somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিএসএফ হাতিগুলোকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়

১৬ ই অক্টোবর, ২০১১ ভোর ৫:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'আমাগোরে ফসল বাঁচাতে হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করা নিত্য সঙ্গী হইছে। অনেক ক্যামেরা দিয়া ফটো তুলা হইল, কোনো কাজ হইল না, সরকারও দেখে না গেরামের চেয়ারম্যান-মেম্বাররাও দেখল না' শ্রীবর্দী উপজেলার সীমান্তবর্তী রাঙ্গাজান গ্রামের রফিকুল ও হারুন ভারতীয় বন্য হাতির আক্রমণে তাদের অসহায়ত্বের কথা এভাবেই জানান।
শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকায় ভারতীয় বন্য হাতির কবল থেকে জীবন ও ফসল বাঁচাতে বাংলাদেশিদের সংগ্রাম এখন নিত্যদিনের। ভারতীয় বন্য হাতির আক্রমণে জানমালের ক্ষতির পাশাপাশি শতাধিক পরিবার পৈত্রিক ভিটেমাটি ও আবাদি জমি ফেলে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে এলাকার প্রায় ৮ হাজার একর আবাদি জমি বছর জুড়ে অনাবাদি থাকে।
গত ২০ বছরে সরকারি হিসাবে ৩০ থেকে ৪০ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেলেও স্থানীয় সূত্রে মৃতের সংখ্যা শতাধিক। আর পঙ্গু হয়েছে দুই শতাধিক।
সর্বশেষ গত ১০ অক্টোবর শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী শ্রীবর্দী উপজেলার বালিঝুড়ি পশ্চিম হালুয়া হাটি গ্রামে ভারতীয় বন্য হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে স্থানীয় দুই কৃষক আমিনুল ইসলাম (২৮) ঘটনাস্থলে এবং তার চাচাত ভাই একই গ্রামের সুরুজ মিয়ার ছেলে মিষ্টার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (৩০) মৃত্যুবরণ করেন।
সরেজমিন সীমান্তে গিয়ে দেখা গেছে, ভারতীয় হাতির উপদ্রপ থেকে বাঁচতে তাদের সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার বিভিন্নস্থানে তৈরি করা বিশাল গেট খুলে দিয়েছে। ভারতীয়রা সীমান্তরক্ষী বিএসএফের সহোযোগিতায় হাতিগুলোকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাড়া খেয়ে আগে থেকে খোলা রাখা সীমান্তের গেট দিয়ে হাতিগুলো বাংলাদেশে চলে আসে। সীমান্তবর্তী কৃষকের বিভিন্ন ফসল, গাছপালা এমনকি গোলার ধান পর্যন্ত খেয়ে আবার সীমান্তের ওপারে চলে যায়। এছাড়া সীমান্তের কৃষকরা তাদের ফসল বাঁচাতে হাতি তাড়াতে গিয়ে অনেকেই হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা পড়ছে। কেউ আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে পড়ছে।
জানা গেছে, জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবর্দী উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী ৩০টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার লোক বন্যহাতির ভয়ে আতঙ্কিত জীবনযাপন করছে। ওইসব এলাকার একাধিক গ্রামে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সীমান্তের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গ্রামবাসী মশাল আর ভোগা বাতি (বাঁশ ও পাট দিয়ে তৈরি মশাল) তৈরি করে রেখে দিয়েছে এবং পাহাড়ের টিলা এবং শাল-গজারি বাগানের ফাঁকে ফাঁকে আবাদি জমির ওপর ডেরা তৈরি করে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রাত জেগে পাহাড়ার ব্যবস্থা করেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত মশাল জ্বালিয়ে পাহাড়া দিচ্ছে কৃষকরা।
সীমান্তবর্তী গ্রামবাসী জানায়, ২০০০ সালের শেষ দিকে ২০-২৫টি বন্য হাতি ভারত থেকে নেমে আসে এবং সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে হামলা চালায়। এক পর্যায়ে হাতিগুলো বাংলাদেশের অনেক ভেতরে চলে আসে এবং বাড়িঘর ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে। সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, শ্রীবর্দী উপজেলার খাড়ামুড়া গ্রামের বনে ৪০-৪৫টি, ঝিনাইগাতীর গজনী বনে ৫৫-৬০টি এবং নালিতাবাড়ীর হাতিপাগাড় এলাকায় ৫০-৫৫টি হাতি অবস্থান করছে। তারা প্রায় প্রতি রাতেই সীমান্তের কোনো না কোনো গ্রামে হামলা চালিয়ে আবার ভারত সীমান্তে চলে যায়।
ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আনোয়ারুল্লাহ জানান, 'কাংশা ইউনিয়নের ১৫টি মৌজার মধ্যে ৮টি মৌজার নওকুচি, হালচাটি, গজনী, গুরুচরণ, দুধনই, তাওয়াকুচা, বাঁকাকুড়া, গান্ধিগাঁও এলাকায় কোনো কৃষক গত ১০ বছর ধরে চাষাবাদ করতে পারছে না। হাতির দল পাহাড়ি ফলমূল, কাঁঠাল, আনারস, কলা, বাঁশসহ ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র তছনছ করে দিয়ে যায়। এসব এলাকায় মানুষ এখন সম্পূর্ণ বেকার হয়ে পড়েছে। সারারাত এরা হাতি তাড়াতে ব্যস্ত থাকে। দিনে কোনো কাজ করতে পারে না। চাল কেনার পয়সা দিয়ে মশাল জ্বালানোর কেরোসিন কিনতে হয়। জংলী আলু ও কচু খেয়ে এদের জীবনধারণ করতে হচ্ছে।'
ঝিনাইগাতী উপজেলার নকশি গ্রামের লক্ষ্মী রানী জানান, 'স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যেমন পাক বাহিনীর হামলার আতঙ্কে থাকতাম ঠিক তেমনি আমরা এখন ভারতীয় বন্য হাতির হামলার ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত থাকি প্রতিদিন।' বড় গাজনির প্রতীনাশ আদিমা জানান, 'রাত জেগে হাতি তাড়িয়ে আমাদের দিনের বেলায় কাজ করতে খুব কষ্ট হয়। এ কষ্টের জীবন থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই।'
শ্রীবর্দী উপজেলার পশ্চিম খাড়ামোড়া গ্রামের রবিউল হক সীমান্তের কাঁটাতারের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন, 'ওই দেখেন, ভারত কাটাতারের বেড়া খুইলা রাখছে, ওই পাশে (ভারত সীমান্তে) ফসলের ক্ষেতে ক্ষতি শুরু করলে ভারতের বিএসএফ হাতিগুলি তাড়া করে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়। এ সময় হাতির দল রাতভর বালাদেশের ফসল সাবাড় করে আবার ওই কাঁটাতারের গেট দিয়ে ভারত চলে যায়।'
নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকার স্থানীয়রা জানান, গত এক সপ্তাহ থেকে গারো পাহাড়ের খলচন্দা, পানিহাটা, মায়াঘাশি, বারোমারি, বুরুঙ্গা, নাকুগাঁও, দাওধারা কাটাবাড়ি, সমুচ্চুড়া গ্রামে হাতির উপদ্রব শুরু হয়েছে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই হাতির পাল হামলা চালাচ্ছে আমন ধানের ক্ষেতে। এলাকাবাসী তাদের ক্ষেতের ফসল, ঘরবাড়ি ও জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী রামচন্দ্রকুড়া-ম-লিয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমান উল্লাহ বাদশা জানান, এক সপ্তাহ ধরে পাহাড়িয়া গ্রামগুলোতে ৩০-৪০টি বন্যহাতি তা-ব চালাচ্ছে। পোড়াগাঁও ইউনিয়নের খলচন্দা গ্রামের হতদরিদ্র রেখা রানী কোচ জানান, রোববার রাতে হাতির পাল তার অনেক কষ্টে আবাদ করা ২৭ কাঠা জমির থোর আসা আমন ধানের পুরোটা নষ্ট করে ফেলেছে।
একই উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহীদ উল্লাহ তালুকদার মুকুল জানান, আগে গারো পাহাড়ে বন্যহাতির প্রচুর খাবার ছিল। ভারত থেকে আসা হাতির পাল পাহাড়েই খাবার খেয়ে নীরবে চলে যেত। কিন্তু এখন বনাঞ্চলে খাবার কমে যাওয়ায় বন্যহাতির পাল ক্ষেতের ফসল ও লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। প্রথমে এর সংখ্যা ১৫-২০ এর মধ্যে থাকলেও এখন এর সংখ্যা প্রায় ১০০ তে পেঁৗছেছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা জানান, পাহাড়ি এলাকার মানুষের এখন প্রধান সমস্যা হাতি। মাঝখানে হাতির উপদ্রব কিছুটা কম ছিল। এখন আবার বেড়েছে। আপাতত মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর জন্য তেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও স্থায়ী হাতি সমস্যা সমাধানের জন্য কি করা যায়, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে।
শেরপুরের জেলা প্রশাসক মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকার বিভিন্ন গ্রামে দীর্ঘদিন থেকেই হাতির উপদ্রপ চলছে। বিভিন্ন সময়ে গ্রামবাসী হাতি তাড়াতে গিয়ে হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা পড়ছে। আবার কেউ কেউ গুরুতর আহত হচ্ছে। সেইসঙ্গে অসংখ্য ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সরকার এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে অর্থ সাহায্যসহ বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছে। গত সোমবার শ্রীবর্দী উপজেলার যে দুইজন কৃষক হাতির হামলায় নিহত হয়েছে তাদের জেলা প্রশাসনের ত্রাণ তহবিল থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে।
এছাড়া সমপ্রতি সরকার ঘোষিত বন্যপ্রাণীর হামলায় নিহত ব্যক্তিদের ১ লাখ টাকার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হবে বলে জানান তিনি।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×