তো এক ঘনবনের মাথায় এসে নামল যখন, দেখল একটাই মাত্র পথ চলে গেছে গাঁয়ের দিকে। সেই পথের বাম সারির একেবারে শেষের সুপারি গাছটাকে লেগে গেল ভাল। সে গিয়ে গাছটাকে বলল, 'সুপারি, তুমি চাঁদ হয়ে উড়ে বসো আকাশে, আলোয় কালোয় ক্লান্ত আমি বরং এইখানে পথ পাহারায় কাটাই খানিক কাল।' কী যেন ভেবে কিছুক্ষণ সুপারি বেশ রঙিন, রাজি হয়ে গেল।
সুপারি গাছের সবুজ বেশে চাঁদ যেদিন থেকে বসল সেই পথ পাহারায়, তার ঠিক দিন সাতেক পরের ঘটনা।
এক বালক , বারোর মতোন বয়স, সঙ্গী নাই, সাথিহীন, যেন ভেসে ভেসে হেঁটে এল গাঁয়ে। কেউ দেখেনি কখন; কেউ জানে না কোথা থেকে। এসে বসল যে সোজা দীঘির পাড়ে, না মুখে কথা , না গান , না হাসি। নানান জনে নানান রকম নানানভাবে জানতে চাইল অতীত, উদ্দেশ। কিন্তু কিছুতেই কিছুনা। অমাবস্যার অন্ধকার, শাওন মাসের ভরা বাদল সবকিছু মাথায় নিয়ে রইল বসে কথাহীন।
কিন্তু চোখে ছিল জনমের জনমের কাহিনী। তার মন, মা, রক্তের আবেগ, ভবিষ্যত, দূর-অদূর অতীত সমস্ত সেই চোখে ছিল স্পষ্ট করে আঁকা। শতজনের মাঝে একজনই কেবল বুঝল সেইসব ছবি, সেই কাহিনীর বুঝল সকল মানে। ঝাকড়া চুল, মলিন জামার কোমল লোকটা ভরাবৃষ্টির সেই দীঘির পাড়ে, অন্ধকারের ছায়া যেমন, বসল এসে। তারপর পাষাণ হাতে খেজুর-কাঁটায় বালকের গল্পভরা দুই চোখ রক্তরঙে তুলে ধীরে ধরল পথ।
গ্রামের সেই একমাত্র পথ। যেখানে চাঁদ সবুজ সুপারি হয়ে নির্ঘুম পাহারায়।
নিদারুণ লোকটা একটা কদম হাঁটে আর দুই হাতের দুই চোখ থেকে একটা করে গল্প পড়ে শোনায় পথজোড়া সবাইকে। বালকের চোখ থেকে পড়া সবশেষের গল্প ফুরাল যেভাবে:
'চাঁদ তার সবুজ পাতায় আমার শরীরের প্রথম আর শেষ আবেদন পূরন করে দিল। চাঁদের আকুল আদর পেলে, রক্তজুড়ে, বুক, মুখ হৃদয় জুড়ে অন্ধকারের বিশাল রকম সাধ জাগে।'
প্রথম বীর্যপাতের সুখ বুকে নিয়ে যে বালক সেদিন অন্ধ হওয়ার আশায় বৃষ্টিভেজা বসেছিল, আগের জন্মে সে ছিল ব্যাকুল রাধার খোঁপার ফুল, তারও এক জন্ম আগে অর্জুনের কৃষ্ণকাতর তীরের ফলা।
ছবি: ভ্লাদিমির কুশ
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ২:৩৫