আকাশে উড়বার ইচ্ছা মানুষের সেই আদিকাল থেকেই ছিল।প্রাচীন বিভিন্ন পুরাণেও মানুষের আকাশে উড়বার প্রচেষ্টার কল্পকাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্ত বিহঙ্গের মত সেও চাইত আকাশে উড়তে। আর এ থেকেই জন্ম নেয় নতুন এক স্বপ্নের; যেই স্বপ্নের ভিত্তিতে মানুষ একদিন পাড়ি দিবে মুক্ত গগনে।
আসুন একবার ফিরে দেখি কালক্রমে কিভাবে সেই স্বপ্ন বাস্তবতায় পরিনত হলঃ
(উল্লেখ্য এ পোস্টে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে তথা মহাশুন্যে মানুষের উড্ডয়ন/গমন সম্পর্কে আলোচনা নেই)
১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দঃ
Fall of Icarus
গ্রিক পুরাণে সর্বপ্রথম মানুষের আকাশে উড়বার প্রচেষ্টার কথা পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রিসে ইকারোস ছিল দাইদালোসের পুত্র এবং ইয়াপুক্সের ভাই। সে ও তার পিতা দাইদালোস যখন পিঠে মোম দিয়ে পাখা লাগিয়ে উড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন সে দাইদালোসের নির্দেশ না মেনে আকাশের খুব উচুঁ দিয়ে উড়ছিল। ফলে সূর্যের তাপে মোম গলে ইকারোসের পাখাজোড়া খসে গেল এবং সাগরে পড়ে সে ডুবে মারা গেল। দাইদালোস যখন দেখলো ইকারোস তার পেছনে নেই তখন সে বুঝল যে ইকারোস তার নির্দেশ অমান্য করেছে এবং সাগরে ডুবে মারা গেছে। পরে দাইদালোস তার পুত্রের লাশ সমাহিত করে।
ইতিহাসবিদগণ এটিকে নিছক কল্পকাহিনী হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দঃ
হিন্দুপুরাণে দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের বাহন পুষ্পক রথের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই রথটিকে হিন্দু স্কলাররা বর্তমানযুগের উড়োজাহাজের সাথে তুলনা করে থাকেন। হিন্দুপুরাণ মতে বিভিন্ন সময়ে ইন্দ্র এই রথে করে পৃথিবীতে আগমন করেছেন।
৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দঃ
চাইনিজরা ঘুড়ি আবিষ্কার করে।
৫৫৯ খ্রিস্টাব্দঃ
চাইনিজ সম্রাট ইউয়ান হুয়াংতউ শত্রুদের হাতে পরাজিত হন। তাকে একটি বিশাল ঘুড়ির সাথে বেঁধে একটি উঁচু টাওয়ারের উপর থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তিনি কাছেই ভুপাতিত হন। পরে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
৮৫২ খ্রিস্টাব্দঃ
তৎকালীন মুসলিম স্পেনের (আল-আন্দালুস) কর্ডোবা মসজিদের ছাদ থেকে আরমেন ফিরম্যান নামক এক ব্যক্তি বিশাল পাখার সাহায্যে উড়বার চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন।
৮৭৫ খ্রিস্টাব্দঃ
৬৫ বছর বয়সী আব্বাস ইবনে ফিরনাস ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সফলভাবে উড্ডয়নে সক্ষম হন। তিনি জনগনের সামনে প্রায় দশ মিনিট শুন্যে উড়তে সক্ষম হন।
আব্বাস ইবনে ফিরনাস ছিলেন বার্বার বংশদ্ভূত আন্দালুসিয় মুসলিম পলিম্যাথ বা বহুশাস্ত্রবিশারদ। তিনি ছিলেন একজন আবিষ্কারক, প্রকৌশলী, উড্ডয়ন বিশারদ, চিকিৎসক, আরবী সাহিত্যের কবি এবং আন্দালুসিয় সুরকার। তিনি আন্দালুসের ইযন-রেন্ড ওন্ডায় (বর্তমান স্পেনের রন্ডা) জন্মগ্রহণ করেন এবং কর্ডোবা আমিরাতে বসবাস করতেন। উড্ডয়নের প্রচেষ্টার জন্য তিনি সমধিক পরিচিত। চাঁদে ইবনে ফিরনাস গহ্বরটি ইবনে ফিরনাসের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
১০০৩ খ্রিস্টাব্দঃ
ইসমাইল ইবন হামাদ আল জাওহারি ইরানের নিশাপুরের একটি মসজিদের ছাদ থেকে উড্ডয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন এবং ভূপাতিত হয়ে নিহত হন।
১২৫০ খ্রিস্টাব্দঃ
ইংরেজ দার্শনিক রজার বেকন তাঁর বই Secrets of Art and Nature এ ornithopter বা উড্ডয়নযন্ত্রের কৌশলগত বিবরণ দেন।
১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দঃ
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি সর্বপ্রথম নিয়ন্ত্রণযোগ্য উড্ডয়নযন্ত্রের ডিজাইন করতে সক্ষম হন।
১৬৩০ খ্রিস্টাব্দঃ
হিজারফেন আহমেদ সেলেবি তৎকালীন অটোমান (উসমানিয়া) তুরস্কের ইস্তানবুলের গ্যালাটা টাওয়ার হতে বসফোরাস পর্যন্ত সফলভাবে উড্ডয়নে সক্ষম হন।
১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দঃ
অটোমান বিজ্ঞানী লাগারি হাসান সেলেবি তাঁর বানানো গানপাউডার চালিত রকেটে কিছুদূর উড্ডয়নে সক্ষম হন।
১৬৭০ খ্রিস্টাব্দঃ
ইতালির ফ্রান্সেস্কো লানা দে তেরযি সর্বপ্রথম উড়োজাহাজের পরিকল্পনা পেশ করেন। তিনি নিজের একটি ডিজাইনও বানান। এটিই উড্ডয়নযন্ত্র/পাখা এর ধারণা বাতিল করে উড়োজাহাজের ধারনার দিকে নিয়ে যায় মানুষকে।
১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দঃ
ফ্রান্সের মন্টগলফিয়ার ভ্রাতৃদ্বয় প্রথম এয়ার বেলুন উড়াতে সক্ষম হন।
১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দঃ
সর্বপ্রথম যুদ্ধক্ষেত্রে উড্ডয়ন বেলুনের ব্যবহার হয়।
১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দঃ
ফ্রেঞ্চ বৈমানিক আন্দ্রে জ্যাকস গারনেরিন প্রায় ৯৭৫ মিটার (৩২০০ ফুট) উচুতে থাকা বেলুন থেকে প্যারাসুটের সাহায্যে লাফ দেন এবং নিরাপদে অবতরন করেন। এটিই প্রথম সফল প্যারাসুট অবতরন।
১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দঃ
জুলিস জেন্সেন এর তোলা লা ফ্রান্স এর ছবি
ফ্রেঞ্চ অফিসার চার্লস রেনারড এবং আরথার ক্রেবস প্রথম সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণযোগ্য ফ্লাইট বেলুন তৈরি করেন। এর নাম তারা দেন লা ফ্রান্স।
১৯০৩-১৯০৪ খ্রিস্টাব্দঃ
রাইট ভ্রাতৃদ্বয়, অরভিল এবং উইলবার রাইট ছিলেন দু'জন মার্কিন প্রকৌশলী, যাদের উড়োজাহাজ আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তারা ১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রথম নিয়ন্ত্রিত, শক্তিসম্পন্ন এবং বাতাসের চাইতে ভারি সুস্থিত মানুষ-বহনযোগ্য উড়োজাহাজ তৈরি করেন। পরবর্তী দু'বছর তারা তাদের উড়ন-যন্ত্রটিকে অনড়-পাখাবিশিষ্ট উড়োজাহাজে রূপান্তরিত করেন। পরীক্ষামূলক বিমানপোত নির্মাণে সর্বপ্রথম না হলেও, তাদের আবিষ্কৃত উড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রকের সাহায্যেই প্রথম অনড়-পাখাবিশিষ্ট উড়োজাহাজ নির্মাণ সম্ভবপর হয়।
আর এভাবেই মানুষ উড়াল দিল আকাশে। আর নেই পেছন ফিরে দেখা। মুক্ত আকাশের মুক্ত বায়ুতে শুধুই সামনের দিকে এগিয়ে চলা....
আধুনিক জেট বিমান
কনকর্ড
কষ্ট করে পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ!
তথ্যসূত্রঃ Wikipedia
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:৪১