ওর দিকে তাকাতেই আমি কিছু বলার আগেই ভালমানুষী মুখে বলে, "সরি বলবো?" আমার তো হাসতে হাসতে কাঁদার দশা !নিজেকে কোন মতে সামলে মুখ গম্ভীর করে বললাম হ্যাঁ বলো। আর কখনো পঁচা কথা বলবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৮