অসংগতির সমাজ পাল্টাতে হবে
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে তার বাস। যে সমাজে সে বসবাস করে, তার থাকে কতগুলো বৈশিষ্ট্য। সেই মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে অবয়ব পায় বিদ্যমান সমাজের চেহারা ও চরিত্র।
সমাজ বাস্তবতায় পরিপূর্ণ সংশ্লেষিত হয়ে বসবাস করা সত্ত্বেও সব মানুষ তার সমাজের চেহারা-চরিত্রের অনেক কিছুই পূর্ণভাবে উপলব্ধি ও অনুধাবন করে উঠতে পারে না। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বর্তমানে যে পুঁজিবাদী সমাজ বিদ্যমান, সেই সমাজে বিরাজ করে এমন অযৌক্তিক অমানবিক কুিসত সব বৈপরীত্য ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উপাদান, যা সমাজ বাস্তবতার অবিচ্ছেদ্য ও অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য হওয়া সত্ত্বেও তা মানুষের উপলব্ধি ও অনুধাবনকে এড়িয়ে যায়। অরণ্যের মাঝে যার পরিপূর্ণ বসত তার যেমন অরণ্যের স্বরূপ সম্পর্কে পূর্ণ অনুধাবন-অক্ষমতা স্বাভাবিক, অনেকটা তেমনি, চারপাশের অস্তিত্বমান বৈপরীত্যের মাঝে বসবাস করে সেই বৈপরীত্য ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সার্বিক উপলব্ধি মানুষের বোধে আসতে পারাটাও কিছুটা কষ্টকর। তবে বাস্তবের অভিঘাত এতোই অমোচনীয় যে, চোখে আঙ্গুল দিয়ে একটু সজাগ করে দিলেই তা অতি সহজেই উপলব্ধির মর্মে এসে স্থান করে নেয়। ক্ষুব্ধ চমকে তখন জেগে ওঠে উপলব্ধির আলো! সমস্ত অন্তরাত্মা চিত্কার করে বলে ওঠে, সত্যিই তো, এমনইতো সমাজের আসল চেহারা!
অনেকেই ছোট-ছোট বাণী, উপমা, দৃশ্যবর্ণনার সাহায্যে সমাজের সেসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলো ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন। যেমন, কবিতার চয়নে লেখা হয়েছে, আমরা এমন এক সমাজ বাস্তবতায় বসবাস করি যেখানে—
‘ডাক্তার মরে রোগীর অভাবে, আর রোগী মরে ডাক্তারের অভাবে।’
মনে মনে অবস্থাটি ভাবুন! পাস করা ‘দামি’ ডাক্তার সাহেব সদর রাস্তায় স্থাপিত তার চেম্বারের বাইরে ‘কনসালটেশন ফি: ২০০ টাকা’ লেখা-সহ সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে ভেতরে টেবিল-চেয়ার পেতে রোগীর অপেক্ষায় বসে আছেন। বাইরে হাজার হাজার দরিদ্র-রুগ্ন রোগীর দল। সকলেরই প্রয়োজন ডাক্তারের কাছে যেয়ে কনসালটেশন করার। কিন্তু ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ নিরন্ন দরিদ্র এ মানুষগুলো কোথায় পাবে কনসালটেশন ফি-র টাকা। ডাক্তারখানার দরজা থেকে তাদেরকে চিকিত্সক পরামর্শ ও ওষুধপত্র ছাড়াই অব্যাহত রুগ্ন জীবন কিম্বা বিনা চিকিত্সায় মৃত্যুকে মেনে নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়। এভাবে তাই ‘রোগী মরে ডাক্তারের অভাবে’! এদিকে ফি-র টাকা না থাকায় ডাক্তারের সম্ভাব্য পেশেন্টরা যেহেতু তার কাছে ভিড়তে পারে না, তাই ডাক্তারের পকেটও খালি হয়ে থাকে। ডাক্তারের কাছে রোগী না আসতে পারার অর্থ হলো, ডাক্তারেরও অভাবে মরা! তাই, ‘ডাক্তার মরে রোগীর অভাবে’। যে সমাজে চিকিত্সা-সেবাকে সামাজিক দায়িত্বের বদলে ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক ও বিনিময়যোগ্য বাজারি-পণ্যে পরিণত করে রাখা হয়, সেখানে এরূপ অমানবিক বৈপরীত্য ও দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটা অবধারিত। ডাক্তার ও রোগীর মাঝে যে অদৃশ্য ও দুর্ভেদ্য দেয়াল দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে, সেটিই ‘পুঁজিবাদ’। এ দেয়াল না ভাঙ্গত পারলে এরূপ অসংগতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার ‘মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ’ কবিতায় এক জায়গায় লিখেছেন, বিদ্যমান সমাজে—
‘যার হাত আছে তার কাজ নেই,
যার কাজ আছে তার ভাত নেই,
আর যার ভাত আছে তার হাত নেই।’
অর্থাত্ আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে যারা হাত দিয়ে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ ও দেশের সম্পদ সৃষ্টিতে সক্ষম তাদের অনেকেই কর্মহীন বেকার জীবন কাটাতে হয়। হাত থাকলেও তাদের কাজ নেই! আবার যাদের কাজ আছে তারা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও তাদের শ্রমের উপযুক্ত দাম পায় না। তাই, কাজ থাকলেও তাদের ‘ভাত’ নেই! অন্যদিকে সমাজের ‘পেট ভরে খাওয়া’ মানুষরা হাত দিয়ে কাজ না করেই অন্যের শ্রমের ফসল দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে। তাদের থাকে পায়ের ওপর পা তুলে আয়েসী জীবন কাটিয়ে দেয়ার সুযোগ। তাদের নেই কোন দয়ামায়ার ‘হাত’। আছে শুধু পা দিয়ে লাথি মারার প্রবৃত্তি ও শোষণের লালসা।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে সমাজতন্ত্রের প্রথম পাঠ নেয়ার দিনগুলোতে আমার পঠিত প্রখ্যাত ব্রিটিশ সমাজতন্ত্রী জন স্ট্র্যাচির একটি বইয়ে বর্ণনা করা একটি উপাখ্যানের কথা আমি এখনো ভুলি নাই। লেখক সেখানে ইংল্যান্ডের যে অঞ্চলটি কয়লার জন্য বিখ্যাত, সেই নিউক্যাসল এলাকার একজন খনি শ্রমিকের বাসায় শ্রমিকের স্ত্রী ও তার শিশু পুত্রের মধ্যে কাল্পনিক কথোপকথনের বিবরণ তুলে ধরেছেন। হাড় কাঁপানো শীতের সংঘাতে তাদের মধ্যে চলা কথাবার্তা হলো এরকম।
ছেলে : মা, বাড়িতে আজ ঘর গরম করার চুল্লিতে কয়লা জ্বালাওনি কেন? ঠাণ্ডায় তো মরে যাচ্ছি।
মা : বাবা, কয়লা জ্বালাবো কি করে? বাসায় যে এক খণ্ড কয়লাও আর নেই। আমাদের সব কয়লা যে শেষ হয়ে গেছে।
ছেলে : কয়লা শেষ হয়ে থাকলে বাজার থেকে কয়লা কিনে এনে রাখোনি কেন, মা?
মা : কয়লা কিনতে যে টাকা লাগে, বাবা। কিন্তু হাতে যে আমাদের কোনো টাকা-পয়সা নেই।
ছেলে : কোনো টাকা-পয়সা নেই কেন, মা?
মা : তোমার বাবা যে বেতন পায়নি। তার চাকরি যে চলে গেছে। তাই হাতে আমাদের কোনো টাকা-পয়সা নেই।
ছেলে : বাবার চাকরি চলে গেছে কেন, মা?
মা : বাজারে কয়লার মজুদ যে বেশি হয়ে গেছে। সেজন্য তোমার বাবার চাকরি গেছে। চাকরি নেই, তাই হাতে টাকা নেই। টাকা নেই, তাই কয়লা কেনা যায়নি। বাজারে কয়লার পরিমাণ ‘বেশি’ হয়ে যাওয়ার কারণে আজ আমাদের ঘরে কয়লা ‘কম’।
এভাবেই পাশাপাশি ‘বেশি’ ও ‘কমের’ বৈপরীত্যমূলক বাস্তবতার যুগপত্ অবস্থান দ্বারা পণ্যনির্ভর পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির অমানবিক ও কুিসত বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র প্রকাশিত হয়ে পড়েছে।
আজকাল ডিজিটাল বাংলাদেশের ‘কলাণে’ ফেইসবুকের পাতায় অনেক মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। এসব মন্তব্যের মধ্যে অনেক গভীর চিন্তার খোরাক থাকে। সেদিন একজন বন্ধুর স্ট্যাটাসে যে পোস্টিংটি চোখে পড়লো, তাতে নিম্নলিখিত বয়ানটি লিপিবদ্ধ ছিল।
আমরা এমন এক সমাজে বসবাস করি যেখানে—
১. পিত্জা ডেলিভারির গাড়ি এ্যাম্বুলেন্স কিম্বা পুলিশ আসতে পারার আগেই উপস্থিত হয়ে যায়।
২. বিলাস গাড়ির জন্য ১৮ শতাংশ হারসুদে ঋণ পাওয়া গেলেও, শিক্ষা ঋণের জন্য ৪০ শতাংশ সুদ দিতে হয়।
৩. মোটা চালের দাম কেজি প্রতি ৪০ টাকা, কিন্তু মোবাইল ফোনের সিম কার্ড ফ্রি পাওয়া যায়।
৪. জুতা বিক্রি হয় দেয়াল ও কাঁচে ঘেরা এসি রুমে, কিন্তু সবজি, ফল-ফলারি ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য বিক্রি হয় খোলা আকাশের নিচে, এমনকি ফুটপাতে।
৫. আমরা খাই কৃত্রিম লেবুর রস, আর আসল লেবুর রস দিয়ে করা হয় ‘ফেইসওয়াস’।
৬. ভুয়া ডিগ্রীধারীরা টাকার জোরে সমাজের মাথা হয়, আর সত্যিকার মেধাবীরা থাকে কর্মহীন।
আমাদের চতুর্দিকে নিত্যদিন পদে পদে এ ধরনের অসংগতি, বৈপরীত্য আরো ভূরি ভূরি ঘটনা আমরা দেখতে পাবো। রুটিন জীবনের গত্বাঁধা ছন্দের মধ্যে থাকায় হয়তো সেসব আমাদের মনযোগ এড়িয়ে যায়। কিন্তু একটু চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করলেই সেসবের দেখা পাওয়া খুবই সহজ।
আরেকটি ফেইসবুক পোস্টিং-এ যে ইংরেজি বার্তাটি চোখে পড়েছিল তার বাংলা রূপান্তর হবে অনেকটা এরকম।
‘প্রথম শ্রেণীতে’ যারা পাস করে তারা অধিকাংশই টেকনিক্যাল কাজ পায়। তারা হয়ে ওঠে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ইত্যাদি।
‘দ্বিতীয় শ্রেণীতে’ যারা পাস করে তারা একটি অতিরিক্ত এমবিএ ডিগ্রী নিয়ে হয়ে ওঠে ‘পরিচালক’ এবং তারা তখন ‘প্রথম শ্রেণী’ অর্জনকারীদের নিয়ন্ত্রণ করে।
‘তৃতীয় শ্রেণীতে’ যারা পাস করে তারা ‘রাজনীতিতে’ প্রবেশ করে এবং উপরোক্ত উভয়কেই নিয়ন্ত্রণ করে।
সর্বশেষ, কিন্তু যা অবজ্ঞা করার বিষয় মোটেও নয় তা হলো, যারা ‘ফেল’ করে তারা ‘অপরাধ জগতে’ প্রবেশ করে এবং উপরোক্ত প্রত্যেককেই নিয়ন্ত্রণ করে।
আর যারা একেবারেই স্কুলে যায় না, তারা হয়ে ওঠে ভন্ড গুরুজী, পীর ইত্যাদি এবং সকলেই হাজিরা দেয় তাদের কাছে!
ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হিসেবে দায়িত্ব শেষ করার পর আশির দশকের শুরুতে ক্ষেতমজুর সমিতি প্রতিষ্ঠা করে সেই আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে আমি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম। তখন আমাকে গ্রামে গ্রামে চষে বেড়াতে হতো। ক্ষেতমজুর ও কৃষকদের মাঝে বড় সভায় হোক বা সন্ধ্যার ‘খুলি (উঠান) বৈঠকে’ হোক, অনেক রকম গল্প মিশিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে হতো। স্বপ্ন ও বাস্তবতার অসাম্যঞ্জস্য ও বৈপরীত্য বোঝানোর জন্য এই গল্পটিও মাঝে মাঝে বলতাম বলে এখনো মনে আছে।
এক গরিব কাঠুরিয়া জঙ্গল থেকে লাকড়ি কেটে এনে বাজারে তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। এ কাজ খুব পরিশ্রমের। কাঠ কেটে লাকড়ি বানাও। তারপর তার ভারি বোঝা কাঁধে বয়ে নিয়ে বাজারে যাও। জোয়ান বয়সে এতো পরিশ্রম সম্ভব হলেও বার্ধক্য আসার পর তা কাঠুরিয়ার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠলো। জঙ্গল থেকে ফেরার সময় প্রায়ই সেই এলাকার দারোগা সাহেব ঘোড়ার পিঠে চড়ে হনহনিয়ে তার পাশ দিয়ে ছুটে যেতো। কাঠুরিয়া কেবলই ভাবতে থাকলো যে, ঘোড়ার কাঁধে লাকড়ির বোঝা চাপিয়ে এবং পিঠে নিজে সওয়ার হয়ে যদি জঙ্গলে আসা-যাওয়াও করতে পারতাম তাহলে কতো আরাম হতো! সে প্রতিদিন প্রার্থনা করতে শুরু করলো, ‘আল্লাহ! তোমার কাছে শুধু একটি প্রার্থনা, আমাকে ঘোড়ার পিঠে চড়ে যাওয়ার তৌফিক দাও।’
একদিন লাকড়ির বোঝা কাঁধে নিয়ে শহরে ফেরার পথে কাঠুরিয়া দেখে যে, দারোগা সাহেব পথে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে তার ঘোড়াটি। সেটি আসলে ছিল একটি মাদী ঘোড়া। সদ্য একটি বাচ্চা প্রসব করেছে। সদ্য প্রসূত ঘোড়ার বাচ্চাটি পাশে মাটিতে রয়েছে। দারোগা কাঠুরিয়াকে পেয়ে ধমক দিয়ে তাকে হুকুম দিল, ‘কাঁধের বোঝা নামিয়ে রেখে ঘোড়ার বাচ্চাটি পিঠে নিয়ে থানায় পৌঁছে দিয়ে আয়।’ কাঠুরিয়া নিরুপায়। দারোগার ধমক ও হুকুম। ভয়ে থরো থরো হয়ে সে ঘোড়ার বাচ্চাকে পিঠে তুলে নিয়ে হাঁটতে থাকলো। হাঁটতে হাঁটতে মনের দুঃখে সে আপন মনে বলতে থাকলো, ‘আল্লাহ! আমি চেয়েছিলাম ঘোড়ার পিঠে চড়তে, আর এখন কিনা উল্টা ঘোড়া আমার পিঠে উঠে বসেছে।’
বাস্তব জীবনেও জনগণের আর ঘোড়ার পিঠে চড়া হয়ে ওঠে না। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়ার জন্য তার আশা জাগে। শক্তি উজাড় করে সেজন্য সে প্রয়াস চালায়। আশায় চোখের তারা চক্ চক্ করে ওঠে। কিন্তু হায়! পরিশেষে দেখে সবই মরীচিকা। ঘোড়ার পিঠে সে চড়বে কি, ঘোড়াকে তার পিঠে চাপিয়ে দেয়া হয়।
যে সমাজের অসংগতি, বৈপরীত্য, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের স্বরূপ এ ধরনের, সে সমাজ ব্যবস্থাকে কি বহাল থাকতে দেয়া যায়? না, তাকে কোনমতেই বহাল থাকতে দেয়া যায় না! তাইতো, এ সমাজ ভাঙ্গতে হবে, নতুন সমাজ গড়তে হবে। এই আওয়াজকে আজ আরো বুলন্দ করতে হবে
সুত্র

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




