somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রায়ে কি বিস্মিত আমি- আসিফ নজরুল

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ভোর ৬:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কাদের মোল্লার মামলার রায় হয়েছে। তাঁর চেয়ে ছোট মাপের অপরাধী হিসেবে পরিচিত মাওলানা আযাদের ফাঁসির রায় হয়েছিল। আমরা সবাই ভেবে নিয়েছিলাম, অভিযোগ প্রমাণিত হলে কাদের মোল্লারও তাই ফাঁসিই হবে। তাঁর ফাঁসির রায় হয়নি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইনে বলা আছে, দোষী প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড বা অপরাধের গভীরতা অনুসারে যথোপযুক্ত শাস্তির কথা। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগের একটি হচ্ছে ১৯৭১ সালে আলুব্দী গ্রামে গণহত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণ করার। অপরাধ প্রমাণিত হলে শুধু এই অপরাধের ভয়াবহতা অনুসারে তাঁর ফাঁসি হওয়ার কথা, প্রমাণিত না হলে তাঁর ছাড়া পেয়ে যাওয়ার কথা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন। কিন্তু ৩৪৪ জনকে প্রত্যক্ষভাবে নির্বিচারে গণহত্যার দায়ে তাঁকে শাস্তি দেওয়া হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড!
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য প্রণীত ১৯৭৩ সালের আইনটি এমন যে আপিলে এই শাস্তি কমতে পারে, কিন্তু বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। ট্রাইব্যুনালের রায়ে শুধু যে একটি অভিযোগ থেকে কাদের মোল্লাকে খালাস দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষ এর বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে। কিন্তু তিনি অব্যাহতিই পেয়েছেন যে অভিযোগ থেকে, আপিলে নতুন কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেওয়ার সুযোগ নেই বলে আপিল শুনানির পর তাতে তাঁর অন্তত মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। যাঁরা এই প্রবোধ দিচ্ছেন, তাঁরা ক্ষুব্ধ জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। গণহত্যার অপরাধে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের কোনো যৌক্তিক সম্ভাবনা আর নেই।
আমরা কি প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি এর? একটি টিভির সংবাদে রায়ের রাতে বললাম, এই রায়ে আমি খুশি, হতাশ এবং বিস্মিত! খুশি কারণ, অ্যাটলিস্ট বিচার তো হয়েছে অবশেষে। হতাশ ও বিস্মিত কারণ, এত বড় অপরাধ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড না হয় কীভাবে? এই বক্তব্য দেওয়ার পর সারাক্ষণ নিজেকে প্রশ্ন করি, আসলেই কি আমি বিস্মিত হয়েছি রায়ে! উল্লেখ করার মতো বিস্মিত? না মনে হয়। আমি এই রায়ে তেমন একটা বিস্মিত হইনি আসলে। রায়ে হতাশ হওয়ার কারণ থাকতে পারে কিন্তু বিস্মিত হওয়ার কারণ নেই।
রায়ের আগের কয়েক দিনে জামায়াত-শিবির রাজপথে নাশকতা চালিয়েছে, পুলিশের এবং সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে চড়াও হয়েছে, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। পুলিশ মার সহ্য করেছে, ব্যস্ত রাজপথে জামায়াত-শিবিরকে উগ্র মিছিল করতে দিয়েছে, তাদের হাতের ফুল গ্রহণ করেছে। এই পুলিশ কোন পুলিশ? কোন জাদুবলে বদলে গেল এই রাষ্ট্রের পুলিশ!
এই পুলিশই না কিছুদিন আগে বামদের শান্তিপূর্ণ মিছিল আর শিক্ষকদের অনশন বিষাক্ত গ্যাস আর লাঠিপেটা দিয়ে ছত্রভঙ্গ করেছে, আরও আগে আনু মুহাম্মদের মতো দেশপ্রেমিক মানুষকে দেশের সম্পদ রক্ষায় মিছিল করার সময় পিটিয়ে হাত ভেঙে দিয়েছে! এই পুলিশের হর্তাকর্তা হয়ে সাহারা খাতুনের পর মহীউদ্দীন খান আলমগীর এসেছেন। তাঁর ভাষা আরও তীব্র, ঝাঁজালো এবং আক্রমণাত্মক। বিএনপির চিফ হুইপকে পিটিয়ে রক্তাক্তকারী পুলিশকে তিনি রাষ্ট্রপতি পদক লাভের যোগ্য মনে করেন! জামায়াত-শিবির আর বিরোধী দলকে দমন করার জন্য যুবলীগ আর ছাত্রলীগকে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্ররোচনা দিয়েছিলেন। মরিচের গুঁড়া আর বিষাক্ত গ্যাস বাংলাদেশে তিনিই চালু করেন। জামায়াত-শিবিরের প্রতি গত কয়েক দিনে তাঁর পুলিশের এমন আকস্মিক প্রেমময় আচরণে নমনীয় রায়ের কোনো ইঙ্গিত ছিল কি? তাহলে আর রায় নিয়ে অবাক হই কেন আমি বা আমরা!
জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সিংহভাগ দায় অবশ্যই বিএনপির। বিএনপি তাই কোনো দিনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তরিক হতে পারে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ পারে কি? এই বিচারে আওয়ামী লীগ কিছুটা বা আধা আন্তরিক হতে পারে। কিন্তু যে অটল আদর্শিক অবস্থান থাকলে এই বিচারের জন্য নিশ্ছিদ্রভাবে আন্তরিক হওয়া সম্ভব, সেই অবস্থান আওয়ামী লীগের আছে কি? নাই সম্ভবত। আওয়ামী লীগ একাধিক বার জামায়াতের সঙ্গে আপস করেছে বা করার চেষ্টা করেছে। শেষবারের আপসের সময় যে নিজামীদের ফাঁসির দাবিতে আওয়ামী লীগ জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলন করেছিল, সেই নিজামীর সঙ্গে এক টেবিলে বসে আওয়ামী লীগের নেত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।
বিএনপির মতো আওয়ামী লীগের কাছেও রাজনীতির আসল ইস্যু ক্ষমতা। ক্ষমতায় আসার প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ যদি অতীতে জামায়াতের সঙ্গে আপস করতে পারে, তাহলে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে করতে পারবে না কেন? ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের আসল এবং একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। আগামী নির্বাচনে বিএনপির জয় এমনকি অংশগ্রহণ ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনে জামায়াতের সঙ্গে গোপন আপস আওয়ামী লীগ সম্ভবত করতে পারে। এই আপসের ইচ্ছা থাকলে জামায়াতের কোনো নেতার তো ফাঁসি হতে পারে না! তাহলে কাদের মোল্লার হীন অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও তাঁর ফাঁসি না হলে আমি বা আমরা অবাক হই কেন! বিএনপি একই প্রয়োজনে জামায়াতের সঙ্গে আরও বড় আপস করতে পারে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই বন্ধ করতে পারে। তাতেও কি অবাক হব আমরা?
রাজনীতির লড়াইটা আসলে ক্ষমতার। ক্ষমতার রাজনীতির সমীকরণেই ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধী আইন প্রণয়নের পর বঙ্গবন্ধুর দুই বছরসহ পরবর্তী ৩৮ বছরে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর আমলসহ ৩৬ বছরে (১৯৭২-২০০৮) গোলাম আযম-নিজামীদের বিরুদ্ধে কোনো দিন মামলা হয়নি। এই সমীকরণেই শাহ আজিজ জিয়ার মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বদরুল হায়দার চৌধুরী গোলাম আযমের দোয়া নিতে গেছেন, খালেদা জিয়া নিজামী-মুজাহিদকে মন্ত্রী বানিয়েছেন।
সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা আর রাজনৈতিক মেরুকরণ মিলে যাওয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের বহুল প্রত্যাশিত বিচার অবশেষে শুরু হয়েছিল। এই বিচার কিছুতেই আর অন্তত আওয়ামী লীগের পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে বিচার-প্রক্রিয়ায় নানান ভূমিকা রেখে যুদ্ধাপরাধীদের অন্তত ফাঁসি থেকে রক্ষা করা তো সম্ভব! সম্ভব শাস্তি নিয়ে দর-কষাকষি করার, ভবিষ্যৎ নির্বাচনকেন্দ্রিক আপস করার!
এসব আপস এবং রাজনীতির ছক রুখতে পারে একমাত্র এ দেশের তরুণসমাজ। শাহবাগে দুই দিন ধরে বসে আছে সেই তরুণেরা। তাদের গর্জন, স্লোগান আর উচ্চারণে একদিন কি হুঁশ ফিরবে নেতাদের! ৪২ বছর ধরে স্বজন হারানোর বেদনা বহন করা বুকগুলো কি অপার শান্তি পাবে কোনো দিন! কোনো দিনও কি মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করতে পারব আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×