somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিলেকোঠার জানালা

১১ ই ডিসেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাইরে অনেক মানুষের হইচই আর চেঁচামেচি শুনে মতিন সাহেব বাগানে এসে দাঁড়ালেন। কোলাহল ভেসে আসছে ঝিলের ধার থেকে। জটলা পাকিয়ে অনেক মানুষ, সবার মধ্যে কি নিয়ে যেন উত্তেজনা বিরাজ করছে। গায়ের চাদরটা ভালো করে আরেকবার জরিয়ে নিয়ে সেই দিকে পা চালালেন তিনি। একটা পুলিশ ভ্যন আর আ্যম্বুলেন্স ও চলে এসেছে ইতিমধ্যে। কাল রাতে আরেকটি খুন হয়েছে এখানে। এই নিয়ে গত ছয় মাসে তৃতীয় খুন এইটি। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে ফিরে তাকালেন তিনি। রেহান বলল, এই পাতলা চাদর পড়ে বাইরে এলে কেন বাবা? মৃদু হাসলেন মতিন সাহেব, ছেলের হাত ধরে বাংলোর দিকে ফিরে চললেন। সেই আট বছর বয়সেই ছেলেকে বিলাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় ল্যটা চুকিয়ে প্রায় পনেরো বছর পর দেশে ফিরেছে রেহান। এতোগুলো বছরে একটিবারের জন্যও দেশে আনেন নি ছেলেকে তবে মতিন সাহেব প্রতিবছরই দুবার করে যেতেন ছেলের কাছে। এতো বছর বিলাত-বাসের পরেও রেহান হয়েছে একদম মাটির মানুষ, ব্যবহার আর চালচলনে আছে ভীষণ রকমের সারল্য। মনে মনে একটি স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মতিন সাহেব। শহরে আরো তিনটি বাড়ি আছে মতিন সাহেবের কিন্ত রেহানের বেয়াড়া অনুরোধ রাখতেই ছেলেকে নিয়ে উঠেছেন ঝিলের ধারের এই বাংলো বাড়িতে। শখ করে বানানো এই বাংলোর কোনায় কোনায় যেমন ছড়িয়ে আছে রেহানের শৈশবের স্মৃতি তেমনি এই বাংলোয় জড়িয়ে আছে মতিন সাহেবের এক অন্ধকার অতীত।

বাংলোর চিলেকোঠার ঘরটি ছিল রেহানের খেলার আস্তানা। মতিন সাহেব আর স্ত্রী রেহানা মিলে সযত্নে ছেলের জন্য ঘরটিকে সাজিয়েছিলেন। জানালা দিয়ে ঝিলের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে কিংবা খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয় প্রায়দিনই রেহান চিলেকোঠায় পাতা বিছানাটিতে ঘুমিয়ে পড়তো। তখন তাকে কোলে তুলে নিজের ঘরে এনে শুইয়ে দিতেন রেহানা। রূপকথার সেই গল্পের মত রেহানার প্রান যেন আটকে ছিল ছেলে রেহানের মধ্যে আর রেহানের ও ঠিক তাই। মা আর ছেলের এমন হৃদ্যতা দেখে মতিন সাহেব প্রায়শই বুকের ভেতরে ফাঁকা অনুভব করতেন। ভীষণ চঞ্চল মনের রেহানার সাথে গম্ভীর প্রকৃতির মতিন সাহেবের মনের মিল কোন কালেই হয় নি। ছেলে, রেহানের জন্মের পর তাদের দূরত্ব আরো বহুগুনে বেড়ে গিয়েছিল। ছেলেকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার সমস্ত ব্যপারটা গুছিয়ে এনেছিল রেহানা। এই বিষয় নিয়ে এক সন্ধ্যায় তুমুল তর্ক শুরু হয় স্বামী স্ত্রীর মাঝে, রাগ সামলাতে না পেরে রেহানাকে ধাক্কা মেরে বসেন মতিন সাহেব। ভারসাম্য হারিয়ে পা হড়কে রেহানা গড়িয়ে পরেন কাঠের সিঁড়ি থেকে। ঘটনার আকস্মিকতা কাটতেই ছুটে নীচে নেমে এলেন মতিন সাহেব, কিন্ত ততক্ষণে রেহানার দেহটি নিথর পড়ে আছে মার্বেল পাথরের মেঝেতে। প্রথমটায় কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না মতিন সাহেব তারপর একটি কালো কম্বলে জড়িয়ে নিলেন নিজেকে। রেহানার নিথর দেহটি বয়ে নিয়ে চললেন ঝিলের দিকে। রাতের নিস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে শুধু ঝপাং করে পানিতে ভারী কিছু পড়ার শব্দ হল তারপই আবার চারিদিক ঘীরে নিলো সুনসান নীরবতা। সকালে ঝিলে ভেসে ওঠা লাশ দেখে পুলিশে খবর দেয় লোকজন। দাম্পত্য কলহের কারনে পানিতে ডুবে আত্মহত্যা! অনেক পয়সাপাতি খরচ করে এমনটাই সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছিলেন মতিন সাহেব।

মায়ের মৃত্যুর খবরে রেহানের মাঝে তেমন কোন ভাবান্তর দেখা যায় নি, যেন সে আগেই জানত এমনটি হতে চলেছে। শুধু একটি ব্যপার মতিন সাহেব বেশ লক্ষ্য করলেন, রেহান আগের থেকেও বেশী সময় কাটাতে লাগলো চিলেকোঠায়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে জানালা ধরে। এই ঝিলেই মায়ের মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল হয়তো এই কারনে তার অপলক দৃষ্টি থাকে সেদিকে। নিজেকে তাই বোঝান মতিন সাহেব। ছেলের মন থেকে এই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা দূর করতে কিছুদিনের মধ্যেই রেহানকে বিলাতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। এতো বছর পর এই বাংলোয় ফিরে এখনো রেহান সেই একই কাজটি করছে। প্রায় রাতেই মতিন সাহেব আড়াল থেকে লক্ষ্য করেন রেহান চিলেকোঠার জানালায় দাঁড়িয়ে ঝিলের পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

মাস দেড়েক পরের এক ভোরে আবার ঝিলের ধারে হট্টগোল শুনে এগিয়ে গেলেন মতিন সাহেব। এবারের লোকটিকে আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয় নি। আচমকা আঘাতে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছিলেন লোকটি তাই তাকে মৃত ভেবে সেখানেই ফেলে চলে গেছে আততায়ী। ঝিলের ধারে বার বার খুনের এই ব্যপারটি উপর মহলে বেশ সাড়া ফেলেছে, পুলিশও এবার তোড়জোর তদন্ত শুরু করেছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা নিজেই এগিয়ে এলেন মতিন সাহেবের দিকে। জানালেন কোন ছিনতাই কিংবা রাহাজানির উদ্যশ্যে নয় বরং পুলিশ ধারনা করছে এই ধারাবাহিক খুনের ঘটনাগুলো কোন সিরিয়াল কিলারের কাজ। একই জায়গা, রাতের অন্ধকারে একই কায়দায় হত্যা অথবা হত্যার চেস্টা অন্ততএই দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে এবার আহত ব্যক্তিটির কাছ হতে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। আঘাতকারীকে দেখতে না পেলেও সংজ্ঞা হারানোর আগ মুহূর্তে আহত ব্যক্তি শুনতে পায়েছিলেন আততায়ী বলছে, ''তুই ডুবিয়ে মেরেছিস আমার মা কে... তুই ই ডুবিয়ে মেরেছিস''। পুলিশ কর্মকর্তাটি আরো কি কি যেন বলছিল কিন্ত মতিন সাহেব কোন কথাই আর শুনতে পেলেন না। কাঁপা পায়ে ঘরে এসে ঢুকলেন। রেহান হাসি মুখে বাবার দিকে এগিয়ে এলো। আজকের নাস্তা আমি রেডি করেছি বাবা, তুমি সকাল সকাল কোথায় গিয়েছেলে? মতিন সাহেব ছেলের চোখের দিকে তাকালেন, কি সরল সেই চোখ!

নিজের ঘরে ঢুকে ফোন হাতে নিলেন মতিন সাহেব। ম্যনেজার কে ফোন করা দরকার, রেহানের বিদেশে পি এইচ ডি করতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে। এই বাংলো ও তিনি বিক্রি করে দেবেন, শুধু বাংলো কেন এদেশের সমস্ত ব্যবসাপাতি গুটিয়ে ফেলবেন। ছেলের সাথে বিলাতে স্থায়ী হয়ে যাবেন।

মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে যেন চাঁদ। চিলেকোঠার জানালায় দাঁড়িয়ে আছে রেহান। বহু বহু বছর আগে এক রাতে আচমকা তার চোখ চলে গিয়েছিল ঝিলের দিকটায়। চাঁদের আলোয় শাড়ী দেখে চিনতে অসুবিধে হয় নি রেহানের, ঝিলে ডুবিয়ে দেয়া অনড় দেহটি ছিল তার মায়ের। এ দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল রেহান আর তাই তার মাকে খুন করা সেই অস্পষ্ট মূর্তিটি কে ছিল, কোথায় গেল তা আর দেখা হয়ে ওঠে নি। এক জোড়া চোখ আজও চিলেকোঠার জানালায় জ্বলজ্বল করে, ঝিলের ধারে খুঁজে ফেরে সেই আবছায়া মানব মূর্তি আর হাত নিশপিশ করে প্রতিশোধের নেশায়।

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২১ সকাল ৯:০৬
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×