somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পুনরাবৃত্তির গল্প [গল্প]

১৬ ই অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৩:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খুব ছোটবেলায় যখন মা'টা হুট করে সংসারের সমস্ত হাড়ি-পাতিলের হিসাব-নিকেশের ভার, আর সাথে উপহার হিসেবে ৬ বছরের ছোট দুধের ভাইটার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে পালিয়ে গেলেন, বরং বলা ভাল পালিয়ে গিয়ে বাঁচলেন, তখনই আমার আজন্ম বোকা বোকা চেহারার মা'কে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মনে হল। আর, সবার কাছে ধুরন্ধর বলে পরিচিত আমার বাবাকে সেদিনই প্রথমবারের মত মুখ-চোখ কালো করে থম মেরে বসে দেখলাম দেউরির পাশে। দেখতে খারাপ লাগছিল না। জ্ঞান হবার পর থেকেই যে দৃশ্যটা দেখে বড় হয়েছি, দেখতে দেখতে চোখে সয়ে গেছে, যেটা না দেখলে মোটামুটি রাতের ভাত হজম হত না, ঘুমাতে যাবার আগে কি যেন একটা কিছু বাকি রয়ে গেল, কি যেন একটা কাজ আজ করা হল না মনে হত, সেই বাবার হাতে মায়ের মার খাবার দৃশ্যটা দেখে প্রথম দিককার মতই প্রতিদিনই চুপিচুপি চোখের জল ফেলা; সেই দৃশ্যের আর অবতারণা হবে ভেবে প্রথমে খুশিই হয়েছিলাম। আবার পরমুহূর্তেই মনে হয়, হায় আর তো আমার প্রচন্ড গরমে কাঁথার আশ্রয়ও নেয়া হবে না। কান্না ঢাকতে যে কাঁথা, তার তো প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই আবার একটু মায়াও বুঝি লাগে আমার। নাহ, মা'র জন্যে না, আমার রোজকার সাথী কাঁথার জন্যে।
ভাইটার মনে হয় ক্ষিদা লাগে। ট্যাঁ করে কেঁদে ওঠে। নীরবতা বোঝে না, পরিবেশ বোঝে না, শুধু বোঝে তার নিজেরটা। বাবা একটু আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ঘুরিয়ে শূণ্য চোখে উঠানের দিকে তাকান। নিজেকে একটা গাধা মনে হয় আমার। ইস, যদি ভাইটার মত স্বার্থপর হতে পারতাম। ক্ষিধা তো আমারও লেগেছে। গত রাত থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। ঘরে রান্না চড়ে নি। অন্যান্য দিন অন্তত মুড়ি-চিড়া থাকে, আজ কপাল এতই খারাপ, কিছুই নেই। শুধু পানি খেয়ে ঘুম। চিন্তায় বাধা পরে, স্বার্থপরটা তারস্বরে আবার চেঁচিয়ে ওঠে। ওফ্, বড্ড জ্বালাতন করছে।
চেঁচাতে চেঁচাতে একটা সময়ে এসে সব শান্ত হয়ে যায়। হয়ত, বাবুটা ক্লান্ত হয়ে বুঝে যায়, আজ তার কান্না শুনতে কেউ বসে নেই, তাই চুপটি মেরে যায়। কিংবা, আমাদের কানেই সব সয়ে যায়। যেমন, সয়ে যায় আর দশজনের কাছে বাবাকে নিয়ে শোনা কানাঘুষাগুলো। নিজের বাবা তো, তাই হয়ত কানাঘুষা। নাহলে কথাগুলো যে মিথ্যেও না, সেটা নিজেই ভালো করে জানি। কি এমন কাজ করে দিনের বেলা ঘুমায়, আর সন্ধ্যা হলে তার কাজের যাবার প্রস্তুতি। আমি তো খুকি নই, বুঝ আমারো হয়েছে। তাই, পাশের বাড়ির ছোটন চাচা'র অনাবশ্যক আদরও আমি বুঝি। আদরের ছলে গায়ে হাত দেবার প্রবণতাও আমার দৃষ্টি এড়ায় না। কিছুই বলি না। কি হবে বলে? সব সয়ে যায়।
হুট করে ঘরের দরজার পাশে রাখা খাঁচা খুলে একমাত্র রাতা'টা উড়ে বেরিয়ে আসে। অনেকক্ষণ ধরেই চেষ্টা করছিল, এইমাত্র সফল হল। খাঁচার মুখে রাখা পিড়ি'টা পরে ধুপ করে শব্দ হয়। রাতা'টা তার সাফল্যে গর্বিত। মাথার ঝুঁটিটা তাই আজ মনে হয় আরেকটু উঁচু করে এগিয়ে যায় মুরগিগুলোর দলের দিকে। সেখানে সে'ই রাজা। বাকি সব মুরগিরা তার দাসানুদাস। ঠিক আমার বাবা'র উল্টা। ঘরের বাইরে গেলে চুপ। সাত চড়েও রা নেই। কিন্তু, ঘরে এলেই আমাদের উপর চোটপাট। মা'র গায়ে হাত তোলা তো নৈমিত্তিক, তার কয়েকটা আবার মাঝে মাঝে উপরি হিসেবে আমার পাওনা।

কি সব ভাবছি? একটু আগে বাবাও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কি পরিবর্তন হল সেদিনের সাথে আজকের? আমি বড় হয়েছি, সংসার হয়েছে। আমার বাচ্চার একটা বাবা হয়েছে। আর বাবু? সে আমাদের সাথে থাকে না। শহরে গিয়েছে। আর সবার মত বড়লোক হবে, এই আশা। কিন্তু, খোঁজ নেই বছর খানেক। কোথায় আছে কে জানে?
একটা ব্যাপারের ব্যতিক্রম নেই। সেদিনও সে বুঝতে পারে নি মা'র চলে যাওয়া, আজ তো সেই হয়ত জানতেই পারবে না।

হাতে একটুকরো বনরুটি আর একটা সাগরকলা কিনে খেতে খেতে একটা ছেলে শহরের রাস্তায় হেঁটে যায়। কোত্থেকে একটা কাক এসে রুটিটায় ঠোকর মেরে ভাগ বসাতে চায়। হাতের আঙুল ক'টা রক্তাক্ত। উফ্। য্ন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতে গিয়েও থেমে যায়। হয়ত, ক্লান্ত ছেলেটা বুঝে যায়, আজ তার কান্না শুনতে কেউ বসে নেই, তাই চুপটি মেরে যায়। কিংবা, আমাদের কানেই সব সয়ে যায়।
৩৫টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×