নাসরীন খান
নৌকাটি হেলে দোলে ধীর লয়ে চলছে। শ্রাবণের মনটা ভীষন একঘেয়ে লাগছে ।শুভটা সাথে এলে এমনটা হতো না।দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখত সারাটা বেলা।মার উপর রাগ হচ্ছে, ওকে রেখে এসেছে ইচ্ছে করেই। ও এলে নাকি বেশী লাফঝাপ হতো ,নৌকা ডুবে যাওয়ার সম্ভাব্য কারন নাকি এটা।
হঠাৎ!হাতেম মাঝির গলা -
সামনের আওরে( হাওরে)অনেক শাপলা দেহা যাইব ।বেহেই রেডি থাইক্য উডাইনির লাইগ্যে। তোমরা ঢেঁপও উডাইত পারবা।বড় বড় ঢেঁপ খাইছনি কোনদিন?
হাওরের বুকে এ যেন এক বিশাল লাল সাদা তারার মেলা ।এমন দৃশ্যে মনটা এক পলকেই ভাল হয়ে যাবে যে কারো।এযে কি স্নিগ্ধ দৃশ্য!হাওড়ের বুকে নৌকা চড়ে না দেখলে কেউ বুঝবে না। বড় বড় পাতার মাঝে সবুজ আর সাদার মিশ্র খেলা ।
হাতেম নানুদের পুরানো কামলাদের একজন।হাওরের মাঝেই তার দিন কাটে ,এজন্য অভিজ্ঞতাও বেশ পুক্ত ।কোন হাওরের নাম কি , পানির রং আর গভীরতা দেখে বলতে পারে কোন হাওরে নৌকা চলছে।খাইল্যাজুড়ির হাওর ,কইজানির বিল ,মদনের হাওর। হাওরের কোথায় কি সব ওর জানা।
কোন মেহমান এলে তাকে নৌকা করে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসা তার একটা বড় কাজ ।
-আম্মা ,দেইখছইন কত বড় শাপলা ।হেই যে দেউখ্যাইন একটা ঢেঁপ।
কাছে গেলাম ,সত্যি একটা গোলাকার সবুজ রঙের ফল।অনেকটা পেয়ারার মত,ভিতরে অসংখ্য ছোট ছোট বীচি।বীচিগুলিই খাওয়া হয়।আবার শুকিয়ে ভেজে খৈ তৈরী করা যায়।
মনি হাতেমের দিকে চেয়ে আছে ।ওর কথা বুঝতে পারছে না।হাতেম নেত্রকোনার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে।
-তুমি এবার খই খাওয়াবা।
-আম্মা আপনেরা কইতাছইন অবশ্যই খাওয়াইবাম।
ছোটবেলা থেকে শ্রাবণ এত নানু বাড়ি গিয়েছে যা গুণে বলতে পারবে না । ও সেই কারনে আঞ্চলিক ভাষা হুবহু বলতে পারে ।
-শ্রাবণ, বেশী নড়িসনা।নৌকা ডুবে যাবে ।আর শাপলা নিতে হবে না ।
আমাদের চোখে মুখে ভয়ের কোনই বালাই নেই ।মা ভয়ে অস্থির ।
আর নানু !একটু ঢেউ উঠলেই 'লা ইলাহা ইল্লা আন্তা-----'সাথে আল্লার কাছে প্রার্থনা-তুমি মান ইজ্জত রাইখ্য আবুডিরে( বাচ্চা গুলোকে) নিয়া ঠিকমতো বাড়ি হৌছাইয়্যা দিও ।
হঠাৎ বৃষ্টি শুরু।পানির উপর বড় বড় ফোটাগুলি পড়েই পাঁপড়ির মত ছড়িয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে।ইচ্ছে হচ্ছে পানিতে নেমে যেতে। শ্রাবণের মনের ভিতরে ইচ্ছেটা কাঠঠোকরা হয়ে ঠুকরাচ্ছে।মা আর নানুর ভয়ে চুপচাপ বৃষ্টি পড়া দেখছে।আর ভাবছে বাবা এলে ভালো হত।এখন ঠিকই পানিতে নামা যেত।বাবার শুধু কাজ আর কাজ ,অফিস থেকে কদিন ছুটি নিলেই পারত।
মাঝে মধ্যে দু-একটা বড় ঢেউ এলেই নানুর দোয়া দরুদ বেড়ে যাচ্ছে । যাক বৃষ্টিটা থামলো'মণি চল ছঁইয়ের বাইরে। এদের যন্ত্রনায় ভেতরে থাকা যাচ্ছে না'।
নুরু ছেলেটা মাটির চুলায় ভাত তুলেছে বৃষ্টি থামতেই ।নানু বাড়ি পৌছতে আরো ৫-৬ ঘন্টা লাগবে ।বাজারে নৌকা থামিয়ে বড় এক কালিবাউশ মাছ কেনা হলো। সেটা কেটে বাঁটা মশলা দিয়ে রান্না হচ্ছে বেশী ঝাল দিয়ে।গ্রামের একটা গন্ধ থাকবে তাতে। সাথে শুকনো মরিচের আলু ভর্তা।
-নৌকায় রান্না, নৌকায়ই খাওয়া।পানির মধ্যে ভেসে ভেসে খাওয়া, খুব মজা হবে তাই না মণি?
-আমিত ঝালের জন্য খেতেই পারবো না আর তুমি বলছো মজা হবে?
পূব দিক থেকে বাতাস বইছে ।নৌকায় পাল তুলে দেয়া হলো ,হাল ধরেছে এখন নুরু ।আমরাসবাই খেতে বসলাম ,মা সবাইকে বেড়ে দিচ্ছে ।
-পানির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খাব,মা বাইরে বসি?
-মণি!ভেতরে বসে খাউ।
-আমি খাবই না।
মণির মারমুখি আবদারের কাছে মার পরাজয় দেখে শ্রাবণের হাসি পেল।
বিকেলের রোদটা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে ।সবাই নৌকায় ঘুমুচ্ছে ,মাঝি দুজন তামাক টানছে ।হুক্কার মাথায় থেকে থেকে লাল আগুন জ্বলে উঠছে।এত মনযোগ দিয়ে হুক্কা টানছে দেখে আমারও টানতে ইচ্ছে করছে।ছেলে হলে হয়ত ইচ্ছাটা পোষে রাখতাম না । কি আর করা?পানির দিকে তাকিয়ে তল দেখার চেষ্টা করছি ।স্বচ্ছ পানির নীচে প্রত্যেকটা ঘাস আর শ্যাওলা দেখা যাচ্ছে।মাঝে মাঝে দু-একটা মাছ লাফ দিয়ে পানির উপরে উঠে আসছে আবার ডুবে যাচ্ছে।
-শ্রাবণ,ভেতরে আস।সন্ধা লেগেছে আর বাহিরে থাকে না।
-আর একটু থাকি মা।
আকাশটা কেমন বিষন্ন মনে হচ্ছে,হয়ত আমার মনটাই বিষন্ন লাগছে তাই আকাশটাকে এমন দেখাচ্ছে।
-ভিতরে আইয়্যাপর অহন আর বাইরে থাহন লাগদ না ।জ্বীন-ভূত নামে আওরে সন্ধ্যা বেলা ।
-আসছি নানু।
-একটু হুইত্যা থাক ভালা লাগবোনে।হারাডা দিন খালি তাইতুই করছস।আমরা ঘুমাইছি অতক্ষন অহন তুই একটু ঘুমা ।নাও মাত্র মদন ছাড়াইছে আরো ৩-৪ ঘন্টা লাগবো।
এবার হাতেমের উদ্দেশ্য নানা বলছে
-ভালা কইরে দেইখ্যা নাও চালাইস,কানাওয়ালা ধরব।
-আইচ্ছে,আম্মাসাব আপনে কোন চিন্তা করইন্না যে।আমরা ঠিকমতই চালাইবাম।
একটু শোয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই মাথা সহ সারা গা দোলে ।কেমন করে ঘুমাচ্ছিল ওরা?হয়ত তাদের কাছে এমনটা লাগেনি।উঠে বসলাম।
-নানু!কানাওয়ালা কি ?
-রাইতের বেলা বদ জ্বীন নামে।হেরা মাঝিরারে ভুল পথ দেহায়।তহন আর নিজের বাড়িত যাওনের রাস্তা পাওয়ন যায় না।হের লাইগ্যা রাইত হইলে কইলমা-কালাম ফড়ন লাগে বেশী কইরা।
মনি ভয়ে অস্থির ।নানু ভয়ের জন্য সুরা পড়ে মনিকে ফুঁ দিচ্ছে।আর মা নানুকে বকা দিয়েছে কেন এই সব এখন বলল।
-আওড়ের বেকতাই জানা থাহা ভাল ।এরার অভি জ্ঞতা লাগদোনা ?
-সাথে কেউ না কেউতো থাকবেই ,ওরা কি একা আসবে কখনো তোমার হাওরের দেশে?
-'তোমার হাওড়ের দেশে' এইটার মানে কি!আওরের দেশটা তর নিজের না ?বিয়া অইছে,অহন এইডা তর জাগা(জায়গা)না।মাজ মাজে বেরাইত আইবে,আবুরারে লইয়া।এর বেশি কিস্তা না।
- এইটা কি বল আম্মা? বিয়ে হলে বাবার বাড়ি নিজের থাকে না?
- তরে বুজাইতে চাইছি য তরা তো ডাহা(ঢাকা) থাহচ।এইহানে আইওস বছরে একবার।আস্তে আস্তে বেকতাই ভুইল্যা যাইবে।
পর অইচস, এইতা বুজাইচি কি!
নানুর মেজাজ ভীষন খারাপ ।মা সুর বদলে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
নৌকা চলছে গোবিন্দশ্রীর হাওরে। দূর থেকে পর পর এক একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে।কুপি বাতির ডিমডিম আলো জ্বলছে প্রতিটা গ্রামের বুক জুড়ে।মনে হচ্ছে ভূ-পৃষ্ঠে নতুন কোন তারকা রাজির মেলা বসেছে।চারিদিকে পানির আকাশ মাঝখানে ভূ-পৃষ্ঠের তারারা।একটা কবিতা লিখতে পারলে ভাল হত।কিন্তু খাতা কলম ছাড়া বেশী দূর এগোবে না ।তবুও চেষ্টা---
' ভূ-পৃষ্ঠে তারা জ্বলে
আমার হাওর,ভাটির দেশে ,
পানিগুলি আকাশ হলে
ঢেউ উঠে গা ঘেষে।'
-[মাঝিদের একজন]আম্মারা আফনেরা রেডি অউহাইন আমরা আইয়্যা পরছি।হেই যে গাওটা দেহা যাইতাছে।
-হ্যাঁ !সবাই গুছিয়ে নাউ।
মার মুখটা এখনই কান্নাকাটির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।ঘাটে নানুরা দাঁড়িয়ে থাকবে মেয়েকে বরণ করার জন্য ।আর গলা জরিয়ে ধরে কান্নাকাটি হবে।এই কান্নাকাটির মানেটা হল -'অত দিন পরে আমরার কথা মন অইছে বেডি তর।অত পাষান অইচছ ঢাহা গিয়া'।
আবার যাওয়ার সময়ও এমনটি হবে তখন কারন থাকবে-'আবার কোনদিন দেহা অইব কেলা জানে।তাড়াতাড়িই হিরা আইচ নাতিডিরে লইয়্যা'।
অবশ্য ওদের কান্নাকাটির দৃশ্যে শ্রাবণের মনটাও খারাপ হয় ।মণি আর আসাদটা হাসে। বাসায় ফিরে ওদের কথাগুলি সুর করে কান্নার ছলে বলেবলে মাকে রাগাতে চায়।
মেঝ মামা করোটিয়া সাদত বিশ্বঃ কলেজে পড়ে। বাড়িতে ঢুকে দেখি মামাকে ।ভীষন খুশি লাগছে ।কারনতো একটা আছে!মামার মাছ ধরার নেশা।সেই কি বড় বড় মাছ।কখনো ধরতে যাইনি তার সাথে।তবে এবার যাবই।
ঘরের এক কোনে কাজের মহিলা দুজন কাহাইলে পিঠার গুড়ি ভাঙছে।মেহমান এলে এই আয়োজনটা দেখতে আমার ভালো লাগে ।যদিও পিঠা আমার খুব পছন্দের না।তবু নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মেহমান ভাবা যায়।
কাল থেকে দেখা যাবে আরো আয়োজন।বড় বড় মাছের বেপারিকে খবর দেয়া হবে মাছ নিয়ে আসতে। গীত শুনতে আমি পছন্দ করি বলে খুদবানুর মাকে খবর দিবে নানু ।সে এসে বিকেলে গীত শুনিয়ে যাবে যতদিন থাকি।আর যাবার সময় নানু খুঁচিতে মেপে চাল দিয়ে দিবে সাথে কিছু আরো।তাতেই সে মহা খুশি।
মামাকে অনেক কষ্টে রাজি করা হলো মাছ ধরতে যাবার সময় আমাকে সাথে নেবে ।আয়োজন চলছে সন্ধা থেকে। কেউ হ্যাজাক লাইটে তেল ভরে ঠিকঠাক করছে,কেউ কোন কোন টেঁটা নেয়া হবে পরীক্ষা করছে।হ্যাজাক লাইটে পাম্প দেয়া হচ্ছে অনেক্ষন ধরে, ঠিক হচ্ছে না ।শঙ্কা লাগছে যদি ঠিক না হয়তো যাওয়া বন্ধ।
ঘন্টাখানেক পর আমরা রওনা হলাম।সাথে বাড়তি আর একটি নৌকা। হাওরের দিকে যাচ্ছে নৌকা।লাইটের আলোতে পানির ভিতরকার সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ।কোন শব্দ করা নিষেধ।শব্দ হলে মাছেরা পালিয়ে যায়।কথা বলা হচ্ছে ফিসফিস করে।পানির নীচে বড় একটা রুই মাছ মুখটা আধোআধো খুলে ধীরে চলছে।মামা অতি সতর্কতার সাথে টেঁটা ছুড়ে মাছটার গায়ে ফুটিয়ে দিল।
সাথে সাথেই দুজন কামলা ( কাজের ছেলে) লাফ দিয়ে মাছটাকে ঝাপটে ধরে পানি থেকে টেনেহিছড়ে নৌকায় উঠাল। এমনি চলতে লাগলো ।মামা এক করে ছোট বড় অনেক ধরনের মাছ ধরল।।এদিকে ফজরের আজান শুনা যাচ্ছে পাশের গ্রামের মসজিদ থেকে।এতক্ষন কত সময় চলে গেছে কেউ বুঝতেও পারেনি ।বাড়ি ফিরে সবাই যে যার মতন ঘুমুতে গেলাম।
শ্রাবণ এখন আর ছোট্টটি নেই।সে এখন শুধু সেই দিনগুলোর কথা ভাবতে পারে।যখন একলা বসে থাকে ।কেউ থাকে না চারদিকটায় ।ছুঁয়ে দেখতে পারে না আগের মতন করে।ফিরে যেতে ইচ্ছে করেছে বহুবার সেই হাওর, সেই নৌকো,সেই পানির কলকল ডাকের কাছে।পারেনি আর।কখনো পারবে কিনা জানে না।বদলেছে দিন,অনেক বছর,তার জীবন ,গাঁয়ের ধরন।সবেতেই পরিবর্তন এসেছে।তবুও মাঝে মাঝে একান্ত নিজের মতো করে সেই দিনগুলির কথা ভাবে।হারিয়ে যায় স্মৃতির কাছে ।তখন মনটা ভার হয়ে যায় অজান্তেই।শ্রাবণ ফিরে যেতে চায় তেমন করেই।।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১০:১২