এই ক্ষতের প্রভাবে গ্রেগর তার চলৎশক্তি খুব সম্ভবতো চারদিনের জন্যেই হারিয়ে ফেলেছ। আপাতত: ঘরের একপাশ থেকে ওপাশে যেতেই এক অর্থব বৃদ্ধের মতো বেশ কয়েক মিনিট সময় নেয়। দেয়াল বেয়ে উঠার কথা তো কল্পনাই করা যায় না। তার এই কঠিন অবস্থার বিনিময়ে তাকে যা দেয়া হলো, তা নিয়ে মনে মনে সন্তুষ্টই সে। প্রতি সন্ধ্যাতেই বসার ঘরের দরজাটি খুলে দেয়া হতো ও সেজন্যে তার দু্থঘন্টা আগে থেকেই অধীর অপেক্ষা তার। পরিবারের সবাই টেবিলে বসে আলোচনায় বাতির আলোয়, আর সে অন্ধকারে আড়ালে থেকে দেখছে সবাইকে। আগের মতো লুকিয়ে লুকিয়ো শোনা নয়, বরং সবার অনুমতিসাপেক্ষেই।
জানা কথা এ আলোচনা আগের মতো প্রানবত্ত নয়। আগে সারাদিনের কাজের ক্লান্তি শেষে ছোট হোটেলে বিছানায় পড়ে এ আলোচনার কথা ভেবে মন খারাপ করতো। এখনকাল পরিবেশ সে তুলনায় একেবারেই শীতল। বাবা রাতের খাবারের পর ঘুমিয়ে পড়তেন সোফাতেই, মা ও বোনের আলাপ চলতো মৃদুস্বরে। বাতির নীচে উবু হয়ে সেলাইএর কাজ করতেন মা। কোন এক হাল ফ্যাসানের দোকানের জন্যে অন্তর্বাসের সুক্ষ কারুকার্য। আর বোন বিক্রতার কাজ নিয়েছে কোথাও। সেইসাথে বাড়ীতে সন্ধ্যাবেলায় ষ্টেনোগ্রাফি আর ফরাসী ভাষা শিখছে, যাতে পরে ভালো কোন কাজ পেতে পারে। মাঝে মাঝে ঘুম থেকে জেগে উঠতেন বাবা, কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, কিছুতেই স্বীকার করতে চাইতেন না। মা কে বলতেন,্থআর কতো সেলাই করবে আজ্থ! পরমূহুর্তেই মা আর বোনের ক্লান্ত মৃদু হাসির দৃষ্টিবিনিময়ের মাঝেই আবার ঘুমিয়ে পড়তেন।
কোন এক নিরর্থক জেদের বশে বাবা বাড়ীতেও তার কাজের পোষাক ছাড়তে চাইতেন না। ঘুমোনোর পড়ার পোষাক অযথাই হ্যঙ্গারে ঝুলছে, বাবা কাজের পোষাকেই তার সোফায় বসে ঝিমোতেন। মনে হতো তিনি তার কাজের জন্যে সর্বদাই তৈবী ও প্রতিমূহুর্তেই তাঁর বস এর ডাকের অপেক্ষায় অছেন। এ কারণে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি মা ও বোনের বিশেষ সাবধানতার পরও সে পোষাক আর পরিস্কার রইল না। গ্রগর প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই চকচকে বোতামের নোংরা দাগে অপরিস্কার একটি পোষাক দেখতে পেত, যার পড়ে এক বৃদ্ধ আরামদায়ক না হলেও গভীর ঘুমে নিমগ্ন।
রাত দশটার আওয়াজ হতে হতেই মা আস্তে আস্তে কথা বলে বাবাকে জাগানোর চেষ্টা করে নানাভাবে বিছানায় নেবার চেষ্টা করতেন। সকাল ছ্থটায় তাঁর কাজে হাজির হতে হবে ও এক্ষেত্রে সোফার কষ্টদায়ক ঘুমের চেয়ে বিছানায় ভাল ঘুমোনো তার জন্যে খুবই জরুরী। কিন্তু অর্থহীন এই জেদ, যা বাবার নিজের বশে নয়, বরং বাবাই তার বশে। তার প্রভাবেই তিনি আরো অনেকক্ষন টেবিলে থাকতে চাইতেন, যদিও ঘুমিয়েই কাটাতেন বেশীভাগ সময়েই। সোফা থেকে বিছানায় নেয়াও এক মহা সমস্যা। মা ও বোনের বারবার পীড়েপিড়ির পর পনেরো মিনিট ধরে সোফায় বসেই ধীরে ধীরে মাথা ঝাকাতেন। চোখ বন্ধ থাকতো ও সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেন না। মা সার্টের আস্তিন ধরে টান দিয়ে কানে কানে নরম নরম কথা বলতেন, বোন তার নিজের কাজ রেখে সাহায্য করতে যেতো মাকে। কিন্তু বাবা এসবে কোন খেয়ালই থাকতো না। আরো বেশী যেন ডুবে যেতেন সোফায়। একসময় যখন দু্থজন দু্থবাহু ধরে টানতেন, চোখ খুলতেন তিনি। একবার মায়ের দিকে, একবার বোনের দিকে তাকাতেন, বলতেন 'এটাই জীবন, এ ই আমার শেষ বয়েসের শান্তি'। তারপর দু্থজনের কাঁধে ভর করে এমন কষ্টে দাঁড়াতেন, মনে হতো তার শরীরটাই যেন তার বড় এক বোঝা। দু'জনের সাহায্যে দরজা অবধি গিয়ে হাত নেড়ে একা একাই যেতেন তাঁর শোবার ঘরে। মা ফিরে আসতেন তাঁর সেলাইএর উপকরণ গোছনোর জন্যে আর বোন তার খাতাকলম। গুছিয়ে দু্থজনেই ছুটতেন বাবার পেছনে, যাতে তাঁকে আরো কোন সাহায্য করা যায়।
এই কর্মব্যাস্ত ও ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছানো পরিবারের কার এত সময় গ্রগরের দিকে প্রয়োজনের বেশী নজর রাখার? সংসারের খরচপত্র যতটা সম্ভব কমানো হলো। কাজের মেয়েকেও বিদায় করা হলো। শুধুমাত্র ভারী কাজে সাহায্য করার জন্যে এক লম্বা, হাড্ডিসর্বস্ব, উসকো খুসকো সাদা চুলের মহিলাকে রাখা হলো। বাকী সব কাজ মা ই করতেন তাঁর সেলাইএর কাজের পাশাপাশি। এমনকি কিছু গহনাপত্র বিক্রি করা হলো, যা মা ও বোন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খুব আনন্দের সাথে পড়ে যেতো। প্রতি সন্ধ্যাবেলার আলাপ আলোচনায় গ্রেগর বিক্রির দামও জানতে পেল। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই আর্থিক দুরবস্থায় এই বড়ো বাড়ীটি পাল্টানো জরুরী হলেও করা সম্ভব হচ্ছেনা গ্রেগরের কারণেই। ওকে এক বাড়ী থেকে আরেক সরানো কিভাবে সম্ভব, তা ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারে নি কেউ। কিন্তু একমাত্র তার প্রতি নজর রেখেই যে এটা করা হচ্ছেনা, এটাও ঠিক নয়। একটি বাক্সে কয়েকটি ছিদ্র রেখে সহজেই সরানো যায় তাকে। আসল কারণ হচ্ছে নিদারুন হতাশা ও এ থেকে সৃষ্ট দুর্ভাবনা। এই পরিবারটি এমন এক দুর্যোগে পতিত হয়েছে, যা আত্মীয় ও পরিচিতজনদের কখনোই হয়নি। পৃথিবী দরিদ্র মানুষদের কাছ থেকে যা চাইতে পারে, তা প্রতিটিই পুরোপুরিভাবে পালন করা হচ্ছে। বাবা ছোট এক ব্যাংক কর্মচারীর জন্যে সকালের নাস্তা নিয়ে যেতেন। মা অপরিচিত মানুষের জন্যে পোষাক সেলাই করতেন। বোন ক্রেতাদের আদেশ পালন করার জন্যে ডেস্কের পেছনে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতো। এর বেশী করার শক্তি আর এই পরিবারের ছিলনা। গ্রেগরের পিঠের যন্ত্রনা শুরু হতো নুতন করে, যখন মা আর বোন বাবাকে বিছানায় রেখে আবার ফিরে আসতো বসার ঘরে। নিজেদের কাজ রেখে একজন আরেকজনকে ধরে গালে গাল লাগিয়ে বসে ডুবে থাকতো বিমর্ষতায়। একসময় মা গ্রেটেকে গ্রেগরের ঘরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলতেন,'দরজাটি বন্ধ করে দে মা'। আবার অন্ধকারে গ্রেগর, আর ওদিকে মা আর মেয়ের অশ্রুতে মাখামাখি বা শুন্য দৃষ্টিতে টেবিলের দিকে চেয়ে থাকা।
দিনে ও রাতে গ্রেগর প্রায় না ঘুমিয়েই কাটাতো। মাঝে মাঝে ভাবতো, পরের বার দরজা খুললেই পরিবারের সমস্ত দ্বায়িত্ব আর আগের মতোই বহন করবে। অনেকদিন আবার তার বস ও উকিল সাহেব, কলিগ ও শিক্ষানবিস, এলো তার ভাবনার বিস্তারে। সেই সাথে আরো অনেকে। তাদের পাহাড়াদার, অন্য এক অফিসের আরো দু'জন বন্ধু, মফস্বল শহরের এক হোটেলে এক রুম পরিস্কার করার মেয়েটি। একটা দু'টো আবছা ভালো লাগার স্মৃতি, এক টুপির দোকানের ক্যাশের মেয়েটির কথা। ভালো লেগেছিল তার। সে কথা দৃঢ় ভাবে বললেও বেশ দেরীতেই বলা হয়েছিল। তাদের সবার কথা তার মনে এলো, আরো অনেক পরিচিত, অপরিচিত ও ভুলে যাওয়া জনের সাথে মিলেমিশে। তবে তার ও তার পরিবারের সমস্যার কাছাকাছি ওরা নয় ও ওদেরকে চিন্তা থেকে দুরে সরাতে পারলেই খুশী হতো গ্রেগর। পরমূহুর্তেই আবার পরিবারকে নিয়ে ভাবার মেজাজ আর ওর থাকতো না। নিজের অবমূল্যায়নে ক্রোধ জমতো নিজের ভেতরে। নিজের খেতে কি ভাল লাগে বা না লাগে তা ভাল করে না জেনেই মাঝে মাঝে খাবার ঘরে যাবার পরিকল্পনা করতো। ক্ষিদে থাকুক বা না থাকুক, সবই নিয়ে নিত। গ্রেগরের ভাল লাগুক বা না লাগুক তা নিয়ে কোন ভাবনা না করেই বোন সকালে ও দুপুরে যে কোন খাবার পায়ে ঠেলে দ্রুত ঘরে ঢুকিয়ে দিত। সন্ধ্যায় সে খাবার খাওয়া হল কি না হল তা না দেখেই ঝাড় দিয়ে ঘরের বাইরে নিয়ে যেত। যতো দ্রুত সম্ভব, ততো দ্রুত একবারই সন্ধ্যায় পরিস্কার করতো ঘর। দেয়াল বেয়ে নোংরা দাগ জমলো, ধুলো ও আবর্জনা জমে থাকতো এদিক সেদিক। প্রথম দিকে অভিযোগ জানানোর উদ্দেশ্যে বোন ঘরে ঢোকার আগের মূহুর্তে এই বিশেষ স্থানগুলোতেই পড়ে থাকতো গ্রেগর। কিন্তু পরে টের পেলো, একসপ্তাহ পড়ে থাকলেও তা পরিস্কার করবে না বোন। বোন হয়তে ময়লাগুলো এ ঘরে রাখারই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। অথচ এটা ধরেই বসে বোন, এমনকি পুরো পরিবারই, এ ঘর পরিস্কার করার একচ্ছত্র অধিকার একমাত্র তারই হাতে। একবার মা খুব ভালো করে পরিস্কার করলেন। কয়েক বালতি পানিতেই তা ভাল করে করা সম্ভব হলো। তাতে অতিরিক্ত আদ্রতায় গ্রেগরের বেশ অসুবিধাই হলো। বিরক্তিতে পড়ে রইল সোফার উপর নিশ্চল হয়ে। কিন্তু তাতেও ক্ষমা পেলেন না মা। সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরের গ্রেগরের ঘরের পরিবর্তন টের পেয়ে ভীষন অপমানিত বোধ করে বসার ঘরে ছুটলো। মা বারবার হাত তুলে শান্ত করার চেষটা করলেও কান্নাকাটি শুরু করলো। বাবা সোফায় ভয় পেয়ে গেলেন। প্রথমে অবাক হয়ে বোকার মতো এদিক ওদিক তাকালেন। একদিকে মায়ের বিরুদ্ধে বাবার অভিযোগ, অন্যদিকে বোনের চিৎকার, মা যেন আর কোনদিন গ্রেগরের ঘরে হাত না দেন। বাবা উত্তেজনায় আর থাকতে পারলেন না বসার ঘরে, শোবার ঘরে ছুটলেন। বোন দমকে কেঁদে কেঁদে টেবিলে কিল ঘুষি দিতে থাকলো। গ্রেগরের রাগ হলো একথা ভেবে যে, দরজাটি বন্ধ করে তাকে এই দৃশ্য আর শোরগোল থেকে মুক্তি দেবার কথা কেউ একবারও ভাবলো না।
কিন্তু কাজের চাপে বিরক্ত ও ক্লান্ত বোন যদি আগের মতো গ্রেগরকে দেখাশোনা করতো, তাহলে মা কে কিছুতেই তাকে সাহায্য করতে হতো না। গ্রেগরকেও অবহেলা করা হতো না। একবার হাজির হলো কাজের মহিলাটি। এই বৃদ্ধা বিধবা তার দীর্ঘ জীবন ও শক্ত শারিরীক কাঠামোর জোরেই অনেক কঠিন সময় অতিক্রম করেছেন। গ্রেগরের প্রতিও তার সত্যিকারের কোন ভয় ও ঘৃণা হলো না। কোন কৌতুহলের বশে নয়, কোন এক আকস্মিকতায় ওর ঘরের দরজা খোলেই গ্রেগরকে দেখে ভীষন অবাক হয়ে যান। তারপরও তাকে তাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে না দেখে হাতে হাত বেঁধে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন। তারপর থেকে তিনি প্রতিদিনই সকালে ও সন্ধ্যায় দরজাটি সামান্য ফাঁক করে গ্রেগরকে দেখতে আসা শুরু করলেন। প্রথম দিকে তিনি ওকে নিজের কাছে যে ভাষায় ডাকতেন, তার নিজের কাছে তা হয়তো বন্ধুত্বসুলভ বলেই মনে হতো। 'আয়, আয়, এদিকে আয় গুবরে পোক' বা 'দেখ, দেখ, গুবরে পোকা দেখ'! এধরণের ডাকাডাকির উত্তরে কোন সাড়া দিত না গ্রেগর, বরং নিজের জায়গাতেই পড়ে থাকতো। এই মহিলাকে যদি তাকে অপ্রয়োজনীয় ব্যাবহারে বিরক্ত করার বদলে প্রতিদিন তার ঘর পরিস্কার আদেশ দেয়া হতো, তাহলে কতো ভাল হতো! একদিন ঝড়ো বৃষ্টির ছাট আছড়ে পড়ছিল জানালায়, হয়তো নতুন বছেরর আগমনী চিহ্ন। মহিলা এসে তাকে ডাকাডাকি শুরু করলন। এতো বিরক্ত হলো গ্রেগর যে, আক্রমনাত্বক ভঙ্গীতে ঘুরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মহিলাটির দিকে। মহিলাটি ভয় পেয়ে পালালেন না। বরং দরজার কাছে রাখা একটি চেয়ার দু্থহাতে তুলে মুখ হা করে এমনভাবে দাঁড়ালেন যে, গ্রেগরের পিঠে চেয়ারটি মেরেই মুখটি বন্ধ করবেন। 'না, এর বেশী আর এগোনো যাচ্ছে না বুঝি'? প্রশ্ন করলেন। গ্রেগর উল্টোদিকে ফেরার পর আবার চেয়ারটি দরজার কোনে ফেরৎ রাখলেন।
অসমাপ্ত ....
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



