স্বাগত, হে ব্লগ পরিব্রাযক! মোল্লা সাদরার ব্লগে আপনাকে সুস্বাগতম!
আমার ব্লগ নাম দেখেই অনেকে আঁতকে উঠবেন। এই আমলে নামের আগে মোল্লা থাকাটা সমীচীন নয় মোটেই। স্থানীয়ভাবেও মোল্লা শব্দটি এই মুসলিম জনসংখ্যাধিক্যের দেশে মোটামুটি একটি ডেরোগেটোরি টার্ম, অথবা, তাচ্ছিল্য প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। আর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল, এবং বর্তমান ভূ – রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে ‘মোল্লা’ টাইটেলটি তো ত্রাশের সঞ্চার ঘটাতে বাধ্য। হে হে হে।
অত্যুৎসাহী কেউ যদি গুগুলে নাম ঢুন্ডে এন্টার বাটনে ইতোমধ্যে একখানা ঠুয়া দিয়ে থাকেন, এই নামের আদি উৎস খুঁজবার উদ্দেশ্যে – তাহলে কেউ কেউ আবার এই ব্লগের মধ্যে পারসিক প্রোপ্যাগান্ডা খুঁজে পাইতে পারেন। মোল্লা সাদরা, সাফাবিদ পারশিয়ার একজন অন্যতম অস্তিত্ববাদী দার্শনিক ছিলেন, ধর্মীয় দিকে যিনি ছিলেন ইমামি শিয়া।
১৫৭১ সালে, ইরানের সিরাজ নগরের ফার্স প্রদেশে মোল্লা সাদরার জন্ম। এই প্রদেশটিকে সাফাবি সরকার মোটামুটি স্বায়ত্তশাসন দিয়ে রেখেছিল। সাদরার বাবা, খাজা ইব্রাহীম কাভামি ছিলেন এই প্রদেশের উচশিক্ষিত, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসক। দীর্ঘদিন নিঃসন্তান থাকবার পর তিনি এই পুত্র সন্তানের জনক হন। প্রাথমিকভাবে এই সন্তানের শিরোনাম মোহাম্মদ, এবং ডাকনাম ইব্রাহীম রাখা হলেও পরিবারের সবাই তাকে ‘সাদরা’ – নামেই ডাকা শুরু করেন। ‘সাদরা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রধান কাজী / বিচারক। চিফ জাস্টিস, এবং হেড ক্লারিক। পরবর্তী জীবনে তার খ্যাতি আরও ছড়িয়ে পড়লে তার নামের আগে শিরোনাম হিসেবে ‘মোল্লা’ যুক্ত হয়, তৎকালীন পারস্যে যার আভিধানিক অর্থ ছিল অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তি।
পারস্যের উচ্চকোটি পরিবারের সন্তানদের মতো মোল্লা সাদরার প্রাথমিক পড়াশোনা গৃহে, গৃহশিক্ষকদের কাছেই শুরু হয়। এখন যেমন সন্তানদের জন্যে বাবা মা’রা শৈশবে মূলত সেপারা – কোরআন, এবং পরবর্তীতে ইংরেজি – গণিত ইত্যাদি বিষয়ে মৌলভী – মাষ্টার রেখে পড়ান, ৫০০ বছর আগের পারস্যে ব্যাপারটা অমন ছিল না। মোল্লা সাদরাকে গৃহশিক্ষকদের কাছে ফার্সি – আরবি ভাষা ও সাহিত্য, ক্যালিগ্রাফি অঙ্কন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, হাকিমি, ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স ইত্যাদির পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়া, কমব্যাট টেকনিক, শিকার এবং অস্ত্র চালনের শিক্ষা লাভ করেন। পরিনত বয়সে তিনি পড়াশোনা করেন কাজভিন, এবং ইস্ফাহানে, হাদিস শাস্ত্র, দর্শন, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, এবং হেরমেন্যুটিক্স – এ। যদিও সাদরার মূল আগ্রহের বিষয় ছিল বরাবর মিস্টিক্যাল ফিলোসফি, বা আধ্যাত্মপ্রসূত দর্শন। সাফাবি পারস্যের ইস্ফাহান ছিল জ্ঞান বিজ্ঞানের তীর্থস্থল। সাদরার দু’জন প্রধানতম শিক্ষকের নাম আমরা জানতে পারি, তাদের মধ্যে বাহাউদ্দিন আল আমিলি ছিলেন তত্ত্বীয় গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রকৌশল ও স্থাপত্যবিদ্যার স্বনামধন্য শিক্ষক। অপরদিকে, মোল্লা সাদরার অপর শিক্ষক, মীর দামাদ, ছিলেন পেরিপেট্যাটিক / অ্যারিস্টোটলিয়ান দর্শন, এবং সুহরাওয়ার্দী সুফি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শিহাবুদ্দিন সুহরাওয়ার্দীর ইশরাকি / ইল্যুমিনেশনিস্ট ইসলামিক দর্শনের বড় উস্তাদ। মূলত মীর দামাদকেই মোল্লা সাদরা তার মূল উস্তাদ, এবং আধ্যাত্মিক রেহবার / পথ প্রদর্শক মানতেন।
শিক্ষা সমাপ্তির পর, ইমামি শিয়া উলামাদের প্রচলিত ধর্ম ও দর্শন ব্যাখ্যার কিছুটা বাইরে গিয়ে আনঅর্থোডক্স উপায়ে নিজের প্রশিক্ষন, এবং তৎসংক্রান্ত মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে ইস্ফাহানের শিয়া ক্লারিকদের রোষের শিকার হয়ে ইস্ফাহান ত্যাগ করা লাগে মুল্লা সাদরার। পারস্যেরই কুম শহরের কাছাকাছি এক গ্রামে থেকে কিছুদিন পড়াশোনা, শিক্ষকতা, দর্শন চর্চা এবং লেখালিখির কাজ চালিয়ে যাওয়ার ফাঁকেই তিনি তার জন্মভূমি সিরাজ থেকে ডাক পান। সিরাজের ফার্স প্রদেশের গভর্নর আলী কুলী খান প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার দায়িত্ব নিতে বলা হয় তাকে। এই মাদ্রাসা থেকেই মোল্লা সাদরা তার পরবর্তী শিক্ষা ও ইসলামিক দর্শন সংক্রান্ত গবেষণার প্রকল্প চালিয়ে যান।
বর্তমান সময়ে অস্তিত্ববাদী দর্শন যেভাবে প্রচলিত, তার থেকে অ্যাপ্রোচের দিক থেকে অনেক ভিন্ন হলেও, এক্সিস্টেনশিয়াল, বা অস্তিত্ববাদী দর্শনের জনক বলা হয় তাকে। এছাড়াও ‘হারাকাত – আল – জাওহারিয়্যাহ’ , বা চৈতন্য প্রবাহ, কার্যকারণসম্বন্ধ, জ্ঞানের এপিস্টেমোলজি, সত্য এবং বাস্তবতা – ইত্যাদি বিষয়ে খুব মৌলিক কিছু চিন্তা ও কাজ রেখে যান। পরবর্তীতে, যখন দর্শন নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করবো – তখন মোল্লা সাদরার চিন্তা ও দর্শনের ব্যাপারে বিস্তারিত লেখার সুযোগ হবে। ১৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দে, ৬৪ বছর বয়সে মোল্লা সাদরার জীবনাবসান হয়। ইসলামিক দর্শন চিন্তার সমসাময়িক সময়ের প্রধান কসমোপলিটান ফিগার, অ্যামেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সৈয়দ হুসাইন নসরের লেখায় মোল্লা সাদরার কাজ প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
যাই হোক , ইসলামের চিন্তা ও দর্শনের যে বিশাল এবং ডাইভারস একটা জগত অনুন্মচিত অবস্থায় পড়ে আছে বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে, এই চিন্তার জায়গা থেকে এই ব্লগ লিখবার সূচনা। মূলত ইসলামিক দর্শন, ও চিন্তার জগতকেই এক্সপ্লোর করা হবে এই ব্লগে। একই সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বাংলার দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন, এবং পাশ্চাত্য দর্শনের পঠনপাঠন এবং আলোচনাও করা হবে এই ব্লগে।
এতক্ষণ পর্যন্ত সঙ্গে থাকার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ, হে ব্লগ পরিব্রাজক!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২২ দুপুর ১২:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



