এখানে অনেক আলো পাবি
আমার অনেক বিস্ময় আছে জলের ভেতরে। ছোট বেলায় পুকুরে সাঁতার শিখতে গেলে বাবা বলতেন দেখ জলের ভেতরে আরো একটা পৃথিবী আছে। বিস্ময়টা সেখান হতে শুরু। দেখতাম স্বপ্নের শহর, ওটি- আনন্দের পাড়া। মাঝে মাঝে মাছেরা বুদবুদ দিয়ে যেত, অবিকল সত্য জোছনার মতন। যেন জোছনা গোলক কৌটা ভরে বিস্ময় নিয়ে আসে। এই সত্য ফাহমিদা বিশ্বাস করতে চাইতোনা। বলতো জলের ভেতরে কি দেখিস এমন করে, বিজ্ঞানী হবি নাকি? তুই না পড়তে পছন্দ করিস না? বরং এই দিকে চোখ রাখ এইখানে, বলতো তাকিয়ে দেখতে ওর জাম চোখের দিকে। এখানে অনেক আলো পাবি। জ্ঞানের চেয়ে এমন আলো অনেক ভাল রে পাগল। ওখানে অনেক গভীরতায় আমার ঠাঁয় তৈরী হয়নি। আমি কেবল বিস্ময়ে নির্লিপ্ত হয়ে যাই।
সবসময় ডাকতে গিয়ে ওর ফাহমিদা নামটা ছোট্ট হয়ে মিদা হয়ে গিয়েছিল। পরে ওটিই নানান নন্দনে- মৃধা। বলতো, এমন হিন্দু নামে আমাকে ডাকিস কেন রে? কেমন পুরুষ পুরুষ নাম ওটা? আমি জানতাম একটা পুরুষ লুকিয়ে থাকতো ওর ভেতরে। ভালবাসার বিষয় গুলোকে নিজের করে নেবার মতন একটা শক্তি। বলতাম, তোর ঐ পুরুষটাই আমার বেশ ভাল লাগে। ওটাকে আদর দিয়ে রাখিস। মৃধা বিষ্ময়ে আকাশ হয়ে যেত। ছোট বেলায় সেই সুযোগটাই আমি নিয়েছি সবসময়। ওড়ার মতন ঐ একটি বিহ্বল আকাশই আমার ছিল।
অদ্রিদের ঘাটলাটা অনেকটাই তুলসী মঞ্চ'র মতন। উঁচূ করে চোখ তুলে রাখার মতন পাড়ার প্রতিটি গন্তব্য নজরে আসে। অদ্রি পৃথিবীর অনেক সম্ভাবনা এখানে বসেই দেখেছে। ঘাসের ভেলায় পিপিলীকার সমুদ্র যাত্রা থেকে শুরু করে গাছেদের ধ্যানমগ্নতা। একবার অসত্থটির সাথে নানান কথা হয়ে গিয়েছিল তার। পুরোটা এখন আর একসাথে মনে আসছে না। সে ভেবে পায়না গাছেরা কি করে জানে মৃধার কথা। এমন সব যা কিনা মেয়েটিই কখনো বলেনি তাকে। গাছেরা ধ্যান করে মানুষের, মৃধার চলন বুঝে নিতে গাছেদের যত আধ্যাত্মিতকা।
গাছেরা ধ্যান করে মানুষের
অদ্রি ঘাটলায় বসে ঠিক দূপুরের পর। এসময়, মানে দুপুর থাকতেই অনেকে আসে এখানে। সকলের পরিচয় এখন ঠিক এই মূহুর্তে বিশদ হবেনা। অদ্রি ভাবে তাদের সকলের মধ্যকার সম্পর্কের কোন সূত্র নেই। তাই বলে অপরিচিতও কোনটি নয়। এখানে অভেদ নেই। অদ্রির ভেদবুদ্ধি পাখীর মতন দীপ্ত। গাছেদের পাড়াতে সে নিজেকে প্রকৃত চেনে, মাছেদের বুদবুদ রেখে এবার সে অন্য স্বপ্ন বুনে।
একটি মাছের ডুব দেয়া দেখে বুঝে নেয় মৃধা এসে পেছনে দাঁড়াল।
আজ নয়, আজ স্বপ্ন গল্প হয়ে যাবে
একটি মাছের ডুব দেয়া দেখে বুঝে নেয় মৃধা এসে পেছনে দাঁড়াল। অদ্রি জলমগ্ন হয়ে পড়ে। মৃধাদের বাড়ীতে যায়নি অনেক দিন। ওকে কিছু স্বপ্নের কথা বলে, পরে আর যায়নি অনেকদিন। ওদের বাড়িতে স্বপ্ন কেবলই গল্প হয়ে পড়ছিল। আজ কিছু প্রিয় স্বপ্ন বানাবে অদ্রি। স্বপ্নে থিম গুলো আগে থেকেই রাখা আছে বৃক্ষদের কাছে। কয়েকটা পাখীরা চেয়ে নিয়েছে। ওরা বলেছে, পাখীরা কোন স্বপ্ন দেখতে শেখেনি। গাছেরা, শিকড়ে মাছেদের খুনসুটি স্বপ্ন কিনা জিজ্ঞেস করেছে। অদ্রি জানেনা। জানে যে সে তাদের ভালবাসে, তবে সে অলাদা, অন্যরকম। এমন কি সে মৃধার মতন পিপীলিকার জন্য কাঁদেনি। অদ্রির কান্না পায়না। সে কাঁদেনি কোনদিন। নানু ভাই যেদিন ইন্তেকাল করে সেদিন শুধু কান্না করেছিল। তাও দুষ্টমী করে, সকলে যাতে মনে করে অদ্রির মায়া আছে।
অদ্রির আসলেই এখন মায়া হয়। অদ্রির মায়া গুলো মৃধার জন্য। ও এখনো পাখীদের মত। স্বপ্ন শেখেনি। ও এখনো কুয়াশা বুঝেনা। অথচ এই শব্দটির জন্য অদ্রির কান্না পায়। একসময় অনেক কুয়াশা হত অদ্রির। কান্না নয়, কুয়াশায় ভিজে যেত অদ্রি। কুয়াশা না বুঝলে স্বপ্ন শেখা যায়না। স্বপ্নের সত্য আছে, স্বরূপ নেই। মৃধা একে ঘুমের কন্যা বানিয়ে ফেলে, আদর করতে বসে। মৃধা কুয়াশাকে শুধু খেলাপাতি করে রেখেছে।
মৃধা পাশে বসলে পরে পাখীরা এক-একটি থিম দিয়ে যায়। অদ্রি ফিরিয়ে দিয়ে রাখে সেটি। আজ নয়, আজ স্বপ্ন গল্প হয়ে যাবে।
ওকে আজ স্বপ্ন শেখাবো
অনেক আলোর ঘর। সর্পসারি আলোর গ্রাম আমাদের। আলোর কুপি আর গাছেদের কালো ঘন ছায়ায় আমাদের গ্রাম সম্ব্রান্ত। সন্ধ্যায় মাগরিবের মসজিদ আজান বাজিয়ে গেল। সূর্য ডুবেছে, আকাশ এখনো নেভেনি কালো হয়ে। দিগন্তে গাছেদের আলপনা চোখে আসে। অনেক প্রণয় জাগলে যেমন হয়, আকাশের গালে এখন সিঁদুর রাঙা স্নিগ্ধ আভা। যেখানে সূর্য ডুবেছে অল্প আগে।
মৃধাকে জানিয়েছিলাম, মৃধা এখন খুব জানে- স্বপ্ন অনেক ভাল ব্যপার গল্পের চেয়ে। গল্পে কল্পনা দারুণ মরে যায়। গল্পে কল্পনা বস্তুতঃ হয়ে যায়। মৃধা জানে স্বপ্নে কল্পনা বাঁচে। মৃধাদের ঘরে স্বপ্নের জন্ম নেই। ওখানে স্বপ্ন গল্প হয়ে যায়। তাই ঘাটলায় বসে স্বপ্ন বুনি আমরা। পাখী আর বৃক্ষ স্বপ্নের রঙ দিয়ে যায় আমাদের।
মৃধা স্বপ্নছবি বুনতে শেখেনি। পাখীদের মতন। পাখীরা শুধু রঙ করতে জানে। নানান স্বপ্নীল রঙ। মৃধা স্বপ্ন শেখেনি। নিজেকে অক্রিয় রেখে স্বপ্ন দেখা যায়না মৃধা। স্বপ্নকে বুনতে হয়। মৃধা একে ঘুমের কন্যা বানিয়ে ফেলে। ওকে আজ স্বপ্ন শেখাবো।
আজ পাতাঝরা জোছনা হবে। মৃধাকে পরাবো জোছনার অঙ্গুরীয়। কালো ঘন চুলে পরবে কুয়াশা। আমরা ভোর হতে ঘাটলাতে অপেক্ষায়। জোছনা বা স্বপ্নে অপেক্ষা। মৃধা একবার স্বপ্ন স্নান শেষ করবে। এটি একটি ব্রত্ জাগবে ভেদবুদ্ধি। ভেদবুদ্ধি না হলে নিজেকে চেনা যায়না।
বৃক্ষরা কেবল রঙ দেবে। মৃধা পরবে কুয়াশা আর অঙ্গুরীয়। ওকে আজ স্বপ্ন শেখাবো।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




