'মা, মা', আস্তে আস্তে বলে উপরে তাঁর দিকে তাকালো গ্রেগর। এ মূহুর্তে ঊকিলকে নিয়ে কোন ভাবনা নেই তার। একদিকে ঢক ঢক করে কফি ছড়াচ্ছে মেঝেতে, সেদিকে নজর রেখে চোয়াল উচিয়ে শুন্যে কামড় দিল বারবার। এ দেখে মা আবার নতুন করে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। টেবিল ছেড়ে পালিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন বাবার বুকের উপর। এখন আর বাবা মায়ের জন্যেও কোন সময় নেই তার। । উকিল এখনও সিড়িতে। রেলিংএর উপর থুতনী রেখে শেষবারের জন্যে একবার পেছন ফিরে তাকালেন। গ্রেগর তার শেষ ক্ষমতা নিয়ে চেষ্টা করলো তার কাছে পৌঁছানোর। উকিল সাহেব হয়তো তা টের পেয়ে থাকতে পারেন, এক লাফে বেশ কয়েকটা সিড়ি পার হয়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ী ছেড়ে। 'হুহ্' আওয়াজে তার বিকট চিৎকার সিড়িঘরে প্রতিধ্বনিত শোনা গেল। বাবা এতক্ষন চুপচাপই ছিলেন। কিন্তু উকিলের এ ধরণের বিদায়ে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। তিনি উকিল সাহেবকে থামানোর তো কোন চেষ্টাই করলেন না এমনকি গ্রেগরকেও তাঁকে অনুসরণের চেষ্টায় বাঁধা না দিয়ে থাকতে পারলেন না। উকিল তার টুপি ও লাঠি সোফায় ফেলে গিয়েছিলেন। ডান হাতে সে লাঠি ও বা হাতে টেবিলের উপর থেকে একটি বড় পত্রিকা নিয়ে এগিয়ে এলেন তিনি। লাঠি নাড়িয়ে নাড়িয়ে তিনি গ্রেগরকে আবার তার ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করলেন। গ্রেগরের কোন অনুরোধ কাজে এলোনা, কোন কাকুতি মিনতি বুঝলেন না বাবা। সে যতোই মাথা কাৎ করে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো, বাবা ততো বেশী শক্তিতে তাকে পায়ে ঠেলে দিলেন। মা এই দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারলেন না। এই শীতের সময়ে জানালা পুরোটা খুলে মাথা অনেকটা বাইরে নিয়ে দুই হাতে মুখ ঢাকলেন। গলি ও সিড়িঘরের মাঝ বেয়ে দমকা বাতাস বইল। জানালার পর্দাগুলো এলোমেলো উড়তে শুরু করলো। টেবিল থেকে পত্রিকার পাতাগুলো সর সর করে আওয়াজ করলো, কিছু কিছু ছড়িয়ে পড়লো মাটিতে। উম্মত্তের মতো হিস হিস আওয়াজ করে তাকে ধাক্কা দিতে থাকলেন বাবা। দ্রুত চলতে পারলো না গ্রেগর, কারণ পেছন দিকে চলার কোন অনুশীলন তখনো সে করেনি। যদি ঘুরতে পারতো, তাহলে তাড়াতাড়িই পৌঁছে যেত নিজের ঘরে। কিন্তু বাবার অধৈর্যের সামনে দাড়িয়ে সময়সাপেক্ষ প্রচেষ্টা শুরু করার সাহস পেল না। প্রতিমূহুর্তেই বাবার হাতের লাঠির মারাত্মক আঘাত তার পিঠে বা মাথায় পড়বে, এই ভয়ে শঙ্কিত হয়ে রইল। একসময় ভয়ে অধীর হয়ে দেখলো গ্রেগর, পেছনে চলায় সে সঠিক দিক ঠিক রাখতে পারছে না। ভয়কাতর চোখে কাৎ হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে তার পক্ষে যতোটা দ্রুত সম্ভব ঘোরার চেষ্টা করলো। যদিও বাইরের চোখে তার এই ঘোরার প্রচেষ্টা একেবারেই ধীরগাতির, বাবা তার এই সদিচ্ছা টের পেলেন। এবার তার উপর চাপ সৃষ্টি না করে লাঠির ডগার খোঁচায় তাকে আস্তে আস্তে ঘুরতে সাহায্য করলেন। বাবার এই হিস হিস আওয়াজ অসহ্য লাগলো। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটু বেশী ঘুরে আবার ফিরেই আসছিল প্রায়। তারপর আবার উল্টোদিকে ঘুরে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু দরজা যতটুকো খোলা, তা থেকে গ্রেগরের শরীর আরো বেশী চওড়া। বাবা তার উত্তেজনা নিয়ে দরজার আরেকটি পাল্লা খেলার চেষ্টাও করলেন না, যাতে গ্রেগর সহজে ঢুকতে পারে। তার মাথায় উম্মত্ব চিন্তা যতো দ্রুত সম্ভব গ্রেগরকে ঘরে ঢোকানো। এই ফাঁকটুকু ভেদ করে ভেতরে ঢোকার জন্যে একটু সোজা হয়ে ওঠা ও তার জন্যে যতটুকু সময় এ প্রস্তুতি দরকার, বাবা তাকে তা দেওয়ায় একেবারেই প্রস্তুত নন। বরং তিনি গ্রেগরের সামনে কোন রকম বাধার কথা না ভেবে অদ্ভুত স্বরে চিৎকার করে ঠেলে তাকে ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টায় উন্মত্তপ্রায়। এই চিৎকার কোন বাবার আওয়াজের মতো মনে হলোনা, সুতরাং সেও প্রণপনে দরজার এক পাল্লার দিয়েই এগিয়ে গেল। তার শরীর একপাশে কাত হয়ে গেলো, একপাশ ক্ষতবিক্ষিত হলো খুব। সাদা দরজায় নোংরা দাগ হয়ে গেল। একসময় দরজার ফাঁকে আটকে গেল সে, নিজের শক্তিতে এগুনোর আর ক্ষমতা রইল না। একপাশের পা গুলো শুন্যে কাঁপতে থাকলো, অন্যদিকের গুলো ব্যাথা যন্ত্রণায় মেঝের সাথে দুমড়ে। একসময় বাবা সত্যিকারের মুক্তির ধাক্কা দিলেন। সে প্রায় উড়ে রক্তাক্ত শরীরে তার ঘরের ভেতর গিয়ে পড়লো। লাঠির ধাক্কায় দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। তারপর অবশেষে শান্ত হলো সব।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



