লিচু পায়ে পায়ে নূরীর কাছে এসে দাঁড়ায়। নূরীর কান্না আরো বেড়ে যায়। লিচুরও চোখে পানি। মা কেন এমন করছ, একটু বোঝার চেষ্টা কর। আমিতো অন্যায় কিছু করছি না।
কি বলিস তুই, অবশ্যই অন্যায় কাজ। তুই দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ট্রেনিং নিচ্ছিস, এটা খুব অন্যায়। কেউ এটা ভাল চোখে দেখবে না। তোর ভীষন বিপদ হবে। কেন এসবের মধ্য তুই যেতে চাস বল!
কারন এটাই আমাদের জন্য একমাত্র পথ। লিচু কি দৃঢ় স্বরে বলে উঠে।তুমি নিজেকে দেশের সবার থেকে আলাদা কি করে ভাব? আমরা আর কত অন্যায় সহ্য করব? কেন করব?
নূরী চমকে যায়। সে বুঝতে পারে না তার ছেলে এভাবে কথা বলছে। যে ছেলে কোন দিন মায়ের মুখের উপর কোন জবাব দেয়নি, সে আজ তার জীবনের দিক নির্দিষ্ট করে ফেলেছে, তার সাথে কোন আলাপ ছাড়াই। নূরী রাগে দুঃখে এখন বিলাপ করতেও ভুলে যায়। যা তুই আমার সামনে থেকে সর, ঠেলে লিচুকে সরিয়ে দেয়।
মা তুমি খামোখা তিলকে তাল করছ, আরে সত্যি কি আর যুদ্ধ হচ্ছে না হবে! এটা একটা প্রস্তুতি আর কি, যদি হয় তখন যেন সবাই অস্ত্র তুলে নিতে পারি। দেরি যাতে না হয়।
নূরী তাও সান্ত্বনা পায় না। লিচুর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ চেহারা সে দেখেছে। সে মনে করছে লিচু যা ভাবছে তাই করে ছাড়বে। তবু তার কান্না একটু থামল। ফোঁপাচ্ছে। লিচু আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হয়ে এল। মতিন কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। লিচুকে দেখেই সরে গেল। লিচু বোঝে, মায়ের কান্না মতিন সহ্য করতে পারে না। বেচারির নিজের মায়ের কথা মনে পরে যায় হয়তবা! জাভেদের কাছে গেল। সে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। লিচুকে দেখে সোজা হয়ে বসল। কি রে এখনও কাঁদছে?
না এখন চুপ হয়েছে।
ওরা দুজনেই বসে থাকে। অন্ধকারে, ঘরে কোন কুপি জ্বালানো হয়নি। হ্যারিকেনটা মায়ের কাছে। মশা কামড়াচ্ছে। লিচু বের হয়ে মতিনকে বলে ঘরে ধুপ দিতে আর কুপি জ্বালিয়ে দিতে। সে রান্নাঘরে উকি মারে। রাজা চাচি মাটির চুলায় ভাত বসিয়েছে। টগবগ করে ভাত ফুটছে। চাচির মুখটা আগুনের আভায় কেমন লাল হয়ে গেছে। রেগে গেছে নাকি! হঠাৎ লিচুর মনে হল চাচা চাচি মনে হয় ওরা আসাতে খুব একটা খুশি নয়।তার খুব খিদা পেয়েছে। কিন্তু চাচিকে বলার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলল। মনে একরাশ চিন্তা নিয়ে নূরীর কাছে গেল।
মা আমার খুব খিদে লাগছে। উঠো না।
নূরী চোখ মুছে উঠে পরে। যত রাগই থাক লিচু খেতে চেয়েছে, নূরীর সব রাগ পানি। একটু পরে লিচুকে খেতে ডাকে। রান্নাঘরেই বসে খায়। গরম ভাত আর ছোট মাছের ঝোল। সাথে আলু ভাজি।
দুপুরে কি খেলি? নূরী হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে। খিচুরি আর ডিম ভাজি। জানো মা আমরা অনেক ছেলে ছিলাম, সবাই মিলে একসাথে বসে খেলাম, নাসির মামাও খেল আমাদের সাথে।
কে রান্না করল?
ওদের রান্নার লোক আছে। সেই করল। কি বিরাট পাতিলের মধ্যে খিচুরি, অনেক মজা লাগছে। লিচু একটু আড়চোখে মায়ের দিকে তাকায়। তারপর বলে তোমার রান্নার মত মজা হয় নাই। নূরী শুনে খুব খুশি হল।
লিচু চেটেপুটে খেয়ে উঠল। সারাদিনের ক্লান্তি তাকে এখন ভর করেছে। খাওয়ার সময়ই সে হাই তুলতে থাকে। মা আমি ঘুমাতে যাই, খুব ঘুম পাচ্ছে। মতিনকে বল আমার মশারিটা খাটিয়ে দিতে।
তোর বাবাকে খেতে আসতে বল। আমি ভাত নিয়ে বসে আছি।
আচ্ছা বলি।
জাভেদকে ডেকে লিচু ঘুমাতে যায়। ঘুম আসে না। বিবিসির শোনা খবরগুলি মাথার মধ্য ঘুরপাক করতে থাকে। সামনে পাকিস্হানের জাতীয় দিবস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঐ দিন স্বাধীন বাঙলাদেশের পতাকা উড়ান হবে এবং সেটা সারা দেশেই করা হবে। এই নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলছে আসলেই কি ঐ দিন পাকিস্হানের পতাকা না উড়িয়ে বাঙলাদেশের পতাকা উড়বে? আচ্ছা লিচুরা কি করবে? নাসিরের সাথে কাল আলাপ করতে হবে। পতাকা কে বানাবে, এখানে এই অজ পাড়াগায়ে কি এসব করা ঠিক হবে, নানান চিন্তা নিয়ে লিচু ঘুমিয়ে পরে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে অনেক দেরি হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে সে নাস্তা করার জন্য মায়ের কাছে যায়। আটার রুটি সুজি আর চা। জলদি করে খেয়ে নেয় সে। বাবাকে দেখা যাচ্ছে না। নূরীকে জিজ্ঞেস করে জানল বাবা হাটে গেছে। এত সকালে হাটে? বাজার সদাই কিছু নাই, সব করতে হবে। মতিনকে নিয়ে গেছে।
লিচু খুব আশা করে বসেছিল আজ মতিনকে নিয়ে নাসিরের ওখানে যাবে। এখন কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে! একরাশ বিরক্তি নিয়ে লিচু পুকুর পারে চলে এল। একটা সিগারেট ধরাল। কয়েকদিনের অভ্যাসের পর এখন সে ভালই সিগারেট টানতে পারে। লোকজনের হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে, এখানে আবার কে এল? নাহ শান্তি পাব না মনে হচ্ছে। জোরে দুইটান দিয়ে সিগারেট শেষ করে লিচু বাড়ির দিকে রওনা দিল। তার চোখে পলক পড়ছে না। নয়ন আর ছোট দুই মামা ,বাবু আর শফি, দাঁড়িয়ে আছে।
কি ব্যাপার তোমরা হঠাৎ করে! লিচুর খুব খুশি লাগছে। দিন দুনিয়ার খবর জানতে পারবে। নয়ন আবার তার জন্য কিছু পুরোন পত্রিকা নিয়ে এসেছে। লিচু আর কোন কথা না বলে পত্রিকা পড়তে বসে গেল।
নূরীর সাথে ভাইদের অনেক কথাই হল। তালুকদার সাহেব বিশেষ করে বলে দিয়েছেন ওদের ফিরে আসার জন্য। কিন্তু লিচুতো এখন ফিরতে চায় না। কয়েক দিন পরে যাবে। ওরা অপেক্ষা করছে জাভেদের ফিরে আসার জন্য। সে আসলে জানা যাবে কখন ফিরবে ওরা নানাবাড়িতে।
লিচুর খুব সন্দেহ লাগছে, মামাদের হঠাৎ করে এখানে আসার ব্যাপারে। নিশ্চয়ই মা খবর দিয়ে আনিয়েছে। তাই যদি হয় সে যাবে না, মা যেতে চায় যাক। আমি যাব না, খুব দৃঢ় ভাবে সে সিদ্ধান্ত নেয়।
নয়নের সাথে লিচুর অনেক কথা হল। নাসিরের কথাও বললো। নয়ন শুনে চমৎকৃত। সে লিচুকে ধরে বসল নাসিরের ওখানে সেও যাবে। লিচু রাজি হল। বাবু আর শফিও রাজি, ওরাও যাবে। লিচু ওদের সবাইকে নিয়ে রওনা হল। সে রাস্তা চিনে ঠিকই হাজির হল সীমান্তে। যথারীতি নাসির মনুদেরকে ট্রেনিং দেয়া শুরু করেছে। লিচু আর তার দলবলকে দেখে সে খুব অবাক আর খুশি।
লিচু তার সর্বশেষ বিবিসিতে শোনা খবর জানাল। দেশব্যাপী পতাকা উত্তোলনের ঘোষনার কথাও বলতে ভুললো না। নাসির বলে আমি জানি, ওয়ারলেসে ঢাকা থেকে শুনছি।কিন্তু আমার পক্ষে সরাসরি বাঙলাদেশের পতাকা উড়ান সম্ভব না। কিন্তু তোমরা পার। তোমরা অবশ্যই পতাকা উড়াবে। শুনেই লিচুর মনে হলো এখনই গিয়ে পতাকা বানানোর কাজ শুরু করে দেয়।
বাবু আর শফি সিদ্ধান্ত নিল ওরা ফিরে যাবে, নয়ন থাকবে লিচুর সাথে। দুইদিন পর পর ওরা যোগাযোগ করবে, কি হচ্ছে না হচ্ছে সব জানাবে ওদের।