somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভ্রমণ-আফগান মাটিতে এক সপ্তাহ-৬

২৮ শে এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কয়েক খন্ড আলো-আঁধারীর দুবাইনামা-২ এর পর থেকে............
...................................................................................................
আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। সূর্যস্নাত দুবাইয়ের আকাশটাকে পেছনে ঠেলে। সাথে মরুশহর দুবাইও। যে উড়োজাহাজের পেটে আমরা দেড়শোর মতো মানুষ আড়াআড়ি-সামনে-পেছনে বসে আছি তাদের মধ্যে অন্তত আমি একজন আছি, যে কিনা এখনও আতংকগ্রস্থ। ভীষণভাবে। গতকাল বিকেলেও যে এয়ারলাইন্স সম্পর্কে একটি তথ্যও পাওয়া যায়নি দুবাইয়ের মতো একটি আধুনিক, জমজমাট বিমান বন্দরে আজ তাদেরই এয়ারলাইন্স এর একটি ছোট্র উড়োজাহাজে আমাদের আকাশ পথ পাড়ি দেয়া। এ যেন যমের কাছে স্বেচ্ছা সমর্পন। তবে বিমানবন্দরে কেউ যেন একজন বলেছিলেন, আফগান পাইলটরা খুব দক্ষ হয়ে থাকেন। মনে মনে শতবার বলি, হাজারবার বলি, তাই যেন হয়। শংকিত মনে শান্তনা খোঁজার হয়তো এটাই আপাতত পথ। একমাত্র পুঁজি।

আমাদের উড়োজাহাজটি দুবাইয়ের বালুকাময় জমিন ছেড়ে মেঘের জগৎটাকে ছুঁইছুঁই করার অনেক আগেই কানে ভেসে আসে নাসিকা সংগীত। ঘুমিয়ে আছেন বস। পরম তৃপ্তিতে। আমারই পাশের সিটে। ঘুমের ঘোরে তার নাকখানি ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে। এমন নির্ভীক-নিশ্চিন্ত প্রশান্তির ঘুমকে হিংসে না করে উপায় নেই। আমার ঠিক পেছনে বসেছেন একজন আফগান ভদ্রলোক। কিছুক্ষণের মধ্যে তার নাকটিও সক্রিয় হয়ে উঠে। এ যেন দুই ভিনদেশির একই ভাষায় কোরাসের আয়োজন। পৃথিবীর স্থানে স্থানে, কালে কালে মানুষের মধ্যে ভিন্নতা ও ব্যবধান তৈরির এতো চেষ্টা, এতো ব্যবস্থা। এতো সীমারেখা, এতো যুদ্ধ। শ্রেণীর প্রশ্নে-বর্ণের প্রশ্নে এতো হানাহানি। ঐতিহাসিকভাবে চলমান এ সামাজিক-রাজনৈতিক নিপীড়নমূলক ব্যবস্থাগুলো যে প্রাকৃতিক মানুষ এর সহজাত মিলগুলোকে, ঐক্যের জায়গাগুলোকে আজও ভাংতে পারেনি, আমার বার বার মনে হতে থাকলো দুই ভিনদেশীর এ নাসিকা সংগীত তারই সত্যতা জানান দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় হলে প্রায় প্রতিটি সিটে মোটামুটি বাধ্যতামূলক দ্বৈতাবাসিক ব্যবস্থায় মাঝে মাঝে এ রকম নাসিকা সন্ত্রাসের শিকার হতে হয়েছে। নিরূপায় হয়ে কত রাত এসএম হলের সবুজ ঘাসে বসে কাটিয়েছি হঠাৎ করে আজ ফেলে আসা সে স্মৃতিগুলোই মনে পড়ছে। অথচ ঠিক এ মুহূর্তে এক সময়ের বিরক্তিকর নাসিকা সংগীতই ভাবনার মালমসলা জোগাচ্ছে। উড়োজাহাজের পেটে আমার ভয়কাতুরে হয়ে বসে থাকা আর বসের নির্ভীক-নিশ্চিন্ত ম্যারাথন ঘুমের একটি সামাজিক ব্যাকরণ-ভাবনাও লম্পঝম্প দিতে শুরু করে। মনের কোণে। এলোমেলো ভাবনায় ডুবতে থাকি। চোখের সামনে একে একে ভেসে ওঠে প্রিয় মুখগুলো। আপনজনরা। একমাত্র কন্যা, জীবনসঙ্গী, মা ইত্যাদি ইত্যাদি। এ বারবার মনে পড়া থেকে একটা অনুসিদ্ধান্তও টানার চেষ্টা করি। আমার মনে হয় প্রতিটি ব্যক্তির দুর্ভাবনা ও ভয়ের একটি নিজস্ব মনোজগত আছে। এ মনোজগত তৈরিতে অন্যান্য উপাদানের সাথে সক্রিয় ভূমিকা রাখে স্ব-স্ব সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান। শ্রেণী এখানে একটি বড় নিয়ামক। আমি নিশ্চিত হই আমার বেঁচে থাকা-না থাকা নিয়ে আমি যতখানি না চিন্তিত তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবিত, যদি সত্যি সত্যি কোন দুর্ঘনটা ঘটে, তার সম্ভাব্য অভিঘাত নিয়ে। নিজের উত্তর প্রজন্মের ওপর। কেবল শিক্ষাসনদের পুঁজি নিয়ে পুঁজির মালিকের কাছে আমরা যারা সেবা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করি, এরকম মধ্যবিত্ত্ব সেবাদাসদের জন্য হয়তো একটি ধনাত্বক শ্রেণী-গতিশীলতার প্রক্রিয়া শুরু হয়। গায়ে-গতরে তথাকথিত আভিজাত্যের ছাপ লাগে। প্রাত্যহিক জীবনমানেও অপেক্ষাকৃত সচ্ছলতার ঢেউ আসে। নিজের শ্রেণীকে ভুলে যাবার কসরতও হয়তো থাকে। কখনও কখনও। অথবা নিয়মিত। কিন্তু শ্রেণী উত্তরণের এ পথটা স্থায়িত্বশীল নয়। টেকসই হয়তো হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে। যদি শর্তগুলো ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক হতে থাকে। অর্জিত সঞ্চয় যখন পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়। আর যদি মাঝপথে শর্তগুলো বিগড়ে যায়, কোন কারণে ভেঙে পড়ে, তবে উত্তরণে ভাটা পড়ে। ফের ঋণাত্বক শ্রেণী গতিশীলতার দিকে ধাবিত হতে হয়। ব্যক্তিকে একা নয়, গোটা পরিবারটিকে। পুঁজির মালিকের ক্ষেত্রে এটি ঘটে না। সাধারণত। ফলে আর যাই হোক, নিজের উত্তর প্রজন্মের ঋণাত্বক শ্রেণী বিচ্যুতির দুর্ভাবনায় পুঁজির মালিককে জড়সড় হতে হয় না। পুঁজি সংকটে না পড়লে তার জন্য নাক ডেকে ঘুমানো অস্বাভাবিক নয়। অতি সাধারণ ঘটনা। এ যেন সুখের অন্য প্রকাশ। ড. ফখরুদ্দীন সরকারের দু’বছর মেয়াদকালে দুদক যখন থেকে থেকে নানা তালিকা প্রকাশ করছিল তখন এ নাকডাকা ঘুমের বস, তার সহযোদ্ধা/প্রতিযোগীদেরই দিন-রাত টেনশনে ঘুম হারাম করে দেয়ার পর্যবেক্ষণটাও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ঝুলিতে যোগ হয়ে আছে।
যত্তসব হাবিজাবি ভাবনা-দুর্ভাবনার মইয়ে উঠা-নামা করতে করতে জানালায় চোখ পড়ে। কখন যে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড়ের দেশে এসে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। বড় বড় পাহাড় চোখের সীমানায় উকিঝুকি মারছে। বিমানের রুটিন মাফিক ঘোষণা শুনে সচকিত হয়ে উঠি। তাকিয়ে দেখি ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে আছে কাবুল নগরী। আফগানিস্তানের রাজধানী। দুবাই থেকে ঠিক কত সময় লেগেছিল আজ আর মনে নেই। সম্ভবত দু আড়াই ঘন্টার যাত্রা শেষে আমাদের নিয়ে উড়োজাহাজটি কাবুলের মাটিতে অবতরণ করে। আমরাও পা রাখি। কাবুলের মাটিতে। সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত চরিত্র আব্দুর রহমানের দেশে। অথবা সাবেক তালেবানী রাজ্যে। যেখানে একদা সমাজতন্ত্রও প্রতিষ্ঠার চেষ্ট চলেছিল। জনগণের ভেতর থেকে নয়। মানে স্বপ্রণোদিত একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করে নয়, ওপর থেকে, আরোপিতভাবে।
চলবে


আগের পর্বের জন্য
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০০৯ বিকাল ৩:১৫
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪১

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।
১. এফডিসিতে মারামারি
২. ঘরোয়া ক্রিকেটে নারী আম্পায়ারের আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক

১. বাংলা সিনেমাকে আমরা সাধারণ দর্শকরা এখন কার্টুনের মতন ট্রিট করি। মাহিয়া মাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন পারাবার: শঠতা ও প্রতারণার উর্বর ভূমি

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪০


অনার্সের শেষ আর মাস্টার্সের শুরু। ভালুকা ডিগ্রি কলেজের উত্তর পার্শ্বে বাচ্চাদের যে স্কুলটা আছে (রোজ বাড কিন্ডারগার্টেন), সেখানে মাত্র যোগদান করেছি। ইংরেজি-ধর্ম ক্লাশ করাই। কয়েকদিনে বেশ পরিচিতি এসে গেল আমার।

স্কুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×