somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বীপ, দূষণ এবং আমরা

১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



২০০৬ সালে প্রেস ক্লাবের সামনে বন্ধুবান্ধব মিলে একটি ছোট্ট মানববন্ধন করেছিলাম। তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছিল যে এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ দেখতে দেখতে উনিশ বছর ছুঁতে চলেছে? সত্যি বলতে, আমরা নিজেরাও ভাবিনি। কিন্তু আজ যখন সমুদ্র ও উপকূল দূষণের মাত্রা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে গেছে, তখন বোঝা যায় সেই ছোট্ট স্ফুলিঙ্গ কতটা প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

আমরা তখন ডাক দিয়েছিলাম সমুদ্র উপকূল পরিচ্ছন্ন রাখার। প্লাস্টিকের ভয়াবহতা আজ বৈশ্বিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রতিটি নদী শেষ পর্যন্ত সাগরে মেশে, আর নদীর দূষণ একদিন না একদিন সাগরের পেছনে ধাওয়া করেই আসে। সাগরে যে আবর্জনা জমছে, তার প্রায় ৮০ শতাংশই আসে স্থলভাগ থেকে। এই তথ্য বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। ফলে কারও ঘাড়ে দোষ চাপানোর সুযোগ নেই, কারণ এই দায় আমাদের সবার।

আইসিসি: বৈশ্বিক উদ্যোগ, স্থানীয় বাস্তবতা

ইন্টারন্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ বা আইসিসি হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দ্য ওশান কনজারভেন্সির একটি উদ্যোগ। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ স্বেচ্ছাসেবী নির্ভর কর্মসূচি। এর উদ্দেশ্য দ্বিমুখী—উপকূল ও সমুদ্র থেকে আবর্জনা অপসারণ এবং সংগৃহীত বর্জ্যের ধরণ ও সংখ্যা নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ। এই বৈজ্ঞানিক তথ্য নীতি নির্ধারণ, গবেষণা, করপোরেট আচরণ পরিবর্তন এবং বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক দূষণ কমানোর পদক্ষেপ নিতে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে ২০০৫ সাল থেকে কেউক্রাডং বাংলাদেশ এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত।

শুরুর গল্পটি এখনো মনে আছে। "ঘুরতেই যখন যাচ্ছি, তবে তার সাথে অন্য কিছু করলে ক্ষতি কী?" এই সরল প্রশ্নই আমাদের যাত্রার উৎসাহ এনে দিয়েছিল। প্রথম বছর মাত্র চারজন ছিলাম। কক্সবাজারে স্কাউটিংয়ের পরিচয়ে অগ্রজ এবং অনুজদের অনুরোধে কয়েকজনকে জড়ো করা গেল। স্থানীয় স্কুলের শিক্ষার্থীরাও যোগ দিল। এভাবেই শুরু। তখন নিত্যউপহার থেকে বাহার রহমান ভাই বিনামূল্যে টি-শার্ট দিয়ে আমাদের পাশে ছিলেন। এই মানবিক অংশগুলো এখনো অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছে।

এরপর বুঝলাম কক্সবাজারের পরে আমাদের যেতে হবে সেন্ট মার্টিনে।

সেন্ট মার্টিন: বাংলাদেশের একটি পরীক্ষাগার

২০১০ সালে আমরা প্রথম সেন্ট মার্টিনে পরিচ্ছন্নতা অভিযান করি। তখন সেখানে সংগঠিতভাবে আবর্জনা সংগ্রহের কোনো উদাহরণ ছিল না। দ্বীপটি আমাদের কাছে যেন একটি স্বতন্ত্র দেশ। মানুষে গমগম করছে, অথচ সমানতালে বাড়ছে অগণিত আবর্জনা। কারও খেয়াল নেই পর্যটকরা কী ফেলে রেখে যাচ্ছে।

সেন্ট মার্টিন আমাদের জন্য পরীক্ষাগার। কারণ এখানে জনসংখ্যা সীমিত, কিন্তু পর্যটকের চাপ অসীম। একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ কীভাবে বর্জ্যের চাপে ভেঙে পড়ে, তা বাংলাদেশের বৃহৎ উপকূল অঞ্চলের ভবিষ্যৎ চিত্রও তুলে ধরে। আমরা তাই এটিকে বাংলাদেশের ছোট সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করি এবং নীতি ভাবনার অনুকরণীয় উদাহরণ তৈরি করতে চাইছি।

পরিচ্ছন্নতার সবচেয়ে কঠিন শর্ত

দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বলতে শেখায় যে আবর্জনা সংগ্রহ করাই পরিচ্ছন্নতার প্রথম এবং সবচেয়ে কঠিন শর্ত। এবং এটি ব্যয়সাপেক্ষ। গত দুই বছর ধরে এই কাজে ইউনিলিভার বাংলাদেশ যে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতা করছে তা শুধু অর্থনৈতিক নয়, মনস্তাত্ত্বিকও। কোনো বড় কোম্পানি যখন ভিত্তিস্তরের উদ্যোগের পাশে দাঁড়ায় তখন মানুষ গুরুত্ব দেয় এবং মনোভাব বদলায়।

আমাদের দেশের বাস্তবতা হলো আমরা জানি কাজটি আমাদের কিন্তু করি না। "পাছে লোকে কিছু বলে" এই মানসিকতা আমাদের আটকে রাখে। আমরা সেই বাধা অতিক্রম করতে চাই।

আমরা স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের যুক্ত করি। পর্যটকদেরও আমন্ত্রণ জানাই। প্রথমে মানুষ গুরুত্ব দেয়নি। এখন দেয়। অনেকেই এসে কিছুক্ষণ কাজ করে, চা খাওয়ায়। উপহাস থেকে মৃদু বাহবা—এই রূপান্তরটুকুই আমাদের প্রাপ্তি।

আমাদের অর্জন

বিগত বছরগুলোতে শুধুমাত্র সেন্ট মার্টিন থেকে আমরা প্রায় ২৫,০০০ কেজি সামুদ্রিক আবর্জনা সংগ্রহ করে নৌকায় করে টেকনাফে এনেছি। একটি কেজি ভেজা প্লাস্টিক বা জাল হাতে তোলার কষ্ট যারা জানেন, তারা বুঝবেন এই সংখ্যা শুধুই পরিসংখ্যান নয়। এটি একেকটি শ্রম, একেকটি গল্প, একেকটি সংগ্রাম। এ বছর আমরা ৫৩০ জন মিলে মাত্র একদিনে প্রায় ১৮৫০ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি। এ কাজে যদি সবাই এগিয়ে আসে তবে পরিবর্তন অবধারিত।

সংগ্রহের পরে আমরা শ্রেণিবিন্যাস করি। কোন বর্জ্য কতটা, কোথা থেকে, কীভাবে আসছে। নিজেদের মজা করে বলি ডাটা ডিটেকটিভ। আমাদের সংগৃহীত তথ্য দ্য ওশান কনজারভেন্সির বার্ষিক প্রতিবেদনে ব্যবহৃত হয়। এটি আমাদের জন্য গভীর সম্মানের বিষয়।

সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু

সেন্ট মার্টিনে ১২,০০০ মানুষ থাকে। কিন্তু প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক সেই সংখ্যাকে অতিক্রম করে। এত মানুষের বর্জনা কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে সামাল দেওয়া অসম্ভব। সমাধান একটাই—সচেতনতা, দায়িত্ববোধ এবং নিজেদের আচরণে ছোট ছোট পরিবর্তন।

উপকূল আমাদের বিনোদনের স্থান, কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদও। আবর্জনা ফেলে রেখে গেলে সাগর তা ফিরিয়ে দেয়। কখনো মাছের পেটে, কখনো ক্ষতবিক্ষত প্রবালপ্রাচীরে, কখনো শিশু কচ্ছপের মৃত্যুর মাধ্যমে।

শেষ কথা

আমাদের কাজ জটিল নয়। বরং সহজ। শুধু দরকার ইচ্ছাশক্তি। যদি আমরা প্রত্যেকে নিজের বর্জ্যের দায় নিই তবে সেন্ট মার্টিনই নয়, পুরো বাংলাদেশের উপকূল বদলে যেতে পারে। যেহেতু দূষণের বেশিরভাগই স্থল থেকে আসে, তাই সমাধানের সূচনা আমাদের থেকেই হওয়া উচিত।

দ্বীপ, দূষণ এবং আমরা—এই সম্পর্ক যতদিন থাকবে ততদিন আমাদের দায়িত্বও টিকে থাকবে।

প্রকাশিত : বাংলাদেশ প্রতিদিন view this link

সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:০১
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৌলবাদ: ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যর্থ প্রযুক্তি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫১




মজার বিষয়—

আজকের মৌলবাদীরা রোকেয়া বেগমকে মুরতাদ ঘোষণা করে বুক ফুলিয়ে হাঁটে, অথচ নিজেদের অস্তিত্ব টিকেই আছে যাদের ঘৃণা করে— সেই “কাফেরদের” বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিতে। ইতিহাস পড়লে এদের বুকফুলা হাওয়া বের... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতী এখন পুরোপুরিভাবে নেতৃত্বহীন ও বিশৃংখল।

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩



শেরে বাংলার নিজস্ব দল ছিলো, কৃষক প্রজা পার্টি; তিনি সেই দলের নেতা ছিলেন। একই সময়ে, তিনি পুরো বাংগালী জাতির নেতা ছিলেন, সব দলের মানুষ উনাকে সন্মান করতেন। মওলানাও জাতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট

লিখেছেন আরোগ্য, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১৬



ওসমান হাদী অন্যতম জুলাই যোদ্ধা, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র, স্পষ্টবাদী কণ্ঠ, প্রতিবাদী চেতনা লালনকারী, ঢাকা ৮ নং আসনের নির্বাচন প্রার্থী আজ জুমুআর নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর গুলিবিদ্ধ হয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×