'এখন আবার ফেরার চেষ্টা করতে পারি', ভাবলো গ্রেগর ও তার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হলো আবার। পরিশ্রমের কারণে সে তার ফোঁস ফোঁস নি:শ্বাসকে চেপে রাখতে পারছিল না। মাঝে মাঝে বিরতিও নিতে হচ্ছিল। তাছাড়া বাইরের চাপও ছিলনা। ঘোরা শেষ করে সোজা নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা হতেই দুরত্ব মেপে অবাক হলো সে। বুঝতেই পারলোনা, তার এই দুর্বল শারিরীক অবস্থায় এতোটা দুরত্ব এতো অল্প সময়ে কি করে পার করলো। তার চিন্তা ছিল, কিভাবে দ্রূত এগিয়ে যেতে পারে। খেয়ালই করলো না যে, তার পরিবারের কোন কথা বা কোন ডাক তাকে বাঁধা দিল না। শুধুমাত্র দরজার কাছাকাছি এসে ঘাড়ে ব্যথা সত্বেও মাথাটি অর্ধেক ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকালো। বোনের উঠে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোন পরিবর্তন দেখলো না। তার সর্বশেষ দৃষ্টি গেলো মায়ের দিকে, মা সোফার উপরেই গভীর ঘুমে নিমগ্ন।
সে ঘরে ঢুকতেই দরজাটি বাইরে থেকে চেপে, বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দেয়া হলো। পেছনের হঠাৎ আওয়াজে গ্রেগর এত ভয় পেলো যে, তার কয়েকটা পা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভাঁজ হয়ে গেল। বোনই এতটা তাড়াহুড়ো করেছে। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়েছিল, পা টিপে টিপে এগিয়ে এসেছে, গ্রেগর শুনতে পায়নি। দরজায় চাবি লাগাতে লাগাতে বাবা মার দিকে তাকিয়ে বললো, ' বাঁচা গেল অবশেষে'!
'এবার'? নিজেকেই পশ্ন করে অন্ধকারে তাকালো গ্রেগর। একটু পরেই টের পেলো, তার চলার ক্ষমতা একেবারেই নি:শেষ। সে অবাক হলো না, বরং তার এই সরু, শীর্ন পায়ে যে এতদুর আসতে পেরেছে, সেটাই অস্বাভাবিক মনে হলো। কিছুটা ভালো বোধ করছিল নিজেকে। যদিও তার সারা শরীরেই ব্যথা, তারপরেও তার মনে হলো সে ব্যথা কমে কমে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। তার পিঠের উপরের পঁচা আপেল ও তার চারপাশের ধুলো আর পুঁজে ঢাকা ক্ষত প্রায় টেরই পাচ্ছিল না। নিজেকে এখান থেকে দুর করতে হবে, এই সিদ্ধান্ত, তার বোনের না যতোটা, নিজের কাছে আরো বেশী দৃঢ় মনে হলো। এই অবস্থায় এক শুন্যতা ও শান্তির মাঝে ডুবে রইল রাতের তৃতীয় প্রহর অবধি। রাত শেষ হওয়ার চিহ্ণ হিসেবে বাইরের আলোর আভাস অনুভবও করলো। তারপর তারা মাথা ঝুলে পড়লো একদিকে ও নাকের ছিদ্রের ভেতর দিয়ে তার সর্বশেষ নি:শ্বাসটি বেরিয়ে এলো।
পরদিন সকালে কাজের মহিলা এলেন। শক্তি ও তাড়াহুড়োয় সারা বাড়ী দরজাগুলো এমনভাবে খুললেন আর বন্ধ করলেন যে, কারো ঘুমানোর কোন সুযোগ রইল না। তাকে যে এ ব্যাপারে সাবধান হওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল, সেদিকে তার নজরই রইল না। প্রতিদিনের মতোই অল্প সময়ের জন্যে গ্রগরের ঘরে ঢুকে প্রথমে অস্বাভাবিক কিছুই টের পেলেন না। তিনি ভাবলেন, গ্রেগর ইচ্ছে করেই নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে বা কোন ভান ধরে আছে। তার হাতে যে ঝাড়ুটি ছিল, তার খোঁচায় চেষ্টা করলেন গ্রেগরকে দরজা থেকে সরানোর। কিন্তু তাতে সফল না হয়ে একটু রেগে গুতো দিলেন তার শরীরে। কোন রকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না করে যখন সরে গেলো গ্রেগরের শরীর, তখন সতর্ক হলেন তিনি। তারপর ঘটনাটি পুরো বুঝতে পেরে শিশ বাজাতে শুরু করলেন ও বেশীক্ষন না থেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। বাবা মায়ের শোবার ঘরের দরজা পুরো খুলে অন্ধকারে ঢুকে বললেন, 'মরেছে সে, দেখুন, দেখুন, একেবারে মরে গেছে সে'!
কাজের মহিলার তড়িৎ প্রবেশে হতচকিত সামসা দম্পতি কোনকিছু বোঝার আগেই সোজা হয়ে বিছানায় বসা। তারপর মি: ও মিসেস সামসা দ্রুত নিজেদের দিক থেকে বিছানা ছেড়ে নামলেন। মি: সামসা একটি চাদর জড়ালেন গায়ে আর মিসেস সামসা রাতের পোষাকেই ঢুকলেন গ্রেগরের ঘরে। এর মাঝে খুললো বসার ঘরের দরজাও, যেখানে গ্রেটে ভাড়াটিয়া আসার পর রাতে ঘুমোতো। পুরেপুরি পোষাক পড়া ও তার ফ্যকাশে চেহারা দেখে মনে হলো, সারারাত ঘুমোতে পারে নি। 'মৃত'? কাজের মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস সামসা, যদিও নিজেই তা পরীক্ষা করে বা না করেই বুঝতে পেরেছেন। 'আমি তা ই মনে করছি', বলেই তা প্রমান করার জন্যে ঝাড়ু দিয়ে ঠেলে গ্রেগরের লাশটি আরেকটু পাশে সরিয়ে দিলেন মহিলাটি। মিসেস সামসা এমন ভাবে এগুলেন যে, যেন তিনি ঝাড়ুর আঘাত ঠেকাতে চাইছেন, কিন্তু পরিনামে করলেন কিছুই। 'এখন আমরা খোদাকে ধন্যবাদ জানাতে পারি', বললেন মি: সামসা। বুকে ক্রশ আঁকলেন ও তিন মহিলাও তাকে অনুসরণ করলো। গ্রেটে এতক্ষন লাশের দিক থেকে একবারও দৃষ্টি ফেরায় নি। এবার বললো, 'দেখ, দেখ, কতোটা শুকিয়ে গিয়েছিল সে। অনেকদিন ধরে তো কিছই খেতো না। প্রতিদিন যতটা খাবার ঢুকানো হতো ঘরে, বের করা হতো ততটাই'! সত্যি সত্যিই গ্রেগরের শরীর ছিল পুরোপুরি শুকনো আর হালকা। তার পা'গুলো যে শরীরকে আর বহন করছে না, সেটাও চোখে পড়ল এতক্ষনে।
'চল গ্রেটে, আমাদের ঘরে কিছুক্ষনের জন্যে যাই', ম্লান হাসি হেসে বললেন মিসেস সামসা। গ্রেটে লাশের দিকে তাকাতে তাকাতে বাবা মায়ের পেছনে পেছনে শোবার ঘরে ঢুকলো। কাজের মহিলা দরজা বন্ধ করে জানালাটি খুলে দিলেন পুরেপুরি। মাচের্র শেষে সকালের বাতাসে তখন অনেকটাই ভেজা ভেজা ভাব।
নিজেদের ঘর থেকে তিনজন ভাড়াটিয়া সকালে নাস্তার জন্যে বসার ঘরে ঢুকলেন। সবাই মনে হয় তাদের কথা ভুলেই গেছে। 'আমাদের নাস্তা কোথায়'? বিরক্ত হয়ে কাজের মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন মাঝের ভদ্রলোক। মহিলা মুখে আঙ্গুল রেখে ওদেরকে গ্রেগরের ঘরের দিকে ইশারা করলেন। তারা সেখানে ঢুকলেন ও এলোমেলো পোষাকে পকেটে হাত রেখে গ্রেগরের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। গ্রেগরের ঘর তখন ভোরের আলোয় আলোকিত।
তখনই শোবার ঘরের দরজা খুললো। ড্রেসিং গাউন গায়ে একহাতে স্ত্রী ও একহাতে মেয়েকে ধরে মি: সামসা বেরোলেন সে ঘর থেকে। কান্নাচ্ছন্ন মনে হলো ওদেরকে, গ্রেটের মুখ বাবার বাহুতে লুকোনো।
'এই মূহুর্তেই এ বাড়ী ছাড়ুন আপনারা' বললেন মি: সামসা স্ত্রী ও মেয়েকে না ছেড়েই। 'কি বোঝাতে চাইছেন আপনি'? প্রশ্ন করলেন মাঝের ভদ্রলোক একটু অবাক ও মিষ্টি হেসে। বাকী দুজন কোমরে হাত রেখে এমন ভাবে অবিরত ঘসছিলেন যে, মনে হচ্ছিল অবশ্যই জিতে যাবেন, এমনি এক বড় যুদ্ধের জন্যে মনে মনে তৈরী করছেন নিজেদের। 'আমি যা বলেছি, সেটাই বুঝাতে চাইছি'। বলে মি: সামসা দুই মহিলাকে নিয়ে সোজা ভাড়াটিয়াদের দিকে এগিয়ে গেলেন। মাঝের ভদ্রলোক মাটির দিকে তাকিয়ে তার সমস্ত চিন্তাভাবনা নতুন করে সাজানোর চেষ্টায়। 'ঠিক আছে, তাহলে যাচ্ছি আমরা' বলে মি: সামসার দিকে তাকালেন তিনি। মনে হলো এই অকস্মাত অপমানে এই সিদ্ধান্তের পেছনে আরো একবার অনুমতির দরকার। মি: সামসা কঠিন চোখে করে মাথা নাড়লেন কয়েকবার। তাতে ভদ্রলোক লম্বা পা ফেলে ফেলে তাদের ঘরে ঢুকলেন। বাকী দু্থজন চুপচাপ কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে পেছন পেছন গেলেন। মি: সামসা তাদের আগেই সে ঘরে ঢুকে তাদের তিনজনের একত্রিত হওয়াকে বাধাগ্রস্থ করলেন। তিনজন তাদের টুপি পড়লেন, রাখার জায়গা থেকে তাদের লাঠি হাতে নিলেন, সন্মানে একটু মাথা নীচু করে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন। তারপরও কোন এক যুক্তিহীন সন্দেহের বশে দুই মহিলাকে নিয়ে মি: সামসা সিড়ির কাছে এগিয়ে গেলেন। রেলিংএ হেলান দিয়ে তিনজনই দেখলেন, তিন ভদ্রলোকই নেমে যাচ্ছেন নীচে, লম্বা সিড়িটি বেয়ে ধীরে ধীরে, কিন্তু একই গতিতে। সিড়িটা যেখানে বাঁক নিচ্ছে, সেখানে আদৃশ্য, পরমূহুর্তেই আবার দৃষ্টিসীমার ভেতরে। যতই দুরে সরছেন তারা, ততই কমছে সামসা পরিবারের আগ্রহ তাদের প্রতি। অবশেষে যখন একজন কশাই শিক্ষানবীস তার মাথায় বোঝা নিয়ে শক্তিশালী পদক্ষেপে উপরে ওঠা শুরু করলো, মি: সামসা তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে সিড়ির ঘর ছেড়ে নিশ্চিত মনে নিজেদের ঘরে ফিরে গেলেন।
পরের পর্বে সমাপ্য....।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




