দরজা খেলার কসরত নিয়ে ব্যস্ত থাকায়, টেরই পায়নি গ্রেগর যে, চাবি ঘোরানোর পরপরই দরজার একটি পাল্লা খুলে আছে অনেকটা। সে নিজেই পাল্লাটির আড়ালে পড়ে গিয়েছিল। সে পাল্লার সাথে তাকে নিজেকেও ঘুরতে হবে। সে সাথে সাবধানও থাকতে হবে যাতে বাইরের কারো ধাক্কায় সে নিজেই চীৎ হয়ে মাটিতে পড়ে না যায়। নিজের নড়াচড়ায় সে এতই মনযোগী, অন্যরা কি করছে, সেদিকে নজরই রাখতে পারে নি। সে মুহুর্তে 'ওফ!' শব্দ উকিল সাহেবের মুখ ফুড়ে ঝড়ের মতো বেরিয়ে এল। দরজার সবচেয়ে কাছাকাছি থাকায় তিনিই সবার আগে গ্রেগরকে দেখতে পেলেন। বিষ্ময়ে হাঁ হওয়া মুখের সামনে হাতটি ধরে ধীরে ধীরে সরে গেলেন পেছনের দিকে। মনে হলো কোন এক অদৃশ্য শক্তি কোন এক অজানা আকর্ষনে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মা সারারাতের উস্কোখুস্কো চুলে এতোক্ষন উকিল সাহেবকেই সঙ্গ দিচ্ছিলেন। জোর হাতে ভোতা দৃষ্টিতে বাবার দিকে একবার তাকিয়েই দুই পা এগুলেন গ্রেগরের দিকে। তারপর সবার মাঝখানে স্কার্টটি ছড়িয়ে এলিয়ে পড়লেন মাটিতে। মাথাটি অবশ হয়ে ঝুলে রইলো বুকের উপর। বাবা কোন এক অদৃশ্য শত্রুকে হাত তুলে গালাগাল করলেন। মনে হলো গ্রেগরকে ঠেলে আবার ঘরের ভেতরই পাঠিয়ে দিতে চাইছেন। বসার ঘরে থেকেই অচেনা, সন্ত্রষ্ট দৃষ্টিতে ইতস্তত: চোখ ফেললেন, তারপর দুই হাতে চোখ ঢেকে ভেঙ্গে পড়লেন কান্নায়। কান্নার দমকে তার প্রশস্ত বুক কেঁপে উঠলো বারবার।
গ্রেগর বসার ঘরে টোকার চেষ্টা করলো না। বরং দরজার পাল্লার ভেতরের দিকেই হেলান দিয়ে পড়ে রইল। তার অর্ধেক শরীর ও হেলানো মাথা পাল্লাটির প্রান্তে বেরিয়ে রইল। সাবধানী, হতচকিত, ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সবার দিকে। ততক্ষনে বাইরের পৃথিবী অনেকটা ফর্সা হয়ে উঠেছে। রাস্তার উল্টোদিকের হাসপাতালের একটি অংশ, ধুসর কালো সীমাহীন দেয়ালের পরিধি, একটার পর একটা সাজানো অগুনতি জানালা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। অঝোর ঝারায় ঝড়ছে বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটা আরো বেশী বড় হয়ে, আরো বেশী শক্তিতে মাটির বুকে আছড়ে পড়লো। বাবার জন্যে নাস্তার সময়টি প্রতিদিনের আহারের সবচেয়ে পছন্দনীয় সময়। এ সময়টায় তিনি টেবিলে বসে পত্রিকা ও বিভিন্ন বই পড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে অভ্যস্ত। আজ নাস্তার সব সরন্জাম স্তুপিকৃত হয়ে জমে থাকলো টেবিলে। উল্টোদিকের দেয়ালে গ্রেগরের একটি ছবি। সেনাবাহিনীতে যখন ছিল, সে সময়ের তোলা। লেফটেটেন্ট এর পোষাক পড়া ও তলোয়ার হাতে, মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি ছড়ানো। পোষাক ও চেহারার ভাবে নিজের প্রতি সন্মানের দাবী। বসার ঘরের দরজাটি খোলা, বাইরের দরজাও খোলা। এর ভেতর দিয়ে চোখে পড়ছে বাইরের বারান্দা ও নীচে নামার সিড়ির প্রথম অংশ।
একমাত্র গ্রেগরই নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো। 'এক্ষুনি কাপড় চোপড় পড়ে তৈরী হচ্ছি। সবাই রাজী হলে স্যাম্পলগুলো বাকসে ঢুকিয়ে এই মূহুর্তেই বেরুচ্ছি আমি। দেখুন উকিল সাহেব, আমি গোয়াড় বা কর্মবিমুখ নই। জীবিকার জন্যে ঘুরে বেড়ানো সহজ নয়। কিন্তু এছাড়া আমার পক্ষে টিকে থাকাও অসম্ভব। অফিসে ফিরে যাচ্ছেন উকিল সাহেব! যান! যা দেখলেন, তার যথাযথ বর্নণাই দেবেন। এ মূহুর্তে আমি সত্যিই কাজের অযোগ্য। তাই এটাই সঠিক সময়, আমার আগের সাফল্য গুলো সামনে টেনে আনা। এখনকার সমস্যাগুলোর মোকাবিলা আমি করবো। তারপর আগের মতোই কর্মস্পৃহা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়বো কাজে। আপনি জানেন বসের প্রতি আমার বিশাল দ্বায়িত্বের কথা। অন্যদিকে আমার বাবা মা ও বোনকে নিয়ে আমার যথেষ্ট চিন্তা রয়েছে। এই মূহুর্তে গর্তে পড়েছি, আবার বেরিয়েও আসবো। দেখতে পাচ্ছেন, আমার অবস্থা ভাল নয়। দয়া করে সে অবস্থাকে আরো কঠিন করে তুলবেন না। দয়া করে আমার দিকে চোখ রাখুন। কাজের জন্যে যারা শহর বন্দরে ঘোরে, তাদেরকে কেউ পছন্দ করে না জানি। সবাই ভাবে, তাদের বিশাল আয় ও বিলাসবহুল জীবন। এই ভুল ধারণা দুর করার চেষ্টা কেউই করে না। কিন্তু উকিল সাহেব, আপনি নিশ্চয়ই অনেক কিছু অন্যদের চেয়ে সুক্ষভাবে দেখার ক্ষমতা রাখেন। গোপনেই বলছি, আমাদের বসের চেয়েও বোঝার ক্ষমতা আপনার বেশী। ওনি মালিক হিসেবে খুব সহজেই অনেক কর্মচারীর বিপক্ষে মতামত প্রদান করতে পারেন। আপনি ভাল করেই জানেন, ট্যুরের জন্যে প্রায়শ:ই সারাটি বছর শহরের বাইরে থাকতে হয় আমাদের। আমাদেরকে অতি সহজেই যে কোন ধরণের পরনিন্দা, পরচর্চা ও ক্ষমার অযোগ্য অভিযোগের শিকার হতে হয়। যেহেতু এসব রটণার খবর আমাদের কাছে ভালোভাবে পৌঁছাতেই পারে না, এর উত্তরও দেয়া হয়না সবসময়। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে যখন বাড়ী ফিরি, তখন অকারণেই এসব রটণার প্রভাবে জর্জরিত হতে হয়। চলে যাবেন না উকিল সাহেব! সামান্য হলেও যে আমার কথা বুঝতে পেরেছেন, সে কথা অন্তত স্বীকার করে যান'!
কিন্তু গ্রেগরের বক্তব্যের শুরুতেই উল্টোদিকে ঘুরে গেলেন উকিল সাহেব। তারপর আবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে কম্পিত ঠেঁটে চোখ ফিরিয়ে ওর দিকেই তাকালেন। যতক্ষন কথা বলছিল সে, ততক্ষন এক মূহুর্তও স্থির হয়ে দাঁড়ালেন না। বরং খুব আস্তে আস্তে, মনে হলো কোন এক বিশাল বাধা যেন তাকে অতিক্রম করতে হচ্ছে, সেভাবেই গ্রেগরের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর আচমকা, বসার ঘরের দরজার বাইরে এমনভাবে পা ফেললেন, মনে হলো তার জুতোর তলায় আগুন লাগিয়েছে কেউ। সেখান থেকে বারান্দা পেরিয়ে যেভাবে দু্থহাত সামনে বাড়িয়ে যেভাবে এগিয়ে গেলেন সিড়ির দিকে, মনে হলো ওখানেই তার জন্যে অপেক্ষা করছে এক অলৌকিক মুক্তি।
উকিল সাহেবকে এভাবে যেতে দেয়া কিছুতেই যে ঠিক হচ্ছে না, তা ভাবলো গ্রেগর। তাতে তার কর্মজীবনে বিপদের শঙ্কা আরো বেশী ঘনিভূতই হবে। বাবা মায়ের এতোকিছু ভাবার অবকাশ হলো না। বহু বছরের অভিজ্ঞতায় তারা ধরেই নিয়েছেন, গ্রেগরের এই চাকুরি তার সারা জীবনের জন্যেই স্থায়ী। তাছাড়া এ মূহুর্তের সমস্যা, তাদের সবরকম চিন্তাশক্তির সীমার বাইরের, এই ঘটনা নিয়েই ভাবনা সবচেয়ে বেশী। কিন্তু গ্রেগরের বিশ্বাস তখনও নষ্ট হয়নি। উকিল সাহেবকে এক্ষুনি থামাতে ও বোঝাতে হবে! টেনে আনতে হবে স্বপক্ষে! গ্রেগর ও তার পরিবারের ভবিষ্যত তো এরই উপর নিদারুণভাবে নির্ভর করেছে! বোনটি এখানে থাকলে ভাল হতো! সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতি। অনেক কেঁদেছে, যখন গ্রেগর মেঝের উপর চীৎ হয়ে পড়ে ছিল। জানা কথা, মেয়েপাগল এই উকিলকে সে থামাতে পারতো। বাইরের দরজা বন্ধ করে বসার ঘরে উকিল সাহেবের সাথে কথা বলে তার ভয় দুর করতে পারতো। কিন্তু এখন সে তো ঘরে নেই! নিজেকেই যা কিছু করার করতে হবে। তার বক্তব্য উকিল কতটুকু বুঝলেন বা একেবারেই বোঝেন নি, তার নিজের চলার কতটুকু ক্ষমতা আছে বা নেই, এসব না ভেবেই সে দরজার পাল্লা থেকে সরে এলো। উকিল সাহেবের দিকে এগিয়ে যাবার জন্যে দুই পাল্লার ফাঁকে নিজেকে ঢুকিয়ে দিল। উকিল তখনো হাস্যকর মূর্তিতে বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে। ছেট্ট এক চিৎকারে নিজের ছোট ছোট পায়ের উপর ভর করে মেঝেতে পড়লো গ্রেগর। পড়ার পরেই প্রথমবারের মতো শারিরীক স্বস্তি টের পেল নিজের ভেতরে। পা গুলো মাটি ফিরে পেল ও সেসাথে গ্রেগর ফিরে পেল সেগুলো নিযন্ত্রণের ক্ষমতা। সে আরো খুশী হলো, যখন দেখল, যেখানে যেতে চাইছে, পাগুলো তাকে সেখানেই নিয়ে যেতে পারছে। মূহুর্তেই বিশ্বাস করলো সে, তার সমস্ত যন্ত্রণার সমাধান আর দূরে নয়। অপরিচিত হেলেদুলে হাঁটার অভ্যাসে বেশীদুর এগুতেও পারে নি, মা তখনো তার কাছাকাছিই অসাঢ় হয়ে পড়ে আছেন। ঠিক সেই মূহুর্তেই তিনি উপরের দিকে হাত তুলে লাফিয়ে উঠেই চিৎকার করে উঠলেন, 'সাহায্য কর!, ঈশ্বরের দোহাই লাগে, সাহায্য কর কেউ'! মাথাটি নীচের দিকে, গ্রেগরের দিকে ফেরানো, মনে হলো ভাল করে দেখতে চাইছেন ওকে। কিন্তু উদ্দেশ্যহীনভাবে সরে গেলেন পেছনের দিকে, দেখলেন না তার পেছনে নাস্তার টেবিলটি। কাছাকাছি এসেই কোন এক অজানা ঘোরে বসে পড়লেন টেবিলের উপর। টেরও পেলেন না যে নাস্তার সমস্ত তৈজসপত্র, কফির কাপ, বড় জগ ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। ঢক ঢক করে জগ থেকে কফি বেরিয়ে ভিজিয়ে দিল কার্পেট।
অসমাপ্ত.....
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



