২৩ জানুয়ারি সোমবার। রাত সাড়ে ৮টার দিকে দেশ টিভির চট্গ্রাম অফিস থেকে ফোন করলেন সাংবাদিক সৈয়দ আলমগীর সবুজ। তিনি বললেন, 'কাপ্তাইয়ের বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে (বিএসপিআই) ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ হয়েছে। আমি শুনেছি পুলিশের গুলিতে একজন ছাত্র মারা গেছে। আপনি একটু খবর নিয়ে দেখুন। আমার সঠিক তথ্য দরকার।'
বিএসপিআইতে আমি পাঁচ বছর শিক্ষকতা করেছি। ওখানকার নাড়ি-নক্ষত্র আমার চেনা। শিক্ষার্থীদের আচরণগত প্রবণতার সাথেও আমি মোটামুটি পরিচিত। লেখাপড়ার মান বিবেচনায় দেশসেরা পলিটেকনিক হিসেবে এটির পরিচিতি রয়েছে। তবু মাঝেমাঝে সেখানে নানাবিধ সমস্যা হয়। ২০০৯ সালে একবার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাথা ফেটে গিয়েছিল। কিন্তু তবু গোলাগুলির মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। আর ছাত্র নিহত হওয়া? বিএসপিআই-এর ৩৯ বছরের ইতিহাসে কখনো এমন ভয়ানক কাণ্ড সংঘটিত হয়নি। আলমগীর সবুজের ফোন পেয়ে আমার মনে হলো- অভূতপূর্ব কোনো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে বিএসপিআইতে। বিএসপিআইতে কর্মরত কয়েকজন শিক্ষককে ফোন করলাম। তাঁরা বললেন, মারাত্মক আহত একজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়েছে।
ঘটনা যা জানা গেল তা এরকম- বিএসপিআই-এর এক শিক্ষার্থীর বন্ধু বেড়াতে এসেছে কাপ্তাইয়ে। সে অন্য এক শিক্ষার্থীকে পেছনে বসিয়ে মোটর সাইকেল চালাচ্ছিল বেপরোয়া গতিতে। কারো মাথায় হেলমেট ছিল না। পার্শ্ববর্তী নতুনবাজারে অবস্থানরত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাৎক্ষণিক তাদের পাকড়াও করে ভ্রাম্যমান আদালত বসালেন। জেল-জরিমানা করলেন। কান ধরে উঠ-বসের নির্দেশ দিলেন। খবর পৌঁছে গেল মাত্র ২শ গজ দূরের বিএসপিআইতে। ছাত্ররা এসে ভ্রাম্যমান আদালতকে ঘেরাও করে রাখল। পুলিশ গুলি চালালো। লাগল এক ছাত্রের মাথায়। তার নাম সৈয়দ কায়সার রায়হান। নির্মাণ কৌশল বিভাগের তৃতীয় পর্বের ছাত্র।
একজন শিক্ষক বললেন, ‘গুলি লেগে ছেলেটার মগজ বেরিয়ে গিয়েছিল। রক্তে ভিজে গিয়েছিল রাজপথ।’ তারই বিভাগের অতিথি শিক্ষক রাকিব চৌধুরী কাঁদছিলেন। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ‘আজই ১১টায় ওদের ক্লাস নিয়েছি। কায়সার প্রতিদিন সময়মতো ক্লাসে আসে। কিন্তু আজ দেরীতে এসেছিল। এতক্ষণে বোধহয় কায়সার আর নেই।’ রাকিব আর কিছু বলতে পারলেন না। রাত পৌনে নয়টায় আলমগীর সবুজই ফোন করে জানিয়ে দিলেন কায়সার মারা গেছে।
প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন ছিল কায়সারের। তার পরিবারও একই স্বপ্ন দেখেছিল। সীতাকুণ্ডের কুমিরা উচ্চবিদ্যালয় থেকে জিপিএ পাঁচ পেয়ে এসএসসি পাস করার পর স্বপ্নপূরণে ভর্তি হলো বিএসপিআইতে। কোনো শিক্ষক নেই জেনেও ভর্তি হলো নির্মাণ কৌশলে। লক্ষ্য তার এতটাই অটুট ছিল। পরদিন ২৪ জানুয়ারি হাটহাজারি উপজেলার কুয়াইশ বুড়িশ্চর ইউনিয়নের বথুয়ায় গ্রামের বাড়িতে কায়সারের জানাজা হলো। দাফন হলো। সহপাঠী, শিক্ষক, স্বজন, এলাকাবাসীর কান্নায় ভারী হয়ে গিয়েছিল পরিবেশ। কায়সারের বাবা আবদুল মান্নান সম্প্রতি বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন ভাগ্যাহত হয়ে। তিনি বুক চাপড়ে বলছিলেন, ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি। আর আজ আমার স্বপ্নের দাফন হলো। কায়সারের মা মূর্চ্ছা যাচ্ছিলেন বারবার।
কী দোষ ছিল কায়সারের? এই প্রশ্ন বড়ভাই সায়েম সাইদের। বিএসপিআই-এর প্রাক্তন ছাত্র জয়দীপ রুদ্রের প্রশ্ন- বেপরোয়া মোটর সাইকেল চালানোর শাস্তি কি মৃত্যু?
এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
ছাত্ররা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু সে আইন প্রয়োগের কৌশল সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের আরও সচেতন ও দূরদর্শী হওয়া প্রয়োজন। কলেজের পাশে কলেজছাত্রকে জেল-জরিমানা করাই যায়। কিন্তু কান ধরে উঠ-বস? এসব শাস্তির প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে- না ভেবেই রায় দিয়ে দিলেন নির্বাহী কর্মকর্তা? এতটা অদূরদর্শী তিনি? তাছাড়া কান ধরিয়ে ছাত্রদের আত্মসম্মানবোধে আঘাত করা- এটা কোন অপরাধের শাস্তি? কোন আইনে আছে এটা?
ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিবেচনা করে বলা যায়- এটা তুচ্ছ ঘটনার ভয়ঙ্কর পরিণতি। একটু সচেতন হলে এই মৃত্যু এড়ানো যেত। কিন্ত এড়ানো যায়নি।
আমরা তাই কায়সারকে হারালাম।
তোমার আত্মার শান্তি কামনা করছি কায়সার।
আমরা কায়সার হত্যার বিচার দাবি করছি। শিক্ষার্থীদের ৮ দফা দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করছি
বি:দ্র:ফেবু থেকে নেয়া..

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




