somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক শহর তার দুই গল্প

২৩ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক শহর তার দুই গল্প



লন্ডনের 'ইস্টএন্ড' যার নাম 'হোয়াইট চ্যাপেল'

এক লন্ডন শহর কিন্তু তার দুই গল্প
"লন্ডন সিটি"

সিটি একটা কিন্তু তার দুটো গল্প
একদিকে রানী ভিক্টোরিয়ার জমজমাট গোল্ডেন জুবিলী (সাল ১৮৭৭) উৎসবের তোড়জোড় ।

ট্রাফালগার স্কোয়ার কে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে হবে। কারন সেখান দিয়ে যাবে রানী ভিক্টোরিয়ার ঘোড়া গাড়ীর বহর।
হাজার হাজার লোক জড়ো হবে সেখানে । রাস্তার দুই পাশে লাইন দিয়ে দাঁড়াবে জনতা।

তখন রানী ভিক্টোরিয়ার টিন এজ গার্ল । মাত্র কদিন আগে তার মাথায় দেয়া হয়েছে রানীর মুকুট ,অর্থাৎ রানী হিসেবে সিংহাসনে সবে মাত্র বসেছেন।
চার দিকে সাজ সাজ রব। ওয়েস্ট এন্ডের বিরাট বিরাট অট্টালিকার জানালা দরজা লাল নীল রঙে রঙ্গিন করা হয় । ফুলের মালা আর ইলেকট্রিক লাইট দিয়ে সাজানো হয় রাস্তা ঘাট ।

তার পঞ্চাশ বছর পরেই সেই রানী একে একে ইউরোপের 'রয়াল হেড' আর 'ভারতবর্ষের প্রিন্সেস' উপাধি পান।
তার দীর্ঘ শাসন আমলে ব্রিটেনের অর্থনীতি তুঙ্গে উঠে। "ব্রিটিশ রাজত্বে সুর্য অস্ত যায়না" বলা হত । কারন পৃথিবী জুড়ে বিরাট তার রাজত্ব ।
পৃথিবী জুড়ে লন্ডনের গল্প ।যে গল্পে লন্ডন কে দেখানো হয় শক্তিশালী রাজ্যের সবচেয়ে ধনী শহর হিসেবে ।
এই হল লন্ডনের এক দিকের গল্প আর এক দিকের গল্প লন্ডনের ইস্ট এন্ডের ।
যে গল্প খুব কম মানুষই জানে ।
দুষ্ট ক্ষত ঢেকে রাখাই ভালো তা নয় কি?

কারন তারা কে মানুষ বলে গণ্য করা হয় না। তাদের দেখা শুনা র কেউ নাই । তাদের কথা শুনা র ও কেউ নাই।

কি সেই গল্প ?
"দারিদ্র" !
কারা তারা ? কেন এখানে এলো কি অবস্থা তারা কে এখানে নিয়ে এসেছে?

হোয়াইট চ্যাপেল
যা ছিল সেই সময় লন্ডন শহরের সীমানার বাইরে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেসানের পর সেখানে অনেক ইন্ডাস্ট্রি গোড়ে উঠে ।
সেই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার জন্য গ্রাম থেকে শত শত বেকার মানুষ এসে হাজির হয়। তারা কে থাকতে দেয়ার জন্য ইন্ডাস্ট্রির মালিক অল্প দামের ম্যাটেরিয়াল দিয়ে অল্প জায়গাতে ঘেঁষা ঘেঁষি করে ছোটো ছোটো করে খুপরি বানিয়ে দায় । যাকে বলা হয় স্লাম বা বস্তি । কিছু কিছু লম্বা বাড়ী থাকলেও প্রত্যেক ঘরে ঘরে এক একটি পরিবার কোন মতে মাথা গুঁজে থাকতো ।

সে সময় মেয়েদের গৃহিণী হিসেবেই দেখা হত । স্বামী ইনকাম করতে যেতো আর স্ত্রী ঘর সংসার সামলাতো ।
তবে সেই ঘর ভেঙ্গে গেলে বা বিধবা হলে বা স্বামী দ্বারা পরিত্যাক্ত হয়ে পড়লে নারী অসহায় হয়ে যেত ।

ইনকামের মানুষটি যদি না থাকে কে ভরন পোষণ চালাবে? আর যদি থাকে বাচ্চা কাচ্চা ? তা হলে মেয়ে টিকে আরও সমস্যায় পড়তে হয়। তখন মেয়ে টিকে সেগুলো নিয়ে রাস্তায় নামতে হয় ।

সেই অসহায় মেয়ে গুলো র শেষ ঠিকানা হয় এই ইস্ট লন্ডনের 'কফিন বেড' যার ভাড়া চার পেন্স পার রাত । চার পেনি দিতে পারলে থাকো না হলে রাস্তায় বেঞ্চে , অলি গলি, বা চিপায় চাপায় শুয়ে পড়ো । ঘুম তো যেতে হবে।
এই রাস্তায় থাকা মেয়েদের কি বিপদ হতে পারে তা সবার জানা।

১৮৮৮ সাল । এই সময়ে কয়েক দিন পর পর পাঁচটি নারী মার্ডার হয় এখানে।
পাঁচ নারী তাদের জীবন আরম্ভ হয় বিভিন্ন স্থানে । কিন্তু ভাগ্য তাদের নিয়ে আসে লন্ডনের ইস্ট লন্ডনে ।
তারা ভিন্ন হলেও এক জায়গায় তাদের মিল আর সেই মিল হলো তাদের কে হত্যা করে মারা হয় আর হত্যা করে সেই এক জন মানুষই । জ্যাক দি রিপার । কে সেই জ্যাক দি রিপার ? তার পরিচয় এখনো নিশ্চিত নয় । নাম টি দায় মিথ্যা দিয়ে চিঠি লিখে স্টার পত্রিকার রিপোটার্র ।যেন লিখছে সেই খুনি নিজে। আসলে তা ছিল বানানো । খুনির একটা চিঠি পোস্টে এসেছে । এটা পড়ার জন্য অনেক মানুষ পেপার কিনবে ,এই ছিল প্ল্যান । এটা ছিল এডিটরের নির্দেশ । উদ্দেশ্য পেপার যাতে বেশি বিক্রি হয়।

ভিক্টোরিয়ান আমল।
সেই আমলে ওয়েলফেয়ার সিস্টেম ছিল না । স্কুল বাধ্যতামূলক হয় নি । তবুও আগের শতকের তুলনায় মানুষের অক্ষর জ্ঞান কিছুটা বৃদ্ধি হচ্ছিল ।
সেই অল্প পড়াশুনা জানা মানুষের জন্য ট্যাবলয়েড পত্রিকা। পত্রিকা গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল কি ভাবে রমরমা খবর ছাপিয়ে সেই মানুষগুলোকে টার্গেট করা যায় পাঠক হিসেবে । শুধু মাত্র পেপার বিক্রির জন্য হত্যার রমরমা গল্প প্রকাশ করা হতো । কে কে সাক্ষী দিয়েছে ,কি দেখেছে, কি বীভৎস সেই হত্যা ইত্যাদি ইত্যাদি ।
"The Star" সে সময়ের সেই রকম একটা ট্যাবলয়েড পত্রিকা । চার্লস ওয়ারেন ছিল এর ইনভেস্টার এবং ফ্রেড বেস্ট জার্নালিস্ট রিপোর্টার ।
সেই ফ্রেড বেস্ট রিপোর্টার এর হাতে লেখা লাল অক্ষরে চিঠিই ছিল সেই 'জ্যাক দি রিপারের' চিঠি ।
পরবর্তীতে ইতিহাসবীদ রা অনুসন্ধান চালিয়ে এই সব তথ্য খুঁজে পান।
ইতিহাসবিদ রা বলে গেছেন এই মেয়ে গুলো "They never received justice" ।

যেহেতু স্থান টিতে দরিদ্র মানুষের বসবাস তাই মার্ডার চুরি ,ছিনতাই এগুলো ছিল প্রতিদিনের সাধারণ ব্যাপার।

একদিকে ব্রিটেনের ধনী লোকের বসবাস, আর একদিকে এই মানুষ নামক কীটের বাস ।
তাদের কে দেখাশুনার জন্য যেন সরকার নয়। সরকার
শুধু মাত্র ধনীদের জন্য।

"A country of two nations:two nations between whom there is no intercourse and no sympathy , who are ignorant,as if they were dwellers in different zones or inhabitants of different planets, who are formed by different breeding, are fed by different food,are ordered by different manners,and are not governed by the same laws.. The RICH and The POOR. Benjamin Disraeli. 1845

এই পাঁচ টি মেয়েকে পুরুষ শাসিত নিউজ পেপার মালিক নিজেদের পেপার যাতে বেশি বেশি বিক্রি হয় তাই মনগড়া রিপোর্ট লিখে বিক্রি করতো ।

তারা কেউই পতিতা ছিল না তবু তারা বানোয়াট ভাবে প্রচার করতো তারা পতিতা ।
তাদের হয়ে বলার কেউ নাই।
এই পাঁচ নারী কে নিয়ে খবরের কাগজের মালিক রসকষ লাগিয়ে যেমন ইচ্ছা তেমন রিপোর্ট লিখে কাগজ যাতে বেশি বিক্রি হয় তার প্রতিযোগিতায় নেমে গিয়ে ছিল । উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন ।

সেই অভাগা ,অসহায় ,ক্ষুধার্ত আশ্রয় হীন মেয়ে গুলোর জন্য কিন্তু তাদের বা সেই তথাকথিত ধনী মানুষদের কোন মাথা ব্যাথ্যা ছিল না।
এই পাঁচ নারী পলি নিকল ,অ্যানি , এলিজাবেথ ,ক্যাথরিন এবং মেরি জেন কেলি।
যারা হত্যার শিকার তারা টাকার অভাবে রাস্তায় ফুটপাতে ঘুমাতে বাধ্য হয়ে ছিল আর সেখানেই তারা কে খুন করা হয়। কিন্তু রিপোর্টার খবর টিকে রসালো করার জন্য লাগিয়ে দায় পেশা "পতিতা" ।
এই পাঁচ নারী তখন কার সময়ের সমাজের প্রতিচ্ছবি । প্রকৃত ইতিহাস। যাকে বলা হয় সামাজিক ইতিহাস ।

এই পাঁচ নারী কারর মেয়ে, কারর বোন, কারর স্ত্রী , কারর মা।
সর্ব পরি তারা "মানুষ" ।
সেই সময়ে 'মানুষ' শুধু পুরুষ কেই বলা হতো । মেয়ে মানুষ আবার "মানুষ" হয় নাকি?
সেই পরিচয় গুলো নিয়ে কেউ চিন্তা করে না।


এক শহর তার দুই গল্প আর এই লন্ডন শহরের হোয়াইট চ্যাপেল বা ইস্ট লন্ডনের আরও ইতিহাস আছে।
আর তা হল এখানে বিভিন্ন সময়ে জীবিকার সন্ধানে আসে অন্য দেশ থেকে আসা মানুষ।
সব আগে এসেছে ফ্রান্স থেকে, তারপরে ক্রমান্বয়ে আয়ারল্যান্ড, 'জু' কমুইনিটি এবং সর্ব শেষে বাংলাদেশী।

বাংলাদেশী মানুষ আসে ব্রিটেনে ১৯৪৫ সালের দিকে । অবশ্য খুব অল্প সংখ্যক বাংলাদেশী তার আগেও এসেছিল জাহাজের কর্মচারী হিসেবে । জাহাজ থেকে নেমে তারা থেকে যায় ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ঠিক
করা এবং কলকারখানায় কাজের জন্য শ্রমিকের দরকার পড়ে । তখন বাংলাদেশ বলে কিছু ছিল না। ভারত ছিল তাদের কলোনি

প্লেনের ভাড়া দিয়ে সে সময় বাংলাদেশ থেকে মানুষ নিয়ে আসা হয়।
ফ্রান্স থেকে আগত মানুষ রা এখানে সিল্ক বুননের কাজ করতো,দুর্ভিক্ষ পীড়িত ছিল আইরিস , জু কমুইনিটি চামড়ার জুতো তৈরি আর বাংলাদেশী রা রেস্টুরেন্ট বিজিনেস । অবশ্য প্রথম দিকে তারা কারখানায় শ্রমিক ছিল।

যারাই এখানে থাকুক না কেন প্রথম দিকে কঠোর পরিশ্রম করে তারপরে টাকা জমিয়ে বাড়ি কিনে এখান থেকে দূরে চলে যায়।

জ্যাক দি রিপার , বস্তি , দারিদ্র আর মাইগ্র্যেন্ট করা মানুষ এদের নিয়েই হোয়াইট চ্যাপেল।

এই ছিল ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনের ইস্ট লন্ডনের গল্প ।

হুসনুন নাহার নার্গিস
নারী ও শিশু বিষয়ক কর্মী ,লন্ডন












সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১২:২০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৫৭



আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।

ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১৫


((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×