somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গাজার ট্র্যাজেডি ও মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা: আবেগ নয়, প্রয়োজন আত্মসমালোচনা, জ্ঞানচর্চা ও কৌশলগত পরিকল্পনা

১৯ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৯:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গাজায় ইজরায়েলের সাম্প্রতিক বর্বরোচিত হামলায় একদিনে ৪০০-এরও বেশি নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ—কেউই রক্ষা পাচ্ছে না। বিশ্ববাসী শোক প্রকাশ করছে, মুসলিম বিশ্ব ক্ষোভে ফেটে পড়ছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় উঠছে, দোয়া করা হচ্ছে, বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে—কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইজরায়েল তাদের আগ্রাসন থামাচ্ছে না, বরং আরও নিষ্ঠুরভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, কেন বারবার মুসলিম বিশ্ব নির্যাতিত হচ্ছে? কেন তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারছে না? শুধুমাত্র পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করলে কি আসল কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে? নাকি নিজেদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও এর জন্য সমানভাবে দায়ী?
এই লেখায় আমরা দেখব, কীভাবে মুসলিম বিশ্বের আত্মসমালোচনা, জ্ঞানচর্চা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা, রাজনৈতিক দুর্বলতা ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা তাদের বারবার পরাজিত করছে।

১. আবেগের রাজনীতি বনাম কৌশলগত বাস্তবতা
প্রতিবার ফিলিস্তিনে গণহত্যা হলে মুসলিম বিশ্বে আবেগের স্রোত বয়ে যায়। মানুষ বিক্ষোভ করে, স্লোগান দেয়, ফেসবুক-টুইটারে প্রতিবাদ জানায়, অর্থ সাহায্য পাঠায়, দোয়া করে—কিন্তু কয়েকদিন পরই সেই উন্মাদনা হারিয়ে যায়। অন্যদিকে ইজ*রায়েল দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা করে তাদের সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে।
(ক) আবেগ কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না
একটি জাতি কেবলমাত্র আবেগ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারে না। প্রয়োজন বাস্তব কৌশল ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। মুসলিমরা ফিলিস্তিনের জন্য কাঁদছে, কিন্তু তাদের চোখে দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের অভাব রয়েছে। ইজ*রায়েল একদিনে এত শক্তিশালী হয়নি, তারা বছরের পর বছর ধরে সামরিক প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও কূটনীতি শক্তিশালী করেছে। মুসলিম বিশ্ব কী করেছে? শুধু প্রতিবাদ আর দোয়া!
(খ) পশ্চিমা বিশ্বের কৌশলগত আধিপত্য
পশ্চিমা বিশ্ব জানে যে মুসলিম দেশগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংকটে জর্জরিত। তাদের ঐক্য নেই, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ নেই, সামরিক শক্তির ঘাটতি রয়েছে। ফলে তারা অনায়াসে মুসলিমদের শোষণ করে যাচ্ছে।
(গ) মুসলিম দেশগুলোর নতজানু পররাষ্ট্রনীতি
অনেক মুসলিম দেশের সরকার পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবাধীন, ফলে তারা কার্যকরভাবে ফিলিস্তিনের জন্য কিছু করতে পারছে না। তারা নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত।
২. জ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের ব্যর্থতা
একটি জাতির শক্তি নির্ভর করে তার জ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নতির উপর। ইতিহাস সাক্ষী, যখনই কোনো জাতি জ্ঞানে অগ্রসর হয়েছে, তখনই তারা বিশ্বনেতৃত্ব পেয়েছে। অথচ মুসলিম বিশ্ব এই ক্ষেত্রগুলোতে ভয়াবহভাবে পিছিয়ে পড়েছে।
(ক) মুসলিমদের সোনালি অতীত ও বর্তমান বিপরীতমুখী
এক সময় মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শীর্ষে ছিল। ইবনে সিনা, আল-খোয়ারিজমি, ইবনে রুশদ, আল-ফারাবির মতো বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা বিশ্ব সভ্যতায় বিপ্লব এনেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব এই ক্ষেত্রে ভয়াবহভাবে পিছিয়ে গেছে।
(খ) আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে সামরিক দুর্বলতা
ইজ*রায়েলের মতো একটি ছোট্ট দেশ কীভাবে এত বড় মুসলিম বিশ্বের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে? কারণ তারা আধুনিক সামরিক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেছে। তারা নিজেদের অস্ত্র তৈরি করতে পারে, অথচ মুসলিম দেশগুলো অস্ত্রের জন্য পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল।
(গ) শিক্ষা ও গবেষণায় পিছিয়ে থাকা
বিশ্বে শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মুসলিম দেশগুলোর নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন।
গবেষণা ও উদ্ভাবনে মুসলিম দেশগুলো একেবারেই পিছিয়ে।
পশ্চিমারা যেখানে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করছে, মুসলিমরা সেখানে পুরনো বই মুখস্ত করাতেই ব্যস্ত।
৩. ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও বাস্তবতার সাথে ইসলামের সংযোগহীনতা
ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। কিন্তু বর্তমান মুসলিম সমাজে ধর্মকে সংকীর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
(ক) বিজ্ঞান ও চিন্তার স্বাধীনতার অবমূল্যায়ন
ইসলামের ইতিহাসে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করা হয়, এবং যুক্তিবাদী চিন্তাকে দমন করা হয়।
(খ) অন্ধবিশ্বাস ও যুক্তিহীন ব্যাখ্যা
মুসলিম সমাজে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
বাস্তবসম্মত চিন্তাভাবনার পরিবর্তে অযৌক্তিক বিশ্বাসকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
৪. অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা
মুসলিম বিশ্ব একদিকে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত, অন্যদিকে পশ্চিমারা তাদের বিভক্ত করে শাসন করছে।
(ক) মুসলিম দেশগুলোর পারস্পরিক শত্রুতা
মুসলিম দেশগুলো নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছে, অথচ ইজ*রায়েল ও পশ্চিমারা একত্রিত হয়ে মুসলিম বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
মুসলিমদের মধ্যে যদি ঐক্য থাকত, তাহলে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারত।
(খ) গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাব
মুসলিম বিশ্বে অধিকাংশ দেশেই সুশাসনের অভাব রয়েছে।
জনগণের মতামত দমিয়ে রাখা হয়, ফলে সমাজের উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
৫. সমাধানের পথ: কী করা উচিত?
(ক) শিক্ষার বিপ্লব ঘটানো
আধুনিক বিজ্ঞান ও গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে।
যুক্তিবাদী ও বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করতে হবে।
(খ) অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বনির্ভরতা অর্জন
অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তিতে মুসলিম দেশগুলোকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে।
অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে হলে উৎপাদন খাতকে শক্তিশালী করতে হবে।
(গ) কূটনৈতিক কৌশলগত পরিকল্পনা
মুসলিম দেশগুলোকে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে।
পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্য মোকাবিলায় তাদের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে।

ফিলিস্তিনের জন্য কাঁদা ও দোয়া করা অবশ্যই প্রয়োজন, তবে সেটাই শেষ সমাধান নয়। সমাধান হলো—জ্ঞান, শিক্ষা, গবেষণা, কূটনীতি, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি।
মুসলিমরা যদি নিজেদের শাসন, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী করে, তাহলেই তারা ইজ*রায়েলের দখলদারিত্ব ও পশ্চিমা বিশ্বের আধিপত্য মোকাবিলা করতে পারবে। আবেগ নয়, প্রয়োজন সুপরিকল্পিত ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। এই সত্য উপলব্ধি করলেই মুসলিমরা তাদের হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারবে।

সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৯:৩৯
৭টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির হত্যাকান্ড ও সরকারের পরবর্তি করণীয়!

লিখেছেন আহলান, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৫১

হাদির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সে দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষকে ইনসাফের জীবন এনে দিতে সংগ্রাম করেছে। তাকে বাঁচতে দিলো না খুনিরা। অনেক দিন ধরেই তাকে ফোনে জীবন নাশের হুমকি দিয়ে এসেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব রাজ্যে উত্তেজনা: হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৪২

রোম যখন পুড়ছিল নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল; গতরাতের ঘটনায় ইউনুস কে কি বাংলার নিরো বলা যায়?



বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদটি সবসময় ছিল চ্যালেঞ্জিং।‌ "আল্লাহর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্টেরিম সরকারের শেষদিন : গঠিত হতে যাচ্ছে বিপ্লবী সরকার ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২২


ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্তঃদেশীয় প্রকল্পটা সফল হতে অনেক দিন লেগে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সে তুলনায় সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের সফলতা স্বল্প সময়ে অনেক ভালো। এটা বিস্ময়কর ব্যাপার, ‘রাষ্ট্র’... ...বাকিটুকু পড়ুন

মব সন্ত্রাস, আগুন ও ব্লাসফেমি: হেরে যাচ্ছে বাংলাদেশ?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৩:৫২


ময়মনসিংহে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মানুষকে ধর্মীয় কটূক্তির অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। মধ্যযুগীয় এই ঘটনা এই বার্তা দেয় যে, জঙ্গিরা মবতন্ত্রের মাধ্যমে ব্লাসফেমি ও শরিয়া কার্যকর করে ফেলেছে। এখন তারই... ...বাকিটুকু পড়ুন

তৌহিদি জনতার নামে মব সন্ত্রাস

লিখেছেন কিরকুট, ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৪




ছবিঃ অনলাইন থেকে সংগৃহীত।


দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নাম ব্যবহার করে সংঘটিত দলবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তৌহিদি জনতা পরিচয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×