somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চন্দ্রগঞ্জ ও সোনাইমুড়ির মুক্তিযুদ্ধ - সত্যেন সেন (১ম পর্ব)

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০০৭ রাত ৮:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের চর এসে সংবাদ দিল, সামরিক ভ্যান বোঝাই একদল পাকিস্তানি সৈন্যরা ফেনী থেকে চন্দ্রগঞ্জের দিকে আসছে। ওদের যখন চন্দ্রগঞ্জের দিকে চোখ পড়েছে, তখন ওরা সেইখানে লুটপাট না করে ছাড়বেনা। খবর পেয়ে লাফিয়ে উঠলেন সুবেদার লুৎফর রহমান। বেঙ্গল রেজিমেন্টের লুৎফর রহমান, যিনি এই অঞ্চলে একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করেছিলেন। সৈন্যদের সংখ্যা পঞ্চাশ-ষাটজনের মত হবে। এদের প্রতিরোধ করতে হোলে দলে কিছুটা ভারী হয়ে নেওয়া দরকার। খোঁজ-খবর করে অল্প সময়ের মধ্যে মাত্র ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে জড় করা গেল।

সাতজন মানুষ, সাতটি রাইফেল-এই সামান্য শক্তি নিয়ে ওদের সঙ্গে মোকাবেলা করতে যাওয়াটা ঠিক কি? মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন এই প্রশ্নটা তুলেছিলেন। কথাটা মিথ্যা নয়- এটা একটা দূঃসাহসের কাজ হবে। অথচ হাতে সময় নেই। মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন, তার মধ্যে এই লুন্ঠনকারী দস্যুরা এদের কাজ হাসিল করে সরে পড়বে। চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটে যাবে আর তারা বসে বসে তাই দেখবে। না, কিছুতেই না, গর্জে উঠলেন সুবেদার লুৎফর রহমান, যেভাবেই হোক এদের প্রতিরোধ করতেই হবে। আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ওরা অক্ষতভাবে হাসতে হাসতে চলে যাবে, এ কিছুতেই হতে পারেনা। ওরা আমাদের রক্ত নিয়েছে, তার বিনিময়ে ওদেরও কিছুটা রক্ত দিতে হবে।

রাস্তার ধারে একটা বড় রকমের ইটের পাঁজা। কে যেন কবে একটা দালান তোলবার জন্য এখানে এই ইটগুলি এনে জড় করে রেখেছিলো, অনেকদিন হয়ে গেল, সেই দালান এখনো গাড়ীগুলিকে এই রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। সুবেদার লুৎফর রহমান আর ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা, সেই ইটের পাঁজার পেছনে পজিশন নিয়ে দাঁড়ালেন। এখান থেকেই তাঁরা সেই হামলাকারী দস্যুদের প্রতিরোধ করবেন, এটা খুবই দূঃসাহসের কাজ তাঁরা জানতেন, তাঁরা তাঁদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চলেছেন। কিন্তু এমন এক একটা সময় আসে যখন জেনে শুনে বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন। অবস্থা বিশেষ বামন হয়েও তাঁদের দানবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করতে হয়। মুক্তিবাহিনীর সুবেদার লুৎফর রহমান বললেন, এখনকার অবস্থা হচ্ছে তেমনি এক অবস্থা। কিন্তু বেশী কথা বলার সময় ছিল না। দূর থেকে অস্ফুট সামরিক ভ্যানের গর্জন শোনা গেলো। ঐ যে, ঐ যে আসছে। ওরা! তাঁরা সাতজন সাতটি রাইফেল নিয়ে তৈরী হয়ে দাঁড়ালেন। সেই অস্ফুট আওয়াজ ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠতে লাগলো। তারপর একটু বাদেই দেখা গেলো সামরিক ভ্যান পথের ধুলো উড়িয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসছে। উত্তেজিত প্রতীক্ষায় তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি যেন ইস্পাতের মত দৃঢ় আর কঠিন হয়ে এল।

সামরিক ভ্যান দ্রুত আসতে আসতে হঠাৎ থেমে গেলো। না থেমে উপায় ছিল না, কাদের অদৃশ্য হস্তের গুলিতে গাড়ির টায়ারের চাকা ফুটো হয়ে গেছে। একই সঙ্গে কতগুলি রাইফেলের আওয়াজ। বিস্ময়ে, আতঙ্কে সৈন্যরা ঝুপঝাপ করে গাড়ী থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লো। কিন্তু সেই অদৃশ্য হস্তের গুলিবর্ষণের যেন শেষ নেই। সৈন্যদের মধ্যে যারা সামনের দিকে ছিল, তাদের মধ্যে অনেকে হতাহত হয়ে ভূমিশয্যা নিল। একটু বাদেই রাইফেলের আওয়াজ থেমে গিয়ে পল্লী-প্রকৃতির নিস্তবদ্ধতা আর শান্তি ফিরে এল। সৈন্যরা সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তন্ন তন্ন করে চারদিক পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। অদৃশ্য শত্রুরা কি তবে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছে? না, ওদের বিশ্বাস নেই, একটু বাদেই হয়তো ওরা আরেক দিক থেকে আক্রমণ করে বসবে। রাস্তার দু'পাশে অনেক ঝোপঝাড় জঙ্গল। তাদের মাঝখানে ওরা কোথায় আশ্রয় নিয়ে বসে আছে কে জানে। তবে দলে ওরা ভারী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে এমন করে হামলা করতে সাহস পেত না।

চন্দ্রগঞ্জ সমৃদ্ধ অঞ্চল। এখানে এসে অবাধে লুটপাট করা যাবে, এই আশা নিয়ে তারা এখানে এসেছিল। এই অঞ্চলে তাদের একজন দালাল ছিল। তার কাছ থেকে খবর পেয়েই তারা লুটের আশায় এখানে ছুটে এসেছে। তারা শুনেছিলো এখানে তাদের 'বাধা' দেবার কেউ নেই। কিন্তু হঠাৎ করে কে জানে কোথা থেকে এই শয়তানের দল মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কে জানে, হয়তো ওরা ইতিমধ্যে তাদের চারিদিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেছে। প্রতিটি গাছ আর প্রতিটি ঝোপঝাড়ের আড়ালে যে একজন করে শত্রু লুকিয়ে নেই এমন কথাই বা কে বলতে পারে। ওদের রাইফেলগুলি এবার এলোপাথাড়ি ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষণ করে চলল। এইভাবে বহু গুলি অপচয় করার পর তারা থামল।

কিছু সময় নিঃশব্দে কেটে গেলো। সৈন্যরা ভাবছিল, তাদের অদৃশ্য শত্রুরা সম্ভবত পালিয়ে গেছে। এমন প্রবল গুলি বৃষ্টির মধ্যে ওরা কেমন করে দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু তা'হলে যারা হতাহত হয়ে ভুমিশয্যা নিয়েছিলো, ওরা তাদের একজন একজন করে ভ্যানের উপর তুলছিল। ঠিক সে সময়ে আবার কতগুলি রাইফেল এক সঙ্গে গর্জে উঠলো। গুলির পর গুলি আসছে, বিরতি নেই। সৈন্যদের মধ্যে এক অংশ আছে ভ্যানের উপরে, অপর অংশ রাস্তায়। অদৃশ্য হস্তগুলি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এদের লক্ষ্য করে করে গুলি ছুঁড়ছে। একটি গুলিও বৃথা যাচ্ছে না। সৈন্যদের মধ্যে ভীষণ হট্টগোল পড়ে গেল। তারা একটু সামলে নিয়ে আবার প্রবলভাবে গুলি বর্ষণ করে চলল। কিন্তু তাদের সামনে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। এই ভাবে কিছুক্ষণ দু'পক্ষের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলল। ইতিমধ্যে সৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলছে। অপর পক্ষে অদৃশ্য প্রতিপক্ষের কি পরিমান ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তা বোঝার কোন উপায় ছিল না।

অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠল সৈন্যরা। কিন্তু একটু আগে তাদের দালাল সেই লোকটি তাদের সাহায্য করবার জন্য এসে গেছে। সে অত্যন্ত চতুর লোক, চারিদিকে ভাল করে নজর করে সে এই রহস্যটা বুঝতে পারল। দূরবর্তী ইটের পাঁজাটার পেছনে অঙ্গুলী নির্দেশ করে সে বলল, আমার সন্দেহ হয়, ওরা ঐ পাঁজাটির পেছনে দাঁড়িয়ে গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক কথাইতো, এই সন্দেহটা সকলের মনেই জাগা উচিৎ ছিলো। কিন্তু এতক্ষণ এই কথাটা ওদের কারও মাথায় আসেনি।

এবার ওদের রাইফেলগুলি একেবারে নিঃশব্দ হয়ে গেল। সৈন্যরা তিনভাগে ভাগ হয়ে অতি সন্তর্পণে তিনদিক দিয়ে এগিয়ে চলল। ইটের স্তুপটাকে ঘেরাও করে ফেলতে হবে। খুব সাবধান, ওদের একটাও যেন সরে পড়তে না পারে।
মুক্তিবাহিনীর জওয়ানরা ইটের পাঁজার আড়াল থেকে সবকিছুই দেখছিল। সৈন্যদের মতলব বুঝতে তাদের বাকী রইলো না।
আর এক মুহূর্ত দেরী করার সময় নেই। এখনই তাদের সরে পড়তে হবে। এই সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে তারা যতটা আশা করেছিল, তারচেয়ে অনেক বেশী কাজ হাসিল করতে পেরেছে। এবার তারা স্বচ্ছন্দে ছুটি নিতে পারে। একজন একজন করে সাতজন মুক্তিযোদ্ধা ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার কিছুটা বাদে শিকার সন্ধানী সৈন্যরা এসে সাফল্যের সঙ্গে সেই ইটের স্তুপটাকে ঘেরাও করে ফেলল। কিন্তু কি দেখল এসে? দেখল, পাখিগুলি তাদের একদম বোকা বানিয়ে দিয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে চলে গিয়েছে। ইটের পাঁজার পেছনে একই জনপ্রাণী নেই। শুধু মাটির উপরে অনেকগুলি কার্তুজের খোল ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ে আছে।

সেদিনকার যুদ্ধে সবসুদ্ধ ২৩ জন সৈন্য হতাহত হয়েছিল। আর মুক্তিবাহিনীর সাতটি জওয়ান সম্পর্ণ অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। যে দেশদ্রোহী দালালটি শত্রুদের সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এসেছিল, এর কয়েকদিন বাদেই মুক্তিযোদ্ধারা তাকে খতম করল।

সেইদিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ঘা খেয়ে পাক সৈন্যদের চূড়ান্তভাবে নাকাল হতে হয়েছিল। চন্দ্রগঞ্জে লুটপাট করা দূরে থাক, হতাহত বন্ধুদের নিয়ে গাড়ী বোঝাই করে ওরা মাথা হেঁট করে ফিরে এসেছিল। কিন্তু এই অপমান আর লাঞ্ছনা ওরা ভুলে যেতে পারেনি। দিন কয়েক বাদে ওরা আবার নতুনভাবে তৈরী হয়ে চলল চন্দ্রগঞ্জের দিকে। তাদের মনের জ্বালাটা এবার ভাল করেই মিটিয়ে নেবে।

(চলবে)


*রবিউল হোসেন কচি সম্পাদিত নোয়াখালী পৌরসভা কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণা ও তথ্যভিত্তিক স্মারকগ্রন্থ “নোয়াখালী” থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকাশকালঃ ২ জুলাই ১৯৯৮
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ৮:২৬
১৩টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×