.
ট্রেন আসতে আরো ঘন্টা দুয়েক দেরী।আবীর ষ্টেশন মাস্টারের সাথে কথা বলে এসে নিহা কে জানাল।নিহা কিছু বলল না।এমন কি মুখ দিয়ে বিরক্তি ভাব ও প্রকাশ করল না।শুধু মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাল।
.
স্টেশনে লোকজন কম,ট্রেন ছাড়তে দেরী তাই হয়ত কেউ নেই।এত জলদি অবশ্য আবীর ও আসতে চায়নি নিহার জন্য আসতে হয়েছে। নিহার মনে হচ্ছিল ওই বাড়িতে কিছুক্ষন থাকলে ও মারা যাবে তাই জলদি চলে আসা।
.
নিহা ব্রেঞ্চে বসে আছে,বড় ব্রেঞ্চ।আবীর নিহাকে কথাটা বলে ব্রেঞ্চের পাশে দাড়িয়ে রইল, নিহার পাশে বসার মত অনেক জায়গা তবুও বসল না।বসার অধিকার আছে আবীরের নিহার পাশে, তবুও কোন অদৃশ্য কিছু বাধা দিচ্ছে।সামী স্ত্রীর সম্পর্ক টা থেকেও নিশ্চল মনে হচ্ছে।প্রেমের বিয়ের এমন একটা পরিনতি হবে ওদের দুজনের কেউ ভাবেনি।
.
নিহা আজ চলে যাচ্ছে ওর বাবার বাড়ি। একেবারেই চলে যাচ্ছে,আর হয়ত ফিরবেনা কখনো, দেখাও হবেনা আবীরের সাথে।ঢাকা থেকে চিটাগাং অনেক দূর কেউ যদি নিজে থেকে দেখা না করতে চায় তবে দেখা হওয়া মুশকিল।
.
দুজনেরই হয়ত কষ্ট হচ্ছে কেউ প্রকাশ করছে না, কেউ কারো দূৃর্বলতা দেখাতে চাইছেনা। চাচ্ছেনা এক জন আরেক জনের কাছে ছোট হতে।
দোষ কার এসবে?
জানেনা,কেউ।জেনে লাভ ও নেই খুব একটা।
.
আবীর নিহার পাশে বসতে বসতে বলল,
-বহুবার ক্ষমা চেয়েছি আমি,আরেক বার ভাব।
-বহুবার ভেবেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি আবীর
-আরেক বার মাফ করা যায়না,
-আরেক বার মানে কত বার?
-শেষবার,
-প্রতিবারই তো শেষবার হয়, শেষ তো হয়না।
-এবার সত্যি শেষ।
.
নিহা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল,
-এভাবে সম্ভব নয়,আমরা কেউ সুখি নই।
-আমরা সুখী,
-রোজ এরকম ভাল লাগেনা।
-প্লিজ নিহা,
-এ বিষয় টা থাক।
.
আবীর চুপ করে গেল,এখন আর কথা বলা চলে না।কাল রাত্রের কথাই শুধু মনে পড়ছে আবীরের।হুট করে বলা কথা টা কুড়ে খাচ্ছে আবীরের মন টাকে।বিষিয়ে তুলছে ওকে।
.
ছোট একটা ঘটনার পরিণতি এমন কিছু হবে কখনোই ভাবে নি আবীর।যদি জানত তবে এমন কখনোই বলত না আবীর।অফিস থেকে দেরী করে আসাতে সামান্য একটু ঝগড়া হয়েছে তাতেই এত কিছু।আবীর না হয় বলেই দিয়েছে চলে যাও তাই যেতে হবে।ঝগড়া তো সবার মধ্যই হয় তাই বলে সবাই একে অপরকে ছেড়ে যায়। নিহা কি একবারো ভাবেনি ও চলে গেলে আবীরের কি হবে।
.
একসময় নিহা নিজেই আবীরের জন্য বাসা থেকে চলে এসেছিল,আজ সেই নিহা নিজেই চলে যাচ্ছে।সম্পর্ক গুলো কি এতই ঠুনকো হয়ে যায় কদিনের মধ্যই,যে একে অপরকে ছেড়ে যেতেও দিধা হয়না।
কষ্ট গুলো যদি আবীর ভাষায় প্রকাশ করতে পারত তবে হয়ত নিহা বুঝত।
.
নিহার মাথায় চিন্তা অন্য,একসময় যে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছে সেখানেই ফিরে যেতে হচ্ছে। বাসার সবাই কি ভাববে।বাবা হয়ত বেশি কিছু বলবে না।বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে,তার বেশি কিছু করবেনা।আচ্ছা,নিহা চলে গেলে কি আবীর আবার বিয়ে করবে?
কথাটা জিজ্ঞেস করতে চাইল নিহা,না থাক।নিহা জিজ্ঞেস করল না।কিছু কথার উত্তর না শোনাই ভাল।
.
আবীর আবার বলল,
-আগের মত হওয়া যায়না,
-আমরা তো আগের মতই আছি,
-ভালবাসা টা তো আগের মত নেই,
-সে দোষ কি আমার আবীর,
-দোষের কথা তো বলিনি,
-তাহলে
-আবার আগের মত হই,
-না,সব আগের মত হওয়া উচিত না।তোমাকে ছেড়ে দিলেই তুমি সুখে থাকতে পারবে।
.
আবীর চুপ করে গেল।আর কিছু বলল না।
ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করল,
-পারবনা তোমাকে ছাড়া সুখে থাকতে নিহা।
কিন্তু এগুলা বলা হয়না,এগুলা মনেই থেকে যায়।
.
নিহা বলল,
-তুমি যদি আরেক টা বিয়ে করতে চাও তবে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিও, সাইন করে দিব।
-তোমার কি মনে হয় আমি বিয়ে করব.
-করতেই পারো,
-এমন মনে হল কেন?
-কত কিছুই করেছ আমার সাথে,আর বিয়ে কি?
.
আবারো চুপ হয়ে গেল আবীর।নিহার কথা গুলো বড় নিষ্ঠুর ওর সাথে কথা না বলাই ভাল।তাতে লাভের কিছু নেই শুধু কষ্টই আছে।নিহা শুধু ওর সাথের খারাপ ব্যাবহার গুলোই মনে রেখেছে মনে রাখেনি ক্যাম্পাসের দিন গুলো কথা ,মনে রাখেনি একসাথে বৃষ্টি তে ভেজা সময় গুলো,মনে রাখেনি সুখের মুহূর্ত গুলো।শুধু খারাপ সময় গুলোকেই মনে রেখেছে।
.
নিহা কি সত্যি ভুলে গেছে কষ্ট করে বৃষ্টিতে ভিজে কদম গাছে উঠে কদম পেড়ে নিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে প্রপোজ করা ।ভুলে গেছে কি রাত বিড়াতে ওর হোস্টেলের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে থাকা।সত্যি কি ভুলে গেছে এসব?
কিন্তু কি করে? আবীরের মাথায় কিছু এলনা।
.
-কিছু খাবে নিহা?
-না,
-কেন সকালে তো কিছু খাওনি?
-এমনি, যাও টিকেট কেটে নিয়ে আসো।
-আচ্ছা,
.
আবীর উঠে গেল টিকেট আনতে।নিহা তাকিয়ে রইল আবীরের যাওয়ার দিকে।মানুষটাকে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা নিহার ও নেই,ইচ্ছা না থাকলেও অনেক কিছু করতে হয় এটাও তেমন ব্যাপার।
ভালবাসা আছে দুজনের মধ্য তবুও তারা সুখী নয়,হয়ত দূরে থাকলে ভালবাসাও থাকবে,সুখেও থাকবে।
.
ট্রেন প্রায় এসে গেছে,কথাটা শুনে আবীরের মন খারাপ হল।ট্রেন যত তাড়াতাড়ি আসবে নিহাকে তত তাড়াতাড়ি ছাড়তে হবে।আবীর টিকেট কেটে সাথে দুকাপ চা সহ নিহা র পাশে এসে বসল।
নিহার দিকে চা বাড়িয়ে দিতেই নিহা নিয়ে নিল।
আবীর দুটা টিকেট বের করল,একটা নিহার দিকে বাড়িয়ে দিল।নিহা চায়ের কাপ ব্রেঞ্চে রেখে টকেট টা নিল আর বলল,
-আরেক টা কার?
-কারো না,ভুল করে কেটেছি।
-কেন?
-একা একা তোমাকে কখনো ছাড়িনি,আজ ছাড়ছি মনে ছিল না।
.
নিহা কিছু বলল না,চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিতে দিতে বলল,
-ট্রেন কখন আসবে?
-প্রায় এসে গেছে,
-আচ্ছা,
.
কিছুক্ষন যেতেই ট্রেন চলে এল,নিহা উঠে পড়ল। আবীর ও উঠল নিহার সুটকেস হাতে।ট্রেন কিছুক্ষন থামবে এখানে নতুন বগি লাগাবে। যতক্ষন ট্রেন আছে ততক্ষন নেহা আছে তারপর কে কোথায়? কে জানে?
.
আবীর সুটকেস রেখে সামনা সামনি বসল
নিহার।নিহাই প্রথমে বলল,
-ছেড়ে যাওয়া মানে ই দূরে যাওয়া নয়।আমি থাকলে কখনোই সুখে থাকতে পারবেনা তুমি। তাই চলে যাচ্ছি।
-হুম,
-ঠিক ঠাক থাকবে।
-হুম,
-আর কখনো ফোন করবেনা।
-হুম,
-নতুন বিয়ে করে সংসার করবে,
-হুম,
-শুধু হুম,
-নতুন করে ভালবাসা যায়না,
-না,কালকের কথা মনে আছে?
-হুম,আগের দিনের কথা কিছুই মনে নেই তোমার?
-না,মনে রেখেও তো লাভ নেই।গত এক বছর ধরে রোজ তুমি উল্টা পাল্টা কাজ করছ।তাতে আগের সব কিছু ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক।
-হুম,ভাল থেকো।
.
এসবের মধ্য ট্রেন ভর্তি হয়ে গেল,একজন এসে আবীরকে বলল,
-ভাই এটা আমার সিট,
.
আবীর সিট থেকে উঠে বলল,
-বসেন।
.
আবীর নিহাকে আর কিছু বলল না।চুপচাপ ট্রেন থেকে নেমে বাহিরে চলে এল।নিহা জানালার পাশে বসেছে তাই ওর মুখ দেখা যাচ্ছিল,কি সুন্দর মুখ।কি মায়াবী মুখ !
সবাই অল্প আগের জিনিষ গুলো মনে রাখে, কেউ অনেক দূরের বা অনেক আগের কথা গুলো মনে রাখেনা।নিহাও রাখেনি।
নিহা শুধু গত কালকের কথাটাই মনে রেখেছে। রাগ হয়ে বলা, চলে যাও কথাটাই মনে গেথে নিয়েছে।ফিরে যেতে পায়নি বছর দুয়েক আগে যেখানে আবীরের সব কথাতেই নিহা থাকত। হাজার বার প্রতিজ্ঞা করে বলা থেকে যাও কথাটা আজ নিহার মনে নেই।
সবাই ভোলে নিহাও ভুলে গেছে।ভোলেনি শুধু আবীর।
ট্রেন হর্ণ বেজে উঠল,এখনি ট্রেন ছাড়বে। জানালা দিয়ে নিহার মুখ দেখা যাচ্ছে,মুখের উপর গড়িয়ে পড়া চোখের জল ও দেখা যাচ্ছে।হারিয়ে ফেলা জিনিষের প্রতি কষ্ট আছে কিন্তু সেটি খোঁজার কোন ইচ্ছা নেই নিহার মাঝে।
.
ট্রেন ছেড়েছে , নিহার মুখ আস্তে আস্তে আবীরের কাছে অষ্পষ্ট হচ্ছে।আবির প্লাটফর্ম এ ধুপ করে বসে পড়ল,আশে পাশে লোকেরা অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে কেউ কিছু বুঝছেনা।কেউ কেউ হয়ত পাগল ও ভাবছে।
.
ভাবুক পাগল,কোন ভাবে যদি একজনের মনের ব্যাথা আরেক জনকে দেখানো যেত তবে সবাই কাঁদত আবীরের কষ্ট দেখে।পৃথিবীর নিয়মই হয়ত এটা কেউ কারো কষ্ট দেখবে না,বুঝবে না।
সবাই শুধু নিজের জন্যই ব্যাস্ত থাকবে,নিজের জন্যই সুখ খুজে বেড়াবে।
.
থাকুক সার্থপর পর মানুষ গুলো ভাল ।সে ভাল থাকলে আরেকজন ভাল থাকবে।
ভালবাসা টুকু হারাবে না,থেকে যাবে যতদিন এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে।ভালবাসা গুলো হাওয়ায় উড়ে বেড়াবে এখান থেকে ওখানে, একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কাছে।
রাত জাগার পাল্লা দেয়া হবে,পাল্লা দেয়া হবে কষ্ট চেপে থাকার। কে কত টা পারে?
হয়ত দুজনেই সমান রবে নয়ত কেউ একজন হেরে যাবে,নতুন করে জীবন গুছাবে।
এভাবেই চলবে,চলতে থাকবে............
.
.
.
-নাহিদ পারভেজ নয়ন
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:৩১