আমি তখন ক্লাস এইটে।
দ্বিতীয় সাময়িকের ক্লাস টেস্টের খাতা নিয়ে ম্যাডাম ঢুকলেন। দেখলাম প্রথমেই আমার খাতা রাখা পঁচিশে চব্বিশ। ম্যাডাম আমার চেহারা দেখে কি ভেবে যেন খাতাটা সরায় রেখে বাকি সবার খাতা দিয়ে দিলেন।
দেখলাম হাইয়েস্ট পেয়েছি আমি। মহা খুশি হয়ে অপেক্ষা করছি, এখন আমার খাতার পালা।
ম্যাডাম আমার হাতে খাতা দেয়ার আগে আরেকবার টেনে নিয়ে টান দিয়ে তিনটা বড় প্রশ্নে এক-দেড় করে কেটে, সব যোগ করে টোটালের ঘরে উনিশ বসায় আমাকে খাতাটা দিলেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই একটু অবাক। সাধারণত ইংলিশের হাইয়েস্ট আমার কিংবা সামিয়ার দখলে থাকে। কিন্তু এভাবে হাইয়েস্ট পেতে তারও ভালো লাগলো না।
ম্যাডামকে বলবো কি বলবো না করেও বলে ফেললাম, ম্যাডাম এখানে চব্বিশ ছিলো?
ম্যাডাম আমার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলেন, হু। তোমার উত্তর আরও ভালো হওয়ার কথা ছিলো।
আমি চুপ করে খাতা নিয়ে বসেছিলাম সিটে।
এর বছর দেড়েক পরের কথা। সেই ম্যাডামই আমাদের সমাজ নিতেন নাইন-টেনে।
পরীক্ষার আগের কোচিং করতে গিয়েছিলাম সেদিন। ম্যাডাম টেস্টের খাতা ধরায় দিয়ে বললেন যোগ করে দেখতে যোগ ঠিক আছে কিনা। আমি আর শাতিল ছিলাম। দু'ভাগে করছিলাম যোগ।
এর মধ্যেই আমার খাতা আমার হাতে পড়লো। উপরে বাইশ। আমি মহা খুশি। পাস একুশে, আমি বাইশ। সমাজে আমি সেই লেভেলে খারাপ ছিলাম। তার উপর পরীক্ষার আগের দিন ঘুরতে গিয়েছিলাম। পাশ করেই তা-ধিন-তা অবস্থা। কিন্তু যোগ মিলিয়ে দেখি আসে সতের।
আমি আবার গুনে দেখি সতের- মানে আমি ফেল।
শাতিলকে দেখাই, সেও যোগ করে দেখে একি অবস্থা। বাকি সব খাতা ঠিক আছে কিন্তু, এই একটায় গড়বড়।
শাতিল দ্বিধা করছিলো ম্যাডামকে দেখাবে নাকি- আমার সামনে আমার খাতায় ফেল করাতে হয়তো বাধছিলো তার। আমি নিজেই ম্যাডামকে গিয়ে বললাম, ম্যাডাম এই খাতায় যোগ ভুল হইসে, সতের হবে।
ম্যাডাম আমার হাত থেকে খাতাটা টান দিয়ে নিয়ে বললেন, এটা বাইশ হবে, বাকি গুলো ঠিক আছে??
দু'টো ঘটনার দু'রকম প্রভাব পড়েছিলো আমার উপর।
ক্লাস এইটে আমি বৃত্তির জন্য সিলেক্ট হয়েছিলাম বাই চান্স। আমার নিজের উপরে ভরসা ছিলো যে পাবো না। কিন্তু, কেন যেন টীচারদের বিশ্বাস ছিলো আমার উপর। এরকম টুকরো টুকরো ঘটনা দিয়ে ম্যাডাম আমাকে বুঝিয়ে দিতেন তিনি কি চান আমার কাছে।
এর ফলাফলটা হয়েছিলো এমন, প্রথম সাময়িকে ১৫ তম, দ্বীতিয়তে ২২ এবং তৃতীয়তে প্রথম হয়েছিলাম। আমার মার্কস এতবেশি ছিলো, যখন গড় করা হয়েছে তিন পরীক্ষার, গড়ে আমি তৃতীয়।
আর বৃত্তি? সেটাও পেয়েছিলাম, সাধারণ গ্রেডে দশম হয়ে।
আর টেস্টে, সেবার আমাদের মাত্র পনেরজন সব বিষয়ে পাশ ছিলো, আমি সহ। কি পরিমাণ ছোট লাগছিলো নিজেকে বলে বোঝাতে পারবো না।
এসএসসির রুটিনে যখন দেখলাম কম্পিউটার পরিক্ষা সমাজের আগেরদিন বিকালে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো আমার।
সেবার আমাদের মাঝে দুই জন এ পেয়েছিলো সমাজে, যাদের এ পাওয়াটা নিউজ ছিলো। শামীমা- ও যে এ+ মিস করবে কেউ ভাবে নি, আর আমি- আমি যে বি মিস করবো, কেউ ভাবে নি।
ম্যাডামের নাম, গুলশান আরা।
শহীদ আনোয়ারের অন্যতম বেস্ট টীচার।
আমার জীবনে দেখা সেরাদের একজন।
ম্যাডাম আমাকে অনেক আদর করতেন।
এই রকম আরো অনেক গল্প আছে ওনার সাথে আমার।
ছোট ছোট ঘটনা দিয়ে উনি সবসময় আমাকে অনুপ্ররণা যোগাতেন। সবসময় তার ট্রাস্ট ছিলো আমার উপরে।
আমার জীবনের ছোট বড় সাফল্যে যে কয়জন মানুষের চেহারা আমার মনে আসে উনি তাদের একজন।
আজ আমি খুব গর্ব করে বলি, বুয়েটে পড়ি- আর্কিটেকচারে। যেখানে পড়ার স্বপ্ন ছোটবেলা থেকে ছিলো, সেখানেই পড়ছি, নিজের সখের সাবজেক্টেই। আমার এই সাফল্যের ভিত যে কয়জন মানুষের হাতে গড়া,
ম্যাডাম তাদের একজন।
একটু আগে জানলাম ম্যাডাম মারা গেছেন। বেশ ক'বছর আগেই নাকি। আমি খবর পাইনি। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার ব্যস্ততায় অনেক খবরই মিস হয়ে যায়।
___________________________________________
ছন্নছাড়ার পেন্সিলের কাছ থেকে জানলাম মাত্র খবরটা ভুল ছিল।
ম্যাডাম বেঁচে আছেন ।
ধন্যবাদ ছন্নছাড়ার পেন্সিলকে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০০৯ রাত ১০:৩৪