somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এভারেস্ট জয়ের চ্যালেঞ্জ, নাকি করপোরেট সংস্কৃতি?

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১০:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রক্তে এখনো আগুন ঝরে, যখন শুনি পর্বত ডাকে। আর যখন সামনে পড়ে _ রুক্ষ, এবড়ো-খেবড়ো, পাথুরে বা কিম্ভুতদর্শন পর্বত _ হাত-পা নিশপিশ করে কখন একে ডিঙাব বা কোন পথ ধরে এর চূড়ায় পেঁৗছানো যাবে, তা ভাবতে ভাবতে।
একে আমরা আদর করে পাহাড় বলি। এই পাহাড় চ্যালেঞ্জ জানায়। তাকে আবক্ষ গ্রহণ করি।
এখন এভারেস্ট আমাদের ডাকে। শয়নে, স্বপনে _ প্রতিটি মুহূর্তে কাজের ফাঁকে ভাবনায় উদয় হয় এভারেস্ট। মনকে সাহস যোগাতে থাকি, শরীরকে প্রস্তুত হতে বলি এভারেস্ট অভিযানে শামিল হওয়ার জন্য, চূড়ান্ত পর্যায়ে সর্বময় সফল হওয়ার জন্য। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাতে থাকি এই চ্যালেঞ্জে আরও অনেককে সহযাত্রী, বন্ধু হিসাবে পাওয়ার জন্য।
তবে প্রতিকূলতা যে পার হতে হয় নি, তা নয়। শুরুতেই পার হতে হয়েছে নিজের মনের প্রতিকূলতা। ছিল 'হাইটফোবিয়া'। ছোটবেলায় তিন তলা সমান উঁচু আম বা কাঁঠাল গাছে যে ছেলেটি তরতর করে উঠে পড়তাম গাছ থেকে আম-কাঁঠাল পেড়ে খেতে, সেই ছেলে বড় হয়ে উচ্চতাজনিত ভীতিতে ভুগব _ এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে! তাই মনে জিদ চেপে গেল_ একে জয় করতেই হবে। নেপালে ২০০২ সালে অন্নপূর্ণা ট্রেইলে ট্রেকিং বা ২০০৪ সালে ভারতের দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ আর একই বছরে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ট্রেকিং করার সময় লক্ষ্য করলাম_ উচ্চতাজনিত ভীতির সমস্যাটা আসলে মনের। পর্বতারোহণে যেহেতু সর্বোচ্চ মাত্রার ঝুঁকি থাকে, নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে সেই ঝুঁকি দূর করার জন্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হয় সর্বোচ্চ মাত্রায়। 'সেফটি ফার্স্ট' নীতি মানা হয় অনুপুঙ্ক্ষ। কাজেই মনের সমস্যা ঝটতি বিদায় হয়ে তা রূপান্তরিত হল আত্মবিশ্বাসে।
সেই আত্মবিশ্বাসে ভর করে ভারতের সিকিম হিমালয়ের ফ্রে পর্বত (১৯,১২৫ ফুট, ২০০৬) জয় করেছি ভারতের একটি কমান্ডো দলের সঙ্গে এবং নেপালের মেরা পর্বত (২১,৮২৫ ফুট, ২০০৫) ও চুলু ওয়েস্ট পর্বত (২১,০৫৪ ফুট, ২০০৭)-এর অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্প পর্যন্ত আরোহণ করেছি।
এবার লক্ষ্য নির্ধারণ করলাম ২০১০ সালে এভারেস্ট অভিযানের। সমমনা পর্বতারোহী বন্ধুরা মিলে গড়ে তোলা হল নর্থ আলপাইন কাব বাংলাদেশ। এর নামকরণ নিয়ে একটু বলে রাখা ভালো। পরিকল্পনা ছিল তিব্বতের বিখ্যাত নর্থ ফেস দিয়ে এভারেস্ট অভিযান পরিচালনা করার উদ্যোগ নেয়া হবে। এখান থেকে নেয়া হল 'নর্থ'। আর ইউরোপের আল্পস পর্বতমালায় একাকী পর্বতারোহণের বহু বছর পুরনো একটা প্রথা পর্বতারোহীদের মধ্যে 'অ্যালপাইনিজম' হিসাবে বেশ চলমান। সেখান থেকে এল আলপাইন। এভাবেই নামকরণ করা হল নর্থ আলপাইন কাব বাংলাদেশ _ এনএসিবি। ২০০৭ সালের ২৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে এভারেস্ট অভিযান পরিচালনা করার যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সেই কুঁড়ি এখন একটু একটু করে ফুলে পরিণত হতে শুরু করেছে।
তখন থেকেই অভিজ্ঞতা অর্জনের পাল্লা প্রয়োজনীয় মাত্রায় উন্নীত করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। ভিন কাবের সদস্যদের চ্যালেঞ্জ _ এটা তো একটা ক্লাব ছাড়া আর কিছু তো নয়। যাক না এভারেস্ট, দেখা যাবে _ ইত্যাদি ইত্যাদি চোখ রাঙানি সইতে হয়েছে বিস্তর। তারপরও বন্ধুদের উৎসাহে 'মচকাবো, তবু ভাঙবো না' _ এই নীতিতে এগিয়ে গিয়ে ২০০৮ সালের পহেলা ডিসেম্বর নেপালের এভারেস্ট হিমালয়ের লাংসিসা রি পর্বত (২০,৭০০ ফুট) এবং ২০০৯ সালের ১৪ জুন অন্নপূর্ণা ফোর পর্বত (২৪,৬৯০ ফুট) জয় করে এসেছি।
এই ১৪ জুন ছিল বাংলাদেশের পর্বতারোহীদের জন্য একটা মাইলফলক। কারণ এদেশের কোন এক ভেতো বাঙালি _ পর্বতারোহণের সামান্য অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে এই দিন নেপালের টেকনিক্যাল কাইম্বিং ঘরানার 'এ' গ্রেডভুক্ত একটা পর্বতচূড়া জয় করে এসেছে। পর্বতারোহণের সব ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করে _ তবে অক্সিজেন না নিয়ে _ এই পর্বতারোহণ ছিল একটা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। কেননা, কোনোদিনও এই উচ্চতায় কোনো বাংলাদেশী পর্বতারোহী পেঁৗছেনি। তাই বুকটা দুরু দুরু করছিল যে, পারবো তো? যাই হোক, সেই চ্যালেঞ্জ যখন উতরে গেলাম, সবার পরামর্শে এভারেস্ট অভিযানকেই পরবর্তী লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করে নিলাম।
অনেকের মতে, বাংলাদেশে বসে এভারেস্ট আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও রসদ সংগ্রহই একটা এভারেস্ট জয়ের সমান। কারণ, এদেশের করপোরেট সমাজ এখনো এ ব্যাপারে ততোধিক সংকীর্ণ, যতোখানি সম্মান ও মর্যাদা একেকটা পর্বত জয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। করপোরেট সংস্কৃতিতে মজার মজার বাগাড়ম্বর থাকলেও দিন শেষে সবাই নিজের ভাগের লাভটুকু দেখতে চায় এই বলে যে _ এখানে বিনিয়োগে তাদের লাভ কতো? লোকসান হবে না তো? যেহেতু পর্বতারোহণের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক এবং বাস্তব-বাজার মুনাফা দেখানো অনেকটাই কঠিন, সুতরাং করপোরেট সংস্কৃতিতে পর্বতারোহণকে পৃষ্ঠপোষকতা করার আহ্বান জানানোটাও কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙানোর মতো কাজ। দেশের সম্মানের ব্যাপারটা তাদের কাছে পরাজাগতিক কোনো বিষয়, পাবলিকের পকেট ভেঙে নগদ নারায়ণ অর্জনটাই যেন মুখ্য।
তারপরও বন্ধু ও বড়দের সহযোগিতায় 'পুশ সেল'-এর মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে রাজি করিয়ে যেমন এর আগের পর্বতারোহণ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল, এবারও হয়তো সেরকম একটা ব্যাপারই ঘটবে। তবে দেশের এই এভারেস্ট জয়ের ক্ষেত্রে যাই ঘটুক না কেন, ২০১০ সালের মার্চ মাসের মধ্যে যে আমরা এভারেস্টে অভিযান পরিচালনা করার জন্য নেমে পড়ছি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। থাকুক না করপোরেট সমাজ মুখ ফিরিয়ে।
এদেশের তরুণ, তরুণী, যুবা _ সবাই সেই দিনের অপেক্ষায়। যেদিন বাংলাদেশের পতাকা এভারেস্টের চূড়ায় উড়বে। আমরা স্বপ্ন দেখছি, চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি সামনের দিকে। এভারেস্ট জয়ের লক্ষে।
চ্যালেঞ্জ না থাকলে জীবনটা কেমন হতো?

মুসা ইব্রাহীম
পর্বতারোহী ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী
[email protected]
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×