'গ্রেগর' বা' পাশের ঘর থেকে ডাকলেন বাবা। 'তোর অফিসের লোক এসেছেন। জানতে চাইছেন, তুই আজ সকালের ট্রেনে ট্যুরে বেরোসনি কেন। আমরা তাকে কি উত্তর দেব, জানিনা। তাছাড়া উনি তোর সাথে সামনাসামনি কথা বলতে চাইছেন। দরজাটা খোলনা! তোর ঘর আগোছালো দেখে লজ্জা পাবার কাছু নেই'। 'সুপ্রভাত মিষ্টার সামসা', বললেন উকিল বাবার কথার মাঝই নরম স্বরে। 'ওর শরীরটা হয়তো ভাল যাচ্ছেনা', মা বললেন উকিলকে, যখন বাবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। 'ওর শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা, বিশ্বাস করুন উকিল সাহেব। তা না হলে গ্রেগর সময়মত ট্রেনে না উঠার মতো ছেলে না। ওর মাথায় তো সারাক্ষণ শুধু কাজ আর কাজ! বিকেলে বাইরে যায় না বলে আমি নিজেই মাঝে মাঝে রাগ করি। এইতো, গত আট দিন শহরে ছিল, প্রতিটি সন্ধ্যায় বাড়ীতেই কাটিয়েছে। সে সারাক্ষন বাড়ীতে বসে পত্রিকা পড়ে আর ট্যুরের পরিকল্পনায় ব্যাস্ত থাকে। এমনকি কাঠ খোদাই এর কাজে মন বসানোও সে করে উঠতে পারে না। দুই, তিন সন্ধ্যায় কাজ করে একটি ছোট ফ্রেম বানাতে পেরেছে। তার ঘরেই ঝুলছে। দরজা খোলার সাথে সাথেই আপনি তা দেখতে পাবেন। আপনি যে এসেছেন, তাতে আমি খুব খুশী হয়েছি উকিল সাহেব। আমাদের কথায় গ্রেগর কিছুতেই দরজা খুলতো না। সে যথেষ্ট গোঁয়াড়, তারপরও আজ সকালের ব্যপারে সে নিশ্চয়ই অনুতপ্ত'।'আমি এক্ষুনি আসছি্থ অনেকটা ভেবে ভেবে আস্তে আস্তে বললো গ্রেগর। কিন্তু কোন নড়াচড়া করলো না, যাতে সবার প্রতিটি কথা পরিস্কার শুনতে পারে। 'আপনার কথাই ঠিক, মিসেস সামসা। অন্য কোন ভাবনা আমার মাথাতেও আসছে না' বললেন উকিল সাহেব। 'আশা করছি তেমন খারাপ কিছু নয়। অন্য দিক থেকে বলতে গেলে আমাকে এ কথাও বলতে হচ্ছে যে, আমাদের মতো কর্মজীবি মানুষদের ভালো বা মন্দই হোক না কেন, দ্বায়িত্বের কারণে অনেক সময়েই ছোটখাট অসুস্থতাকে ভ্রূক্ষেপ না করে এগিয়ে যেতে হয়'। 'উকিল সাহেব কি এখন ঘরে ঢুকতে পারবেন'?, অধৈর্যে বাবা আরো কয়েকবার টোকা দিলেন দরজায়। 'না', উত্তর দিল গ্রেগর। বা্থদিকের ঘরে এক বেদনাদায়ক নীরবতা এসে ভর করলো, পাশাপাশি ডানদিকের ঘরে শোনা গেল বোনের ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ।
বোন কেন সবার সাথে একই ঘরে নয়? সে হয়তো এইমাত্র জেগেছে। পোষাক আসাকও হয়তো ঠিকমতো পড়ে উঠতে পারে নি। কাঁদছে কেন সে? সে ঘুম থেকে উঠতে পারে নি, উকিল সাহেবকে ঘরে ঢুকতে দিতে পারে নি সেজন্যে? তার চাকুরী যাবে, বস বাবাকে তার পুরানো ধারদেনা নিয়ে চাপ সৃষ্টি করবে, সেজন্যে? এটা ওদের অযৌক্তিক ভয়। এখনো সে সবার মাঝেই আছে। পরিবারকে ছাড়ার কোন পরিবল্পনাই তার নেই। এই মুহুর্তে যেভাবে কার্পেটের উপর পড়ে, সেটা যদি কেউ দেখতো, তাহলে অবশ্যই উকিল সাহেবকে ঘরে ঢোকানোর দাবী করতে যেত না। অভদ্রতার অজুহাতে এখন কিছুতেই বের হওয়া ঠিক হবে না। পরে একটা সুবিধামতো উত্তর খুঁজে বের করে নিলেই হবে। আপাতত: বিরক্ত না করে বোনকে ঠান্ডা মাথায় কাঁদতে দেয়াই ভালো। তারপরও একটা নিশ্চয়তা ভর করলো।
'মি সামসা', বেশ জোর আওয়াজে এবার বললেন উকিল সাহেব। 'কি হলো? আপনি নিজেকে ঘরে বন্দী করে রাখছেন। হ্য বা না বলে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। আপনার বাবা মা কে কঠিন দূর্ভাবনার মাঝে ফেলছেন। আর সেই সাথে এ ও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এক জঘন্য প্রক্রিয়ায় আপনি আপনার কর্তব্যকে অবহেলা করছেন। আমি কঠিনভাবে আপনার বাবা মা ও আপনার বসের পক্ষ থেকে আপনার এই ব্যাবহারের কারণ দর্শানোর দাবী করছি। আমি সত্যি সত্যিই অবাক। আপনাকে একজন শান্ত ও দ্বায়ীত্বশীল মানুষ হিসেবেই জানি বলে আমার বিশ্বাস। এখন মনে হচ্ছে, আপনি আপনার অদ্ভুত মেজাজ নিয়ে আমাদের ধৈর্যশক্তি পরীক্ষা করতে চাইছেন। গত বিলটা কি কারনে জমা হয়নি, তা নিয়ে বস আজ সকালে আপনার অক্ষমতা ও ভুল নিয়ে কিছু বলেছেন আমাকে। আমি পরিস্কার ভাবে তাঁকে বলেছি যে আপনি তাতে দায়ী নন। কিন্তু এখানে এসে আপনার এই নিরর্থক গোয়ার্তুমি দেখে আপনার স্বপক্ষে একটি কথা বলার ধৈর্যও হারিয়ে ফেলছি। আপনার ব্যাবহার একেবারেই ভদ্রোচিত নয়। এই কথাগুলো আপনাকে একান্তভাবেই বলার ইচ্ছে ছিল আমার। কিন্তু যেহেতু অযথাই আপনি আমার মুল্যবান সময় নষ্ট করছেন, সেহেতু আপনার বাবা মাকে শুনিয়ে সে কথাগুলো না বলার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার গত কয়েক সাফল্যে আমরা সামান্যতমও সন্তুষ্ট নই। জানা কথা বছরের এই সময়টি ব্যাবসার জন্য খুব ভালো সময় নয়। কিন্তু বছরের এমনি একটা সময়, যেখানে কোন ব্যবসাই হবে না, তার অস্তিত্ব নেই। বুঝতে পারছেন জনাব সামসা, বছরের এমন একটি সময় থাকতে পারে না'।
'কিন্তু উকিল সাহেব', অধীর ও উত্তেজনায় বাকী সবকিছুই ভুলে গেল গ্রেগর। 'এক্ষুনি, এই মূহুর্তেই দরজা খুলছি আমি। একটি সামান্য অস্থিরতা, দুর্বলতার কারণে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি। এখনো বিছানাতেই। অনেকটা ভালো বোধ করছি। এইতো নামলাম বিছানা ছেড়ে। একটি মূহুর্ত মাত্র ধৈর্য ধরুন। যতোটা ভাল ভেবেছিলাম ততটা ভাল বেধ করছি না। তারপরেও ঠিক আছি। দেখুন, কেমন ভাবে একজন এসব সমস্যার কবলে পড়ে। গতকাল সন্ধ্যাতেও ভালো ছিলাম, আমার বাবা মা ও জানেন। সামান্য টের পাচ্ছিলাম কিছু একটা অসুস্থতার। হয়তো আগে থেকেই কিছু করা দরকার ছিল। কেন যে অফিসে জানালাম না! কিন্তু বাড়ীতে না শুয়ে থেকেও তো সুস্থ হয়ে ওঠা যায়! উকিল সাহেব। দয়া করে আমার বাবা মা কে এসবের মাঝে জড়াবেন না। যেসব অভিযোগ আপনি আমার বিরুদ্ধে আনছেন, তার কোন কারনই নেই। এ নিয়ে কেউ আমাকে কখনোই কিছু বলে নি। আমি যে শেষ চুক্তিপত্রটি পাঠিয়েছি, তা হয়তো আপনার চোখেই পড়ে নি। আজই আটটার ট্রেনে বেরিয়ে পড়ছি আমি। কয়েক ঘন্টা বাড়তি বিশ্রামে এখনই অনেকটা তরতাজা। আপনি আর অযথা আপনার মুল্যবান সময় নষ্ট করবেন না উকিল সাহেব। আমি নিজেই একটু পরে অফিসে আসছি। আপনি দয়া করে বসকে এটা বলবেন ও আমার তরফ থেকে সন্মান জানাবেন'।
যা যা বললো গ্রেগর, তার অনেকটা নিজেই বুঝতে পারলো না। বিছানার উপরে নিজের শরীরকে নড়ানো জন্যে যেসব অনুশীলন করেছিল, তারই সাহায্যে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বাক্সের দিকে। চেষ্টা করলো সেখানে ভর দিয়ে নিজেকে দাড়ঁ করানোর। সত্যি সত্যি সে দরজা খুলে নিজেকে দেখাতে চাইছিল, উকিল সাহেবের সাথে কথা বলতে চাইছিল। যারা তাকে এত ডাকাডাকি করছে, তারা তাকে এভাবে দেখে কি ভাববে, তা জানার অধীর আগ্রহ হলো তার। তারা যদি ভয় পায়, তাহলে তা তার নিজের দ্বায়িত্বের আওতায় পড়ে না। তারা যদি বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে, তাহলে তারও তাতে উত্তেজিত হবার কোন কারণ নেই। একটু দ্রুত তৈরী হতে পারলে আটটার গাড়ী সহজেই ধরা সম্ভব। নিজেকে দাড় করানোর চেষ্টায় কয়েকবারই পিছল বাক্সে পিছলে গেল তার শরীর। তারপরও একসময় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলো। শরীরের নীচের যতই ব্যাথা হলো না কেন, পাত্তা দিল না। এইভাবে একটা চেয়ারে হেলান দিতে পারলো। পা গুলো আকড়ে ধরলো চেয়ারের প্রান্ত। তাতে তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রন রাখা সম্ভবস হলো ও উকিল সাহেবের কথা শোনার জন্যে কান পেতে রইল।
'আপনারা কি তার একটি কথাও বুঝতে পেরেছেন? আমাদের বোকা বানাচ্ছে না ও?' উত্তেজিত উকিল সাহেব বাবা মা কে জিজ্ঞেস কললেন। 'অসম্ভব', কাঁদতে কাঁদতে বললেন মা। 'মনে হয় ও সত্যি সত্যিই খুব অসুস্থ, আর আমরা তাকে আরো বেশী জ্বালাতন করছি। গ্রেটে, গ্রেটেচ্! চিৎকার করে মেয়েকে ডাকলেন মা। 'মা' অন্য ঘর থেকে উত্তর দিল মেয়ে। গ্রেগরের ঘর ভেদ করেই দু্থজনের কথাবার্তা চললো। 'এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে যা। গ্রেগর অসুস্থ। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তুই কি গ্রেগরকে কথা বলতে শুনেছিস'? 'এটা পশুর গলার আওয়াজ ছিল', বললেন উকিল। মায়ের চিৎকারের তুলনায় অনেক আস্তে আস্তে। 'আনা, আনা' বসার ঘর ভেদ করে রান্নাঘরের দিকে ডাক দিলেন বাবা। 'তাড়াতাড়ি একজন চাবিওয়ালকে আন'। সাথে সাথে দুইজন বালিকা তাদের স্কার্টে ঘস ঘস শব্দ তুলে বসার ঘরে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো- বোন তার পোষাক এত তাড়াতাড়ি কি করে পড়লো? সদর দরজা খোলার শব্দ শোনা গেলেও বন্ধ করা শব্দ পাওয়া গেলনা। তারা হয়তে দরজা খোলা রেখেই গিয়েছে, কোন বাড়ীতে বড় অশুভ কোন ঘটনা ঘটলে সাধারণত: যা করা হয়।
এবার বেশ শান্ত হয়ে গেল গ্রেগর। এটা ঠিক যে, তারা তার কথা বুঝতে পারে নি। তারপরেও তারা সমস্যাটির আগের চেয়ে আরো অনেক বেশী কাছাকাছি। সে যে কঠিন কোন সমস্যার কবলে, অন্তত:পক্ষে তারা বুঝতে পেরেছে। এখন তারা তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। যে আশা ও নিশ্চয়তার সাথে প্রাথমিক পদক্ষেপগুলো নেয়া হলো, তার ভাল লাগল বেশ। মনে হলো, মানব সমাজে তাকে আবার নতুন করে গ্রহন করার জন্যে প্রস্তুত। ডাক্তার ও চাবিওয়ালার বিশদ ভুমিকা সন্মণ্ধে তেমন বিশদ কোন ভাবনা না ভেবেই তাদের অভাবনীয় ও কার্যকরী কোন সাহায্যের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপিত হলো তার ভেতরে। তাদেরকে যাতে সে তার সমস্যা খুলে বলতে পারে, সেজন্যে সে নিজেকে তৈরী করা শুরু করলো। একটু কেশে গলার আওয়াজ পরিস্কার করার চেষ্টা করলো। কাশির আওয়াজও সে যথাসম্ভব চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করলো। সম্ভবতো তার নিজের কাছেও সে আওয়াজ মানুষের মতো না হয়ে হল না। পাশের ঘরে তখন নি:স্তব্ধ নীরবতা। হয়তো উকিল সাহেবকে নিয়ে বাবা মা টেবিলে বসে ফিসফিস করে এ নিয়েই আলাপ করছেন। এমনও হতে পারে, তারা সবাই তার দরজায় কার পেতে আছেন।
আসমাপ্ত.....
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০০৬ ভোর ৫:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



